‘মা! আমারে একটা বড় পতাকা কিন্না দিবা ? লগে ইয়া বড় একটা বাঁশ। কয়ডা ফুল। ‘
‘এতো কিছু দিয়া কি করবা বাজান ?’
‘পরথমে বাঁশের মাতায় পতাকা শক্ত কইরা বানমু। উডানে একটা বড় গর্ত কইরা বাঁশটা সেখানে লাগামু। বাঁশের গোড়ায় ফুল কয়ডা রাখমু। বাঁশের আগায় পতাকাটা যহন বাতাসে উড়বো তখন আমি আর আমার বন্ধুরা স্যালুট দিমু। ‘
‘এটা কেন করন লাগবো বাপ ?’
‘এমন কইরা বিজয় দিবস পালন করতে হয় মা। ‘
রাহেলা বেগম গালে একটা হাত দিয়ে মুখটা সামান্য হা করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। এইটুকু তার ছেলেটা কত সুন্দর করে তার পরিকল্পনার কথা সাজিয়ে বললো। রাহেলা বেগম মানুষের বাড়িতে কাজ করে আর তার স্বামী রিক্সা চালায়। তাদের এই একটি মাত্রই ছেলে। বাড়ির পাশে প্রাইমারি স্কুলে গতবছর ভর্তি করে দিয়েছেন। কিন্তু ছেলে একদিনও স্কুলে যায় নি। স্কুলে গেলেই কান্নাকাটি শুরু করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। স্কুলের পাশে একটা মাঠ আছে। সেখানে তার ছেলে খেলতে যায়।
মাঠে খেলতে খেলতে মাঠের একদম কোলঘেঁষে যে ক্লাসরুম আছে সেখানে যা পড়ানো হয় সেসব শুনে শুনে সব তার মুখস্ত। বাড়িতে এসে বাবা মাকে আবার সেই গল্প শোনায় রায়হান। স্কুল তার ভালো লাগে না, তবে এটা সেটা জানতে তার খুব ভালো লাগে।
‘ও রায়হানের বাপ! শুনছো নি তোমার পোলা কি কয় ? ‘
‘পোলা আমার কি কয় ?’
‘ওরে নাকি একটা বড় বাঁশ, পতাকা আর কয়ডা ফুল কিন্না দেওন লাগবো।বিজয় দিবস পালন করবো। ‘
‘ও বাপ! বিজয় দিবস কেন পালন করতে হইবো ?’
‘আব্বা! তুমি এইডাও জানো না ?’
‘না বাপ! তুমি একটু কও তো। ‘
‘মেলা বছর আগে আমাগো এই দেশের লগে আরেকটা দেশের যুদ্ধ লাগছিলো। তারা আমাগো দেশ নিয়া যাইতে চাইছিলো। কিন্তু আমাগো দেশের মানুষ রাজি আছিলো না। তহন তারা আমাগো দেশ নেওয়ার লাইগ্যা যুদ্ধ করে, আর আমাগো দেশের মানুষ না দেওয়ার লাইগ্যা যুদ্ধ করে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট এবং নয় মাস ধরে এই যুদ্ধ হইছে। এরফর কারা জিতছে জানো ?’
‘কারা বাপ ?’
রায়হান দুই হাত উপরে তুলে একটা হাসি দিয়ে বলে ,’আমাগো দেশের মানুষেরা।’
‘যেদিন আমরা বিজয় লাভ করছি হেইডাই আমাগো বিজয় দিবস ?’
‘হ আব্বা! তুমি জানো যুদ্ধের সময় কি কি অইছিলো ?’
‘তুমি কও! তোমার কাছ থ্যাইকাই শুনমু। ‘
‘যারা আমাগো দেশ নিতে চাইছিলো তারা আমাদের দেশের মানুষরে গুলি কইরা মারছে। বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগায় দিছে। অনেক মানুষরে খাইতে দেয় না। অনেক কষ্ট দিছে আমাগো দেশের মানুষরে। এই কতা শুনলে আমার কান্না আসে আব্বা। ‘
রায়হানের মা এগিয়ে এসে ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। এইটুকুন তার ছেলে যুদ্ধের সময়ে মানুষের কষ্টের কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে কান্না আসে তার। তার ছেলে যুদ্ধের কথা জানলো কিভাবে? ঘরে তো তারা এই ব্যাপার নিয়ে কোন কথা বলে না। গরীবের সংসার। চাল, নুনের হিসাব করতে দিন যায়। যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করবে কখন!
‘বাপ! তুমি এতকিছু জানলা কেমনে ?’
‘খালেক মামার কাছে। ‘
‘খালেক মামা কে ?’
‘যে মাডে আমরা খেলতে যাই। খালেক মামা ঐখানে আইসক্রিম বেঁচে। আমাগোরে অনেক গল্প কয়। মামা অনেক বুড়া। আইসক্রিমের লগে অহন পতাকাও বেঁচে। হেইদিন আমাগোরে পতাকার গল্প কইলো, যুদ্ধের গল্প কইলো। যুদ্ধের গল্প শোনার পর আমার চোখে পানি আইছিলো মা। আমার অনেক দুঃখ অইছে। ‘
‘আচ্ছা বাপ! আর দুঃখ পাইয়ো না।’
‘হ আব্বা! যারা কষ্ট কইরা আমাগো দেশ রক্ষা করলো তাদের স্যালুট জানাতে হবে না ?’
‘হ বাপ! তাগোরে অনেক ভালোবাসতে অইবো, দোয়া করতে অইবো। তয় খালি বিজয় দিবস পালন করলে অইবো না বাপ! কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া দেশকে অনেক যত্ন করতে হইবো কিন্তু! ‘
‘আমি বড় হইয়া স্কুলের স্যার হমু। সকলকে যুদ্ধ সম্পর্কে জানামু। দেশকে ভালোবাসতে কমু। স্যার না হইলে তো কেউ কারো কতা শুনে না। আমি বড় হইয়া স্যার হমু আব্বা! ‘
‘চল বাপ! বাজারে যাই। কত্ত বড় বাঁশ আর পতাকা লাগবো সব কিন্না দিমু। আমি হইলাম ভবিষৎ স্যারের বাপ। আমার বাড়িতে উড়বো বাজারের সবথেকে বড় পতাকা। ‘
‘খাইয়া যাও! রান্ধা তো শেষ। ‘
‘আমাগো পোলা কেমন জ্ঞানী জ্ঞানী কতা কইলো দেখলা ? জ্ঞানী মানুষ দুইডা জিনিস চাইছে আগে কিন্না দেই। তারপর আইয়া খামু। রাহেলা বেগম আমাগো পোলা অনেক বড় হইবো। আমরা এতো বড় হইয়াও যা জানি না আমাগো পোলা তা জানে। আমাগো পোলা এই দেশের দামি রত্ন হইবো ইনশাল্লাহ তুমি দেইখো। ‘
রায়হান পতাকা কেনার আনন্দে ভাসছে। তার বাবা মায়ের চোখ যে আনন্দের অশ্রুতে ভাসছে সেটা সে খেয়াল করে নি।
– Farjana Akter
Send private message to author






