আজ আমাদের ভালোবাসার ছয় বছর পূর্তি হলো, না আমরা আজ অন্যান্য কাপল দের মত ঘোরাঘুরি লাঞ্চ ডিনার এসব করছি না কারণ একই সাথে আজ আমি ওর সাথে ব্রেকআপ করছি। হিমিকা, ওর নাম হিমিকা আমি সংক্ষেপে হিমি ডাকি। হিমি ছয় বছর আগেও যা ছিল এখনও তাই আছে আমার প্রতি ওর ভালোবাসা বদলায় নি, খেয়েছি কিনা রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়েছে কিনা ঠিকমতো পড়াশোনা চলছে কিনা ক্লাসে ঠিকমত এটেন্ড করছি কিনা সেই আগের মত ও জিজ্ঞেস করতে থাকে ওর প্রশ্ন যেন শেষই হয়না। সপ্তাহে অন্তত একদিন দেখা না করলে মন খারাপ করে, এখনো হাওয়াই মিঠাই কিংবা আইসক্রিম দেখলে দৌড়ে যায়, বৃষ্টি এলে ওর ভেজা চাইই চাই। ওর এসব ছোটখাটো পাগলামি দেখেই আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম কিন্তু জানিনা কেন এখন এসব কেমন ন্যাকামি মনে হয়, সবকিছু কেমন যেন হিসেব মতো চলে। এত রুটিন অনুযায়ী জীবন যাপন করতে করতে আমি হাপিয়ে গেছি। তাছাড়া ও আমার অনেক ছোটখাটো ব্যাপারেও ইন্টারফেয়ার করে। বন্ধুদের সাথে বাইক রেস করা যাবে না , সিগারেট খাওয়া যাবে না, দেরি করে বাসায় ফেরা যাবে না আরো নানান ধরনের আবদার। প্রথম প্রথম এই আবদার গুলো ভালো লাগতো, ভালোবাসা মনে হতো। এখন কেন যেন চাপিয়ে দেয়া মনে হয়।
আজ আমাদের প্রেমের ষষ্ঠ অ্যানিভার্সারি, হিমি খুব সেজেগুজে এসেছে, ওকে দেখতে পরীর মত লাগছে। কিন্তু এই পরীর মত মুখ আজকে আমাকে আর আকর্ষিত করছে না। আমি জানি একটু পরে কি ঘটতে যাচ্ছে।
হিমি চুপচাপ সবকিছু শুনল, আমি ঠান্ডা মাথায় সবকিছুই ওকে বললাম, হিমি কাঁদলো না, ঝগড়া করল না শুধু আস্তে করে ভালো থেকো বলে টেবিলে রাখা ওর হ্যান্ড ব্যাগ টা নিয়ে চলে গেল। যাবার সময় একবার পেছন ফিরে তাকালো, ওর মুখটা তখন রক্তশূন্য যেন পুরো পৃথিবী হারিয়ে গেছে, আমি অগ্রাহ্য করলাম, আমার স্বাধীনতা চাই, এই জেলখানা থেকে মুক্তি চাই, সাথে সাথে আবার একটু টেনশনে পড়ে গেলাম ও পরে আবার কোন রিভেঞ্জ নেবে না তো, এতটা নির্বিকারভাবে চলে যায় কিভাবে মানুষ?
না, মাস কেটে গেল হিমি আমার সাথে কিছু করেনি, এমনকি কোনো যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি। একবার এমনিতেই ওর আইডিতে ঢুকতে গিয়েছিলাম দেখলাম আইডিটা ডিঅ্যাক্টিভেট, তাতে আমার কি যায় আসে। আমি যেমন জীবন চেয়েছিলাম ঠিক তেমন পেয়েছি এখন আর কথায় কথায় কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। নিজেকে কেমন মুক্ত পাখির মতো মনে হয়, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
অনেকগুলো বছর কেটে গেল, পড়াশোনা শেষ করে আমি খুব ভালো একটা চাকরি পেয়েছি ,বাবা-মায়ের পছন্দের খুব সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি। নাম দীপা।আমার বউ নিজেও চাকরি করে বলতে গেলে হ্যাপি ফ্যামিলি।
অফিসের কাজ দ্রুত শেষ করে আজ বাসায় আসলাম বউকে সারপ্রাইজ দিব আজকে আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী, কিন্তু বাসায় এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। বাড়ি অন্ধকার মানে ও এখনো বাসায় ফিরেনি, ফোন দিলাম ও খুব তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে দিল বলল ফিরতে দেরী হবে আশ্চর্য ও ভুলেই গেছে আজকের দিনটার কথা। আমি কিছুক্ষণ অন্ধকারেই বসে থাকলাম, আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ কেন জানি বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, এই এক বছরে দীপা কখনো আমার অফিসে ফোন করে জানতে চায়নি আমি লাঞ্চ করেছি কিনা। রাতে ঘুম না এলে বাতি জ্বালালে দীপা বিরক্ত হয়। ও যথেষ্ট ম্যাচিউরড, আইসক্রিম হাওয়াই মিঠাই বৃষ্টিতে ভেজার মত ছেলেমানুষি ওর মাঝে নেই। অনেক বছর পর হঠাৎ করে আমার আবার সেই রক্তশূন্য থমকে যাওয়া হিমির চেহারার কথা মনে পড়লো, আচ্ছা আমি কি সত্যি ওকে ভালবাসতাম, দীপা ফিরল অনেক রাতে বলল ডিনার করে এসেছে, ফ্রেশ হয়ে শুতে গেল।
হঠাৎ আবার হিমির কথা মনে পড়লো আমার, মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলাম, দেখলাম ওর আইডি টা এক্টিভ তবে আমি ওর ফ্রেন্ড লিস্টে নেই আর এখন। প্রোফাইল পিকচারে ওর পাশে খুব হ্যান্ডসাম একজন পুরুষ আর কোলে ছোট্ট একটা পরী, তিনজনের হাসিমাখা মুখ, ছোট্ট পরীর একহাতে একটা বেলুন অন্য হাতে গোলাপি রঙা হাওয়াই মিঠাই। কভার ফটোতে দেখলাম আমার সেই চিরচেনা হিমিকে, লাল রঙের শাড়ি পড়া হিমি সেই ছেলেটির হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে।
আমার কেন যেন খুব কান্না পেল, কেন যেন হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করল, কেন যেন হাওয়াই মিঠাই খেতে ইচ্ছা করলো।
আসলে আমি হিমিকে ছেড়ে দেই নি, ভালোবাসা আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। হিমি আমায় ভালবাসত বলেই আমার কথায় কোনো প্রতিবাদ করেনি তখন, আমার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু নিজের জীবনটাকে নষ্ট করেনি, ভালোবাসাকে ছেড়ে যেতে দেয়নি নিজের জীবন থেকে।
খুব একা লাগছে নিজেকে, বড্ড একা, মনে হচ্ছে হঠাৎ করে পুরো পৃথিবী টা হারিয়ে গেছে, অনেক বছর আগে হয়তো হিমির ঠিক এমনই লেগেছিল, হিমি কাদেনি তখন, কিন্তু আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে, নিস্তব্ধ নিশ্চুপ কান্না।
– Suborna Sharmin Nishi
Send private message to author



