বায়োডাটা হাতে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে মায়ের সাথে চেচামেচি করেছি। আব্বুর সাথে করার সাহস পাচ্ছিনা।
আব্বু : পড়ে দেখ কি কি সমস্যা আছে,বল।
: আম্মু বলেছে আমাকে প্রেমের বয়স হলে বলবে। আমি প্রেম করে বিয়ে করবো। আগেই বিয়ে ঠিক করছ কেন?
:তাতে সমস্যা কই?ছেলে কাবিন করে জাহাজে চলে যাবে। চিঠি লিখবে,ফোন করবে, ওটাই প্রেম। হালার প্রেম। এছাড়া ছেলে সৎ সচ্ছল। খালি ভাই নাই,ভাই নাই বলিস,দেখ ছেলের ছোট বড় মেজ সেজ সবরকম ভাই আছে।
আরো কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর ঠিক হলো আগে দেখাদেখি হোক।খুব ভালো না লাগলে বাতিল। যথাসময়ে ছেলে দেখা হলো। আবার মিটিং।
আব্বু : দেখেছিস ছেলে দেখলেই বোঝা যায় মনটা কত ভাল, দেখতেও সুন্দর।জামাই তো আর অর্ডার দিয়ে পাবি না, কিছু উনিশ বিশ তো থাকবে।সেটা মেনে নিতেই হবে।
আম্মু :এই ছেলে আমাকে মা বলবে আর কি চাই।
বোন : হ্যাঁ আপু সবাইকে দেখানোর মত একটা দুলাভাই হবে।
আমার ভ্যান ভ্যান ঘ্যানঘেন কোন পাত্তাই পেল না। অবশেষে বিয়ে।
বিয়ের পরের দিন ঘুম থেকে উঠে অবাক।
জামাই-শ্বশুর লুঙ্গি পড়ে চা খাচ্ছে আর এমনভাবে গল্প করছে যেন অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। আমাদের বাড়িতে জামাইয়ের বাজার করার একটা রেওয়াজ আছে। তো পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন ফোন করে জানতে চাচ্ছে জামাই কি কি বাজার করলো।
আব্বু : কি বলিস !আমার রাজপুত্র জামাই বিদেশ থাকে সারাবছর।ও যাবে ময়লা বাজারে।খবরদার কেউ ওকে বাজার করতে বলবি না।
প্রথমে ভেবেছিলাম আব্বু মানা করেছে দেখে বাজারে যায় নাই। পরে জানলাম,সে এইসব রীতিরেওয়াজ কিছুই জানেইনা।যা আববু ঠিকই বুঝতে পেরেছে। যখনই কোনো রীতি রেওয়াজের ব্যাপার আসছে আব্বু সবরকম ব্যাকআপ দিয়ে রেখেছে, যেনো জামাইকে লজ্জায় না পরতে হয়।
শুরু হয়ে গেল আমাদের বাসায় রাজপুত্র জামাইয়ের একচ্ছত্র প্রভাব। রান্না হয় জামাই যা খায়।পিঠা মিষ্টি আচার সব জামাইয়ের টেস্ট মত। আমরা দুই বোন এক ধাক্কায় বাসায় পর হয়ে গেলাম।
এমনকি আব্বুকে দিয়ে কোন কিছু করতে তার জামাইকে ব্যবহার শুরু হয়ে গেল।আমাদের বাসায় সাদাকালো টিভি। জামাই নিশ্চয়ই সাদাকালো টিভি দেখে মজা হয়তো পায় না। এমন একটা কথা হালকা করে আববুর কানে দিলাম। ব্যাস আব্বু জামাইকে নিয়ে তার পছন্দসই রঙিন টিভি কিনে আনল। কিন্তু কিসের জামাই রিমোট পায়, রঙিন টিভি আমাদের দু বোনের দখলে। জামাই শশুর একসাথে খবর দেখে।
আববু :দেখেছিস আমার বেটা রঙিন টিভি না, আমার সাথে খবর দেখে মজা পায়।
যা খুশি ভাবো আমাদের কাজটা হয়ে গেছে।তবে আশেপাশে মানুষের কাছে এও শুনতে হয়েছে জামাই এসেই সারল না জামাইকে ভাঙ্গিয়ে নতুন নতুন জিনিস কেনা শুরু হয়েছে। তাতে আমাদের কি আসে যায়। আমরা ফালতু কথা পাত্তা দেইনা।
চেনা-পরিচিত কিছু মানুষ এসে বলে : স্যার শুনলাম,আপনার নাকি একটা রাজপুত্রের মতো জামাই আছে? দেখান স্যার,চোখ ধন্য করি।
:আরে আমার বেটা তো এখন দেশে নাই, ছবি দেখো।
: মাশাল্লাহ এতো চাঁদের টুকরা। আপনার ভাগ্য বলতে হবে স্যার। জীবনেও এমন জামাই দেখি নাই।
আব্বুর খুশি দেখে কে। ব্যাস, কারো বদলি,কারো ছুটি, যার যা চাই আদায় হয়ে গেল।
কোন একদিন বিকালে আম্মু ভালো-মন্দ খাবার বা পিঠা করেছে। আম্মু চাচ্ছে আমরা সবাই মিলে একসাথে খাব। বারান্দায় বসে আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। আম্মু : তোমার শশুরকে বলেছি তোমার শরীর ভালো লাগছেনা। সে তারাতাড়ি বাসায় আসছে আর তুমি এখানে বসে? যাও যাও বিছানায় শুয়ে পরো।
জামাইও একদৌড় দিয়ে বিছানায় কাথামুড়ি।আব্বু ঘরে ঢুকে জামাইয়ের কপালে হাত দিয়ে, চেহারা দেখেই বুঝে গেল।
: কিরে বেটা। শাশুড়ির পক্ষ হয়ে আমার সাথে বিটলামি?
