আমার জন্মের অনেক আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।প্রথম শ্রেনীতে পড়ার সময় থেকেই মুক্তিযুদ্ধ
আর সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযাদ্ধার দেশের জন্য অবদান নিয়ে পড়তে শুরু করি,জানতে শুরু করি।
আমি তখন ভাবতাম,যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন,তারা আমাদের মতো সাধারন নয়,তারা অসাধারন।তাদেরকে কাছ থেকে দেখা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার ।কিন্তু আমার খুব কাছের দুজন সাধারন মানুষ ,যাদেরকে আমি ছুঁয়ে দিতে পারতাম ,গল্প করতে পারতাম,আবদার করতে পারতাম,তাঁরাই যে সেই অসাধারন মানুষদের দলে ছিলেন,কখনোই তা বুঝতে পারিনি।
৭ই মার্চের ভাষনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন,”প্রতিটি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল!!”
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে ,আজ আমি একটি ঘরের গল্প লিখছি ,একটি দূর্গের গল