গল্পঃ হরেক রকম বড়া

‘ কই গো! চিংড়ির বড়া কতদূর?’ রফিক সাহেবের গলা শুনে রাবেয়ার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। একটা কড়া জবাব দিতে দিয়ে থেমে গেলো রাবেয়া।

নিজেকে সামলে বললো, ‘ একা হাতে এতো গুঁড়ো চিংড়ি বেছে শেষ করা যায়? ছোট ছোট শামুকে ভর্তি তোমার চিংড়ি। ‘

রফিক সাহেব কেমন লজ্জা পেয়ে গেলেন! নিজেকে সামলে বললেন, ‘ ভুলেই গিয়েছিলাম গুঁড়া চিংড়িতে গুঁড়া গুঁড়া অনেক শামুক, পানির পঁচা লতাপাতা থাকে।দাও দাও আমাকেও দাও আমিও হাত লাগাচ্ছি।’


রাবেয়া জানতো এই লোক এখন কোমড়ে গামছা জড়িয়ে কাজে নেমে যাবে। রাবেয়ার চোখে দেখা এই একমাত্র পুরুষ যে ঘরের এবং রান্নাবান্নার কাজ কোন অভিজ্ঞ মেয়ের থেকেও হাজারগুন ভালো গুছিয়ে করতে পারে। ২০ বছরের সংসার জীবন রফিক সাহেব আর রাবেয়ার। রাবেয়ার তবুও মনে হয় এইতো সেদিন এই লোকের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। এতো শান্ত, ভদ্র, সরল মনের মানুষ রাবেয়া তার জীবনে দেখে নি। কেমন কপাল করে জন্মালে রফিক সাহেবের মতো একজন মানুষ তার জীবনসঙ্গী হয় রাবেয়ার জানা নেই। যত দিন যায় রাবেয়া তত রফিক সাহেবে মুগ্ধ হয়।

সুখের কথা ভাবতে গিয়ে রাবেয়া হুট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সুখের এই জীবন পাওয়ার আগে রাবেয়া যে বিভীষিকাময় জীবন কাটিয়েছে সেটা তো মিথ্যা না। সেই বিভীষিকাময় জীবনের কথা মনে উঠিলে রাবেয়া এখনো কেঁপে উঠে। অতীতের সেই জীবনের কথা মনে হতেই রাবেয়া একটা ছোট পঁচা শামুক সরাতে গিয়ে শামুকের মুখে নিজের হাতটা কেটে ফেললো। ইস! বলে রাবেয়া হাতটা সরিয়ে ফেললো।


‘ মাঝে মাঝে তোমার কি যে হয় রাবু! একটু সাবধানে কাজ করবা না? দেখি দেখি কতটুকু কাটলো? যাও হাতটা আগে ধুয়ে নাও।’ একইসাথে হাজারটা কথা বলবে এখন রফিক সাহেব।


রাবেয়ার হাত খুব বেশি কাটে নি। ছোট একটা শামুকে আর কতদূর কাটে! কিন্ত রফিক সাহেবের এই অস্থিরতা তার ভালো লাগে। সে রফিক সাহেবের দিকে আবার মুগ্ধ হয়ে তাকায়। রফিক সাহেবকে দেখতে দেখতে আবার অতীতে ফিরে যায় রাবেয়া বেগম।

সেদিন পালিয়ে যাওয়ার প্রথম সংসারের প্রথম দিন ছিলো। রাবেয়া এর আগে কখনো নিজের প্লেট ধুয়ে ভাত খায় নি। খাবে কিভাবে? বড়লোক বাবা মা একমাত্র আহ্লাদী কন্যা রাবেয়া। তার কোনকিছুর প্রয়োজন হলে সে কথা বলার জন্য হা করার সাথে সাথে সামনে তিন চারজন এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই রাবেয়া যেদিন প্রথম ভাত রান্না করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে!

সেদিন চুলার উপরে থাকা গরম পাতিলের ঢাকনা সরাতে গিয়ে হাতে গরম তাপ লাগে। তাপ লাগার সাথে সাথে হাত সরাতে যেয়ে ফুটন্ত পাতিলে আঙ্গুল ঢুকে যায়। মনের উপর খুব চাপ থাকায় যতটা না ব্যথার সেদিন কাঁদছিলো, তার থেকে বেশি ভয়ে। যার সাথে রাবেয়া তার প্রথম সংসার শুরু করেছিলো সেই কবির হাসান সেদিন রাবেয়াকে বলেছিলো, ‘রান্নাবান্না করতে গেলে হাত পা কমবেশি সবারই পুড়ে। এতো কাঁদার কিছু হয় নি। তোমার বাপের মতো আমার লাটসাহেবী এতো ধোন সম্পদ নেই। কোন দাসী বান্দীর ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারবো না। ‘

সেদিন রাবেয়া আগুনে পোড়া হাতের ব্যথা ভুলে গিয়ে সদ্য বিয়ে করা তার প্রথম ভালোবাসার মানুষের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো। এই সেই মানুষটা যার জন্য সে বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছেড়ে চলে এসেছে। এই সেই মানুষ যে তার হাত ধরে বলেছিলো বিশালবহুল জীবনযাপন দিতে না পারলেও যে তাকে বুক দিয়ে সারাজীবন আগলে রাখবে। এই সেই মানুষ! সত্যিই কি এই সেই মানুষটা!

