“যাবে?”

দীঘির ঘাটটা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো। এখন বর্ষাকাল। উপচে পড়া পানিতে ঘাটের মাত্র দু’টো ধাপ পানির ওপরে। ঘাট থেকে বেশ দূরে একটা অবয়ব আবছা চোখে পড়ে। খুব সম্ভবত শেষ ধাপের ওপরে দাঁডিয়ে আছে। কাঁধ থেকে বাকিটা পানির নীচেই। হাত দু’টো পানির ওপরে তুলে জলতরঙ্গ তৈরী চেষ্টা করছে। তরঙ্গের মৃদু শব্দটা ঘাট পর্যন্ত এসে পৌঁছায়। কিন্তু একটা অবয়ব ছাড়া তার কিছুই বোঝা যায় না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ আগেই। আজ চাঁদও ওঠে নি। তাছাড়া দীঘির পাড়ের এদিকটায় বড় বড় গাছ। গাছের ডালপালাগুলো বড় হতে হতে দীঘির মধ্যেই অনেকটা ঝুঁকে গেছে। দিনের বেলাটাতেও ঘাটের দিকটা ছায়া থাকে। এই মুহূর্তে সেটা নিকষ অন্ধকারে রূপ নিয়েছে। কাজেই চোখের ব্যবহার করে অবয়বের পরিচয় বা চেহারা জানার একদমই সুযোগ নেই।

ঘাটে বসে অনেকক্ষণ ধরেই একজন অবয়বকে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন। একমাত্র তিনিই পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে অবয়বকে চেনেন। সেই সন্ধ্যার পরপর হতেই বসে আছেন। অবয়ব কখনও চিৎ সাঁতার দিয়ে দীঘির মাঝে চলে যায়। কখনও ঘাটের ওপরে এসে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। কখনও দীর্ঘ ডুব দিয়ে তার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক করে দেয়। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন কথা হয় না। শুধু মৌনতায় একটা সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা। কখনও কখনও মনে হয় জলতরঙ্গের ভাষাতেও কোন বার্তা পৌঁছানো হচ্ছে ঘাটের কাছে।

এমন সময় করে বৃষ্টি নামলো। প্রথমে ঝিরিঝিরি, বড় বড় ঠান্ডা ফোঁটা। ইন্দ্রিয়গুলোকে নাড়া দেবার মত। মুহূর্ত বদলের সাথে সাথে বৃষ্টির তোড়ও বাড়ে। ঝিরঝির থেকে ঝমঝম হয়ে যায়। ঘাটে বসে থাকা মানুষটি ত্রস্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য আঁচল টেনে দেয়। চুল ঢেকে দেয়। অবয়বটা ঘাটের শেষ ধাপ থেকে একেক পা ফেলে উঠে আসতে থাকে। কাঁধ পর্যন্ত ভেজা চুলগুলো চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ে থাকে। ওপরে উঠতে তিন-চার ধাপ বাকী থাকতে দাঁড়িয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে দেয় অভিমানী প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে। আমন্ত্রণ প্রথমে উপেক্ষিত হয়। তবুও বাড়ানো হাতটা সরে না। মনের গহীনে জমে বরফ হওয়া অভিমান হয়তো একটু গলে যায়। নড়েচড়ে বসেন। হাতটা আরেকটু এগিয়ে আসে। যেন বিমুখ হয়ে ফিরবেই না! আর কতবার ফেরানো যায়! মুখ তুলে একটুখানি স্পষ্ট মুখটার দিকে তাকালেন। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কপাল হয়ে গড়িয়ে গাল বেয়ে নীচে নামার সময় কেমন যেন আভা ছড়াচ্ছে। আঙুলের ডগাগুলো রাখলেন তার হাতের তালুতে। বলিষ্ঠ সেই হাত মুঠো করে আঁকড়ে নেয়। পরম অধিকারের ছাপ। 

উঠে খালি পায়ে পানিতে নামলেন। শাড়ির নীচটা ফুলের পাপড়ির মত ছড়িয়ে পড়ছিলো পানিতে। তাকে টেনে নিয়ে আবার ঘাটের মাঝামাঝি চলে গেলো অবয়ব। দু’জনে খুব কাছাকাছি। ওপর থেকে ঝরা বৃষ্টিগুলোকে আশীর্বাদই লাগছে। নইলে অভিমানের বরফ এত সহজে গলতো না। 

তারা এক পা করে নীচে নামে। নামতে নামতে শেষ ধাপে যেয়ে দাঁড়ায়। প্রেয়সীটি কোনক্রমে আঙুলে ভর দিয়ে মুখখানি পানির উপরে রেখেছে। বলিষ্ঠ দেহটা তাকে খুব সাবধানে ধরে রেখেছে। ফিসফিসিয়ে বাক্য শোনা গেলো। 

“যাবে?”

প্রায় খাবি খেতে থাকা সামলিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানায় তরুণী। আঁচল পানিতে ভেসে অনেকখানি পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। ঘাটের শেষ ধাপকে বিদায় জানিয়ে সামনে এগোতেই টুপ করে ডুবে গেলো দু’জনে। এখান থেকে একটা ঢাল হঠাৎ করেই দীঘির মাঝ পর্যন্ত চলে গেছে। কেউই হাতপা ছোঁড়ার চেষ্টা চালালো না। যেন এটাই পরম গন্তব্য!

পরেরদিন খুব ভোরে রায়বাড়ির ঝি দীঘির ঘাটে ময়লা বাসন ধুতে যেয়ে আবিষ্কার করলো মেঘাশ্রী রায়কে। কোনমতে ভেতর বাড়িতে যেয়ে খবর দিতেই অস্থিরতা তৈরী হলো। আস্তে আস্তে পুকুর পাড়ের জটলা বেড়ে জনারণ্যে পরিণত হলো। এ নিয়ে এক সপ্তাহে দু’টো মানুষ ভাসলো। উসমান আর মেঘাশ্রীর কানাকানি সম্পর্কের কথা এখন সবার উচ্চস্বরের আলাপন। মহলের বারান্দায় স্থির হয়ে চেয়ারে বসে আছেন হিমাংশুচন্দ্র রায়। জাতমর্যাদা আর সমাজ নিয়ে সদা সতর্ক ছিলেন। তবুও সেই রাতের দীঘির জলে বলি দেওয়া শেষব্দি বৃথাই গেলো।

হিমাংশুচন্দ্রের স্থিরতা পাথরত্বে রূপ নিলো যখন মেঘাশ্রীর পাশে বসে থাকা বৃদ্ধা দাই ভাঙা গলায় আর্তনাদ করে উঠলো। 

“মাইয়ার পেডে তো বাচ্চা আছিলো!”

(সমাপ্ত)

– হাসানুল ফেরদৌস

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
1
0
0
1
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!