:না মানে বাবা তখন বোধহয় শরীর ভালো ছিল না। (জামাই আবার মিথ্যা বলতে বিশেষ অপারদর্শী)।
জামাই দেশে না থাকলে আব্বুকে আমরা চাপে রাখি। সবাই এক দলে,আব্বু একা।আমাদের খালি হুমকি দেয় :আসুক আমার বেটা,তোদের দেখে নিবো।তার ঢাল তরোয়াল সব তার জামাই।
জামাই আসে, আব্বুর বুকে ঝাঁপিয়ে পরে।আব্বু এক গালে চুমু দিলে আরেক গাল পেতে দেয়। আমরা দুবোন অসহায় ভাবে দেখি আমার বাবার বুকটা কেমন বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
আমি কোনদিন তার জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করে শান্তি পাইনা।রাগ করলে শশুর কথা বন্ধ করে দেয়।কোনদিন রাগ করে আমি বাপের বাড়ি যাব কি,তার আগেই জামাই শ্বশুর বাড়ি যেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।আর এদিকে আব্বু ফোন করে আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে।আবার আব্বুর সাথে রাগ করলে জামাই কথা বন্ধ করে দেয়। মহামুসিবত।
শশুরের আহ্লাদে জামাই কোন কাজ করতে চায় না।একদিন মাছের বাজার করতে পাঠিয়ে ভাবলাম মার সাথে ফোনে কথা বলি।ওমা ফোন ধরেছে আব্বুর জামাই।
:কি ব্যাপার তুমি ওখানে কেন?
:না ভাবলাম বাজারে যাওয়ার আগে এক কাপ চা খেয়ে যাই।আর বাবা বললেন আমি মাছ কিনতে পারব না।তাই বাবাই বাজারে গেছেন।
:তোমার লজ্জা করে না,এতো বড় দামরা জামাই শশুর কে দিয়ে বাজার করাও।
না তার কোন লজ্জা নাই। যেকোনো সমস্যা,যেকোনো কাজ প্রথমেই বলবে : দেখি বাবা কি বলেন।বলেই বাবাকে ফোন। ওদিকে আব্বু :আরে বেটা,এই রোদের মধ্যে বের হইও না।লোক পাঠাচ্ছি তোমার কাজ হয়ে যাবে।জামাই নিশ্চিন্তে পেপার নিয়ে বসে।আমার রাগে গা জ্বলে যায়।আব্বু খালি বলে : আহারে ছেলেটা কতোদিন পর দেশে আসে, একটু আরাম করে। তুই এমন করিস কেন? আব্বু বরাবরই লজ্জিত থাকে তার এমন রাজপুত্র জামাইয়ের এমন দর্জ্জাল বউ হয়েছে।
আব্বু মানসিকভাবে পুরোপুরিই জামাই নির্ভর হয়ে গেলো।তার জীবনের এ টু জেড, সবই জামাই জানে।যা আমরাও জানি না।তার ধারনা তার জামাই জানেনা পৃথিবীতে এমন কিছু নেই।তাই জামাই যা বলে সেটাই একদম ঠিক।
আব্বুকে আমি অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছি
: শুধু সুন্দর বলেই কি তুমি জামাইকে এত ভালোবাসো?
আব্বু হাসে : নারে মা।ওর চেহারা শুধু চোখের শান্তি কিন্তু ওর মনটা আমার মনের শান্তি।ওর নাম শুধু সাগর না ওর মনটাও সাগর,যেখানে কচুরিপানা জমে না। এমন নীতিবান,নিরহংকার ছেলে আর কোথাও দেখেছিস? তার কাছে কি আমি হাতি ঘোড়া চাই? তুই কোনদিন খেয়াল করেছিস আমি তোর বাসা থেকে আসার সময় যখন জুতা পরি, ও জুতাটা আগিয়ে দেয়। যদি পড়ে যাই এই ভয়ে সে পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি নিচে নামাতে মানা করি তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে আমি ঠিকমত রাস্তা পার হচ্ছি কিনা,রিকশায় উঠেছে কিনা। আমার জামাই আমাকে লোক দেখানো ভালোবাসে না মন থেকে ভালবাসে। আর কি চাই মা?
