অনেকদিন পর আজ বাড়ি যাচ্ছে রাকিব। রাকিবের বাড়ি চট্টগ্রাম। পড়াশোনার সূত্রে গত কয়েকবছর ধরে ঢাকায় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা এসব মিলিয়ে অনেকদিন বাড়িতে যাওয়া হয়নি। গতকাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই ভাবলো, “আর নয়!! এবার বাড়ি যেতেই হবে।” তখনই বাস কাউন্টারে গিয়ে পরদিনের জন্য টিকিট কেটে রাখলো। কাল খুব ভোরে বাস ছাড়বে। সবকিছু গুছিয়ে তাই তাড়াতাড়ি সে ঘুমিয়ে পড়লো। মনে তখন তার একরাশ ফূর্তি। অনেকদিন পর বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে দেখা হবে।
ভোরে মোবাইলের এলার্মে ঘুম ভাঙলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘুম ভাঙতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। বাস ছাড়তে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। তাড়াতাড়ি ওযু করে ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামায আদায় করে নিলো। হাতে সময় বেশি নেই। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। ব্যাগ নিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে পড়লো।
এতো সকালে রিকশা পাওয়া একটু ঝামেলার কাজ। তবে ঢাকা শহরে অবশ্য সারারাতই কিছু রিকশা চলে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একটা রিকশা পেলো। দামাদামি করে আল্লাহর নাম নিয়ে রিকশায় উঠে বসলো। তাকে যেতে হবে সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডে।
রিকশার চালক একটু মধ্যবয়স্ক মানুষ। মাথায় বাবরি স্টাইলের চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চুল-দাঁড়িতে পাক ধরেছে। বয়স ৪০-৪৫ হবে সম্ভবত।
চালক একটু ধীরে সুস্থেই রিকশা চালাচ্ছিলেন। রাকিবের কিছুটা বিরক্ত লাগছে। তার বাস ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। রাকিব চালককে তাড়া দিলো। বললো, “মামা, একটু তাড়াতাড়ি যান। বাস মিস কইরা ফেলমু তো!!” তাড়া দেয়াতে কাজ হলো। রিকশার গতি বাড়লো।
রিকশা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে এসে থামলো। বাস প্রায় ছেড়ে যাচ্ছিলো। রাকিব তাড়াতাড়ি রিকশাভাড়া পরিশোধ করে বাসে উঠে বসলো। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো। আর একটু হলেই বাস মিস করতো।
বাস ছাড়লো। ফাস্ট ট্রিপের বাস। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। অল্প কিছু দূরপাল্লার বাস আর কিছু প্রাইভেট কার ছাড়া আর তেমন কিছু নেই রাস্তায়।
শীত এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। চারপাশে হালকা কুয়াশার আস্তরণ। সূর্য উঠছে। কুয়াশার উপর সূর্যের আলো পড়ে বেশ সুন্দর একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।
বাস শহর ছেড়ে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হবে। হাইওয়ের চারপাশে এখন দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ। প্রকৃতির এ অনাবিল সৌন্দর্যে রাকিবের চোখ জুড়িয়ে গেলো।
রাকিবের সিটটি বাসের মাঝ বরাবর, ঠিক জানালার পাশে। রাকিব জানালা খুলে দিলো। হালকা শীতল বাতাসে তার দেহ জুড়িয়ে যাচ্ছে। সে বাসে উঠলে জানালার পাশের সিটে বসতে পছন্দ করে। চলমান বাসের জানালার পাশে বসে শীতল বাতাসের পরশ নিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে সে বেশ পছন্দ করে। শীতল বাতাসে আস্তে আস্তে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে দেখলো আরেকটা বাসের সাথে তাদের বাসের প্রবল সংঘর্ষ হয়েছে। তার মাথা সিটের সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলো। এরপর আর তার কিছু মনে নেই।
প্রচন্ড ব্যাথায় রাকিব জ্ঞান ফিরে পেলো। চোখ খুলে সে দেখে চারদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার শরীরের মধ্যভাগে প্রচন্ড ব্যাথা। মনে হচ্ছে কে যেনো শরীর থেকে খাবলা দিয়ে মাংস তুলে নিচ্ছে। তাকিয়ে দেখলো বাসের সিট ভেঙ্গে ভাঙ্গা কাঠামো তার পাঁজরে প্রবেশ করেছে। সে বুঝতে পারলো আর বেশিক্ষণ সে বাঁচবে না।
এ শেষ মুহূর্তে তার চোখের সামনে তার অতি প্রিয়জন বাবা-মায়ের চেহারা ভেসে উঠলো। তার মনে হলো, নাহ, শেষ কাজটা তো বাকি রয়ে গেলো। প্রচন্ড কষ্ট করে সে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। ওপাশে রিং হচ্ছে। এদিকে প্রচন্ড কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছে।
তার বাবা ফোন ধরলেন। রাকিব প্রচন্ড কষ্ট সহকারে বললো, “বাবা, ফোন লাউড স্পীকারে দাও, মাকে ডাকো, আর আমাকে কথা শেষ করতে দিও, মাঝখানে কথা বোলো না, আমার হাতে সময় নেই”। তার কণ্ঠস্বরেই তার বাবা বুঝলেন, বিশাল কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। উনি কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রাকিবের মাকে ডেকে আনলেন আর ফোন লাউডস্পিকারে দিলেন।
রাকিব বলা শুরু করলো, ” বাবা-মা, পৃথিবীতে প্রথম এসে তোমাদের মুখ দেখেছিলাম। তোমাদের হাত ধরেই পৃথিবীকে চিনতে শিখেছি। তোমরা আমাকে হাটতে শিখিয়েছো, পড়তে শিখিয়েছো, ভালো-মন্দের পার্থক্য শিখিয়েছো। সারাটাজীবন আমার জন্য উৎসর্গ করলে। সারাজীবন আমার সাথে ছিলে। কিন্তু আজ আমি এমন এক পথে যাচ্ছি, যে পথে আমাকে একাই যেতে হবে। এ পথে তোমরা চাইলেও আমার সংগী হতে পারবে না। এ পথ আমার একার, এ রাস্তায় আমার কোনো সংগী নেই।” ফোনের ওপাশে কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।
শেষমুহুর্ত চলে এসেছে। রাকিবের নিঃশ্বাস জড়িয়ে আসছে। সে বুঝতে পারলো, আর বেশীক্ষণ নেই। যেকোনো সময় প্রাণপাখীটা উড়াল দিবে। শেষ কথায় সে বললো, ” জানো বাবা, জানো মা, একটা কথা অনেকদিন ধরেই বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। আজ বলছি। ভালোবাসি মা, ভালোবাসি বাবা। তোমরা ভালো থেকো।”
ফোনটা ধপ করে হাত থেকে পড়ে গেলো। রাকিবের চোখ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেলো। ফোনের ওপাশ থেকে তীব্র কান্নার শব্দ ভেসে আসছে আর হ্যালো, হ্যালো শোনা যাচ্ছে। আর এদিকে রাকিব চিরজীবনের জন্য প্রশান্তির ঘুমে ঢলে পড়েছে। তার মুখে প্রশান্তির হাসি। জীবনের শেষ সময়টা সে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর সাথে কাটাতে পেরেছে।
~~~ মুহম্মদ সাদিক ( Muhammad Sadik )
Send private message to author



