একদিন অরণ্যে ঠিক দক্ষিণ প্রান্তে একটা বড় গাছে বাসা বেঁধেছিল এক জোড়া টিয়া পাখি, একটি সবুজ টিয়া আরেকটি অরন্যের পশ্চিম দিক থেকে আসা সাদাটিয়া। ভিন্ন রঙের টিয়া দম্পতির নীড়ে এল টুকটুকে তিনটি ডিম এবং যথারীতি তিনটে ফুটফুটে বাচ্চা । একটি ভাই, দুইটি বোন, বোনদের একটি পাখি আবার বাবার মত সাদা । বাবা পাখি আর মা পাখির আদরে ওরা ভালই বেড়ে উঠছিল । পাখি তিনটির ছিল খুব ভাব ।
ভালই কাটছিল সময়। কিন্তু হঠাৎই সাদা পাখিটি হারিয়ে গেল অজানায়। স্বগোত্রে চলে গেল নাকি পরপারে – সেটি অজানা। নিঃসঙ্গ সবুজ মা টিয়াটি একাই তার তিনটি সন্তানকে ঐক্য আর সম্প্রীতি শিক্ষা দিয়ে গেল, জীবন চলতে শিখালো। ছানা তিনটি খুব সুন্দর বেড়ে উঠছিল ।সবসময় পাখায় পাখা মিলিয়ে বড় হতে থাকলো, শিকার শিখলো, উড়তে শিখলো, গাইতে শিখলো। নিজেদের রঙের পার্থক্য থাকলেও আদর্শ আর মনুষ্যত্বে কোনো পার্থক্য থাকলোনা। মানবকুলে হয় মনুষ্যত্ব বা মানবতা সে মানুষ হোক অথবা অমানুষ। কিন্তু পাখিকুলের এই বিষয়টাকে কি বলা হয়? “পক্ষিত্ব” !! কোন মনীষী এর নাম দিয়েছে কিনা কে জানে !
জীবন চলছে জীবনের গতিতে। “জন্মিলে মরিতে হইবে”; মা পাখিটা তিনটি ছানাকে রেখে পরকালে চলে গেল একদিন ।এখন ছানা তিনটি নিজেদের আগলে রাখে পরম মমতায়, নিজেদের পাখা ছড়িয়ে দিয়ে উষ্ণতা নেয়, অনুভব করে মায়ের ভালবাসা কিংবা বাবার গন্ধ. ভাগাভগি করে নেয় জীবনের প্রতিটি প্রাপ্তি সুখ আর অপ্রাপ্তির বেদনা। ঝাঁকে ঝাঁকে অরণ্যের অন্য পাখিগুলো আসে , কত কি যে বলে, কখনো প্রশংসা, কখনো ইর্ষা, কখনোবা বলে – সাদা পাখিটি নাকি একদিন ঠিক চলে যাবে সাদা জাতিগোষ্ঠীতে। যে যাই বলুক, পাখিতিনটি ঐক্যে অবিচল। কত ঝড় -বৃষ্টি -খরা – দুর্দশা এল আর গেল, ভ্রাত্বৃত্ব অটুট রইল। দিন গেল, মাস গেল , বছর গেল, পাখি তিনটিও বড় হল, ডিম পাড়ার সময় হল, তারা বাসা বাঁধল নিজেদের। পাখিতিনটির বর্ধিত সংসারে এলো তিনটি করে ছানা। সাদা টিয়ার তিনটি সাদা ছানা, সবুজ টিয়ার তিনটি করে সবুজ ছানা, পাখিদের ভালবাসা তো ভাঙলোইনা বড়ং নয়গুন বৃদ্ধি পেল। জীবনে যেন এলো নতুন ছন্দ; আনন্দ, কিন্তু পুরাতন ও রইল অবিচল। তাই ছানাপুনাদের যত্ন শেষে ভাইবোন ঠিকই মিলিত হয় নিয়ম করে। আদি নীড়ে এসে কত গল্প, গান আর স্মৃতিচারণ। কথার শেষ নেই, কমতি নেই ভালবাসার লেনদেন।