কবির হাসান সম্পর্কে রাবেয়ার শিক্ষক ছিলো। প্রতিদিন বিকেলে রাবেয়াকে পড়াতে বাসায় আসতো। কৈশোরে পা দেওয়া রাবেয়ার তখন উড়ু উড়ু মন। কবির হাসানের সুন্দর চেহারা, মায়াবী চোখ আর সিনেমার হিরুদের মতো চমৎকার বাচনভঙ্গীতে রাবেয়া খুব অল্প সময়ে কবির হাসানের প্রেমে পড়ে যায়। পড়া বাদ দিয়ে রাবেয়া সারাক্ষন এই সেই প্রশ্ন করে বেড়াতো কবির হাসানকে। কবির হাসান একটু চুপ করলেই যেন রাবেয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো। কবির হাসানের প্রতিটি কথায় কি যে মায়া থাকতো সে কথা শুধু রাবেয়াই জানে!


‘আরে দেখি দেখি হাত কতটুকু কাটলো? সেই কখন হাত ধুইতে বললাম তোমাকে আর তুমি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কি ভাবছো বলো তো দেখি?’ রফিক সাহেবের কণ্ঠে রাবেয়া চমকিয়ে উঠে।


‘তুমি এতো অস্থির কেন ? হাত বেশি কাটে নি।’ রাবেয়া একটু হেসে কিছুটা জোরে কথাটা বললো। কিন্তু মনে মনে সবসময় চায় রফিক সাহেব এতো অস্থির থাকুক ওর জন্য। সামান্য একটু অস্থিরতায় যে পরিমান ভালোবাসা মেশানো থাকে কোটি বছর ভালোবাসার প্রমান দিয়ে গেলেও তার ছিটেফোঁটা বুঝানো যাবে না।


‘আরে অস্থির হবো না! একদিকে আমার স্বাদের চিংড়ির বড়া, অন্যদিকে আমার ভালোবাসার মানুষটা! কোনদিকে যাই বলো তো?’ রফিক সাহেব সরল গলায় কথাটা বলে অদ্ভুর অসহায়ের লুক দিয়ে রাবেয়ার দিকে তাকালো। রাবেয়া জোরে হাহাহা করে হেসে দিলো।


‘আসো আসো! তোমার চিংড়ির বড়ার কাছেই আসো। এই চিংড়ির বড়ার কাছে তুমি দেখি সত্যিই অসহায়। একটা মানুষের চিংড়ির বড়া এতো প্রিয় হয় কিভাবে বলো তো? ‘
‘ঘরে বানানো তেঁতুলের টক, গরম গরম চিংড়ির বড়া আর শুকনো মরিচ ভাজা! আহা অমৃত! আর এই তেঁতুলের টকে যদি সামান্য লেবুর রস মিশিয়ে দাও পুরো খাবারের স্বাদই বদলে যাবে। এই চিংড়ির বড়ার সাথে যদি কয়েকটা পুঁই শাকের নরম পাতা দাও না তাহলে তো বড়ার স্বাদ কয়েকশ গুন বেড়ে যাবে। আর যদি… ‘ রফিক সাহেবের মুখে রাবেয়া হাত দিয়ে কথা বন্ধ করে দিলো।


‘আর সাথে যদি ঝুম বৃষ্টি হয় তাহলে পুরো বড়া আর বৃষ্টিতে মাখো মাখো, তাই না?’ রফিক সাহেবের মুখ বন্ধ করে রাবেয়া নিজে পরের লাইন সম্পূর্ণ করলো। বৃষ্টির কথা বলে রাবেয়া নিজেই চুপ হয়ে গেলো। সেইদিনও বৃষ্টি ছিলো যে বৃষ্টির পানিতে রাবেয়া তার বিভীষিকাময় জীবনের অধ্যায় ধুয়ে এসেছে।

কবির হাসান ভেবেছিলো একমাত্র মেয়ে ভুল করেছে। বাবা মা আজ হোক কাল হোক মেয়েকে স্বামীসহ মেনে নিবেন। কিন্তু রাবেয়ার বাবা আকবর খান মেয়ের জন্য পুরো অন্ধ ছিলেন। সেই মেয়ে যখন তার বাবা মাকে ভুলে দুইদিনের পরিচিত কোন যুবকের হাত ধরে ঘর ছাড়ে সেই অকৃতজ্ঞ মেয়েকে তিনি ঘরে তুলতে নারাজ। রাবেয়ার মায়ের অনেক কান্নাকাটির পর আকবর খানের মন কিছুটা নরম হয়। তখন তিনি এক কঠিন শর্ত দেন। যদি কবির হাসানকে ছেড়ে রাবেয়া আসতে পারে তাহলে তিনি মেয়েকে ঘরে তুলবেন। কবির হাসান বোকা পাত্র না।