আমিও পরে খেয়াল করে দেখেছি ঠিকই তো।কিন্তু নিচে থেকে পাঁচতলায় কে দাঁড়িয়ে আছে তাতো আব্বুর দেখার কথা না। আব্বু টের পায় কিভাবে?
ওদিকে আমি আব্বুর জামাইকে জিজ্ঞাসা করেছি
:তুমি আব্বুকে এত পছন্দ করো কেন? তোমাকে আদর করে বলে?
:আদর তো আরো অনেকেই করে। কিন্তু আমি বাবার মত এত ভালো মনের মানুষ দেখিনি। মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতা বাবার গড গিফটেড। এত নিঃস্বার্থ, এত ক্ষমাশীল, মানুষ হয় কি করে?
এদের জামাই-শশুরের লোকদেখানো কোন ফরমালিটি নেই।এরা একে অপরের অন্তরে অন্তরে প্রবেশ করতে পারে।
জামাই দেশে না থাকলে তার প্রিয় খাবারগুলো আব্বু খেতে পারে না। আমার বেটা আসুক একসাথে খাব।জামাই ফোন করলে কানে শুনেনা ঠিকমত। এই দুঃখে ফোন রেখে কাঁদে।
আমিও তার জামাইকে বলেছি :আববু তো ফোনে ঠিকমত শুনতে পায় না।কষ্ট পায়। তুমি ফোন কেন করো?
: আমি তো শুনি।বাবা যে আমাকে ডাকেন, মিস করেন,তা বুঝি,সেটা শুনতে ফোন করি।
আমরা দুবোন আববুর বিপক্ষে অনেক গিয়েছি। কিন্তু তার জামাই কোনদিনও না। বরং আমাদের বকেছে কেনো আববুর কথা শুনি না। তার শশুরের নামে কেউ কিছু বললে তার রাগ লাগে।
বিয়ের সতেরো বছর পর এবার সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমালাম। মানুষ মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দেয়।আমার বাবা জামাইকে আমার হাতে তুলে দিলো
: মারে,আমার জামাইকে যত্নে রাখিস।মনে রাখিস ওকে কষ্ট দিলে সে কষ্ট আমার বুকে লাগে।
বিদেশে কাজের চাপে আব্বুর সাথে অত কথা হয়না। কিন্তু জামাই শশুর প্রায় প্রতিদিন ভিডিও কলে গুটুর গুটুর করে।দেশের আলোচনা করে।
এখানে এসেও নিস্তার নাই। জামাইকে কিছু বললে সে শুধু ফোন করে মিনমিন করে বাবার সাথে কথা বলে। ব্যাস বাবা বুঝে যায় তার জামাইয়ের উপর নাজানি কি অত্যাচার হচ্ছে। এরপর আমাকে ফোন দিয়ে তুলাধুনা।
আমরা চলে আসার পর থেকেই আব্বু শুকিয়ে যাচ্ছে।আম্মু বলে কিছুই খেতে চায় না।শরীরও ভালো থাকে না। নয় মাস পর সকাল বেলা চাচাত ভাইয়ের ফোন।আব্বু ICU তে। আগের রাতেই জামাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। ফোন রেখে তার জামাইয়েরও মনটা খারাপ, তার কাছে মনে হয়েছে বাবারকি শরীর খারাপ বেশি? কেমন নিস্তেজভাবে কথা বললেন। সেদিনই টিকিট কিনে বাংলাদেশে রওনা দিলাম। আব্বু তখন লাইফ সাপোর্টে। জামাই যতবারই হসপিটালে রাতে থাকতে চায়,সবার এক কথা : মাথা খারাপ?তোমার শ্বশুর উঠে যদি শুনে তুমি রাত্রে কষ্ট করছ আমাদের জুতা দিয়ে পিটাবে। আব্বু লাইফ সাপোর্টে হসপিটালের চারদিন ছিলেন কিন্তু এক রাতের জন্যও কেউ তাকে হসপিটালে রাতে থাকতে দেয়নি।তবে শেষ মুহূর্তে তার রাজপুত্র জামাই তার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তার ছেলের চেয়েও বেশি জামাই তাকে কবরে শায়িত করেছে।
আব্বু সবসময় সচেষ্ট ছিল যেন তার জামাই কোনভাবেই একটুও যেন কষ্ট না পায়। কিন্তু সেই আব্বুই তার জামাইকে এতটা কষ্ট দিয়ে গেল। আমার কাছেই রেখে গেলো তার কলিজার টুকরো,আহ্লাদের রাজপুত্র জামাই।
যেখানেই থাকো ভালো থাকো বাবা
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইআনি সাগীরা।
– Kazi Suriya Nasrin Surovi
Send private message to author