কিন্তু একদিন পশ্চিমের স্বেতটিয়া গোত্রের গৌত্রপ্রধান এসে জানিয়ে দিল সাদা ছানাদের দক্ষিনে থাকা চলবেনা, কোনভাবেই বোঝানো গেলোনা তাদের, পাখিরা আবার দলপতির অবাধ্য হয়না, অগত্যা নিরুপায় সাদা পাখিটাকে তার সাদা ছানাদের নিয়ে পাড়ি জমাতে হলো পশ্চিমে। কিন্তু ভাই বোনের সিদ্ধান্ত হলো অরণ্যের দক্ষিন- পশ্চিম সীমানার একটি গাছে তারা মিলিত হবে আগেরই মতন, যেই কথা- সেই কাজ। দূরত্ব বাঁধ সাধতে পারলোনা ভাই- বোনের অটুট বন্ধনে। কিন্তু হঠাৎই হলো ছন্দপতন, সাদা টিয়াটি এলোনা, খবর পাঠাল আজ সে ক্লান্ত। খুব কষ্ট পেল ভাই বোন, কিন্তু তারাতো পশ্চিমে যেতে পারবেনা, অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি? বেশকিছুদিন অপেক্ষার পর সাদা বোনটির দেখা মিললো, সত্যিই খুব মলিন দেখাচ্ছে তাকে, আগের মতো শুভ্রতা আর নেই। সবুজ পাখি দুটি তাকে দেখা মাত্র কাছে ডাকল, কিন্তু সাদা পাখিটি পাতার আড়ালে সরে গেল।
” কি হলো বোন, কাছে আয়, আসুখ করেছে? আয় উষ্ণতা দেব, ডানা ঝাপটে আরাম দেব তোকে, আমাদের শরীর থেকে খুলে কিছু পালক দেব, মায়ের আদর দেব, তোর থেকে বাবার গন্ধ নেব, কাছে আয় আমার, তোকে একটু ছুঁয়ে দেই” ভাই বোন যতো ডাকে, সাদা পাখিটি ততো আড়াল করে নিজেকে। কারণ তাদের চোখে সে আগের মতো সাদা শুভ্র প্রাণচঞ্চল আদরের বোনটি হয়ে থাকতে চায়, সে জানে সবুজ ভাইবোনের তার এই রুগ্ন দশা সহ্য হবেনা, দূরে থেকেও তাদের হৃদস্পন্দন ঠিকই শুনতে পায় সে। ভাইবোনের লুকোচুড়ির চেষ্টা । এই গগন ফাঁটানো কাতরতা আর ভুবন কাঁপানো আর্তোনাদে হয়তো এত বড় অরণ্যের কিছু এসে যায় না, কেউ হয়তো খবর ও পায়না কি হচ্ছে ছোট্ট তিনটি পাখির জীবনে।
কে বুঝবে তাদের সেই আকুলতা? এক সাথে বেড়ে ওঠা বর্ণিল শৈশব কৈশরের কত স্মৃতি, এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, এত ভালবাসা, এত আস্থা, নির্ভরতা। কোথায় মিলবে এর বিকল্প ? এমন আকুলতাকি শুধু পাখিদের ই হয়? নাকি মানব জীবনেও আছে ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি এমন আকুলতা কিছুটা বুঝে নিয়েই লিখেছিলেন – “দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে বোঝাতে নারে আপনায়- দুজনে একা একা ঝাপটি মারে পাখা কাতরে ডাকে কাছে আয়”
অসুস্থ সাদা পাখিটি কাছে এলো কিনা কেউ জানে না, গল্পের শেষটায় কি হয়াছিলো সেটাও কেউ জানতে চায় না, ভাবতেও চায়না। নাহয় মহাকালের অতলে অজানায় হাড়িয়ে যাক তাদের শেষ পরিণতি, অন্য সব জীবনের গল্পগুলোর মতন। শুধু ইতিহাস হয়ে থাক ভ্রাতৃত্বের সেই অনন্য সাধারণ উপমাটি, শিক্ষনীয় হয়ে থাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য।
– Nazia Ashraf
Send private message to author