তিনি সম্পত্তির লোভে রাবেয়াকে বিয়ে করেছে। এই সম্পত্তি এতো সহজে হাত ছাড়া করা যাবে না। বিয়ের ১৫দিন পর থেকে শারীরিক মানসিক নানানভাবে রাবেয়াকে অত্যাচার করা শুরু করে কবির হাসান। কবির হাসান ভাবে মেয়ের এতো অত্যাচার নিশ্চয় কোন মেয়ের বাবা মা মেনে নিবে না। তখন মেয়ের জামাইসহ মেয়েকে মেনে নিবে।
রাবেয়া নিজের অত্যাচারের কথা নিজের বাবা মাকে বলতেও পারছে না। সে মুখ তো সে রাখে নি। অন্যদিকে দিন দিনকে কবিরের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিলো।
আকবর খান বুঝতে পেরেছিলেন কবির সম্পত্তির লোভে তাকে মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু তার বোকা মেয়েটা সত্যি সত্যি লোভী কবিরকে ভালোবেসেছে।
লোভী আকবরকে তিনি তার সম্পত্তি ভোগ করতে দিতে আগ্রহী না তাই তিনি রাবেয়াকে কোনভাবেই মেনে নিচ্ছেন না।


কবির অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলো সে বাচ্চা নিবে। বাচ্চার মুখ দেখে তার নানা নানী ঠিক মেনে নিবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। রাবেয়া বাচ্চা নিতে রাজি হচ্ছিলো না।
কিন্তু কবিরের অত্যাচারের কাছে পরে হার মেনে রাবেয়া কনসিভ করলো। রাবেয়ার তখন তিনমাস চলছে। একদিন রাবেয়ার মা লুকিয়ে রাবেয়ার সাথে দেখা করতে আসে।
সেদিন সকাল থেকে আকাশের অবস্থা খুব খারাপ। এইদিকে কবির রাবেয়াকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে রাবেয়া যেন তার বাবাকে ফোন করে টাকার কথা বলে। রাবেয়াকে টাকা ততদিনে শেষ হয়ে এসেছে।


কবির কোন কাজে জয়েন করে নি ততদিন পর্যন্ত। রাবেয়া তার বাবাকে ফোন করে টাকা চাইতে রাজি হচ্ছিলো না। কবির রাবেয়াকে মারতে মারতে বের করে দেওয়ার জন্য দরজার কাছে নিয়ে গেলো। রাবেয়া কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছিলো এই বৃষ্টির মধ্যে তাকে বের করে না দিতে , তাকে আর না মারতে। কে শুনে কার কথা!
রাবেয়া ঘর থেকে বাহির হতে না চাইলে কবির তার পেটে একটা লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেয়। দরজার বাহিরে পড়ে রাবেয়া অজ্ঞান হয়ে যায়। সাথে সাথে ব্লিডিংও শুরু হয়।


বৃষ্টির পানি আর রাবেয়ার রক্ত সেদিন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কবির রাবেয়ার এই অবস্থা থেকে সেদিন পালিয়ে যায়। কবির ভেবেছিলো রাবেয়া হয়তো মারা গেছে বা যাবে।
রাবেয়ার মা সেদিন লুকিয়ে মেয়েকে দেখতে গিয়ে দেখে মেয়ে তার ঘরের সামনে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তিনি পাগলের মতো তখন চিৎকার করতে থাকেন। ড্রাইভারের সহায়তায় মেয়েকে তাড়াতাড়ি তিনি হাসপাতালে নিয়ে যান। ভাগ্যক্রমে সেদিন রাবেয়া বেঁচে গিয়েছিলো কিন্তু মা হওয়ার ক্ষমতা চিরদিনের জন্য হারিয়েছিলো।


‘একি! তুমি আমার চিংড়ির বড়ার একই হাল করেছো, রাবু? মনটা আজকে কোথায় তোমার, হ্যাঁ ? পুড়ে গেলো তো সব’ রফিক সাহেব রান্নাঘরে এসে তাড়া দিলো রাবেয়াকে।
‘ওহ! সরি সরি! এখনই তুলে দিচ্ছি। পরেরবার আর এমন হবে না। তুমি ফ্রেস হয়ে বসো। আমি নিয়ে আসছি। ‘ রাবেয়া বললো


‘তাড়াতাড়ি আসো। ছোটবেলায় একবার পালং শাকের বড়া নিয়ে বড় ভাইয়ার সাথে কি যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেই গল্প শুনাবো আজকে তোমায়। ‘ রফিক সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন।


‘এই বড়া ছাড়া তোমার জীবনে আর কোন গল্প নেই গো?’

‘বড়া’ই জীবন আর জীবনই বড়া। সবার জীবন নানান রঙে সাজানো আর আমার জীবন হরেক রকম বড়া’র গল্পে ভরপুর ‘


রফিক সাহেব আর রাবেয়া দম্পতির প্রতিটি দিন এভাবে হরেক রকম বড়া বানাতে আর গল্প গল্প করতে করতে কেটে যাচ্ছে। সুখেই দিন কাটাচ্ছেন তারা।

-Farjana Akter

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
3
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Farjana Akter
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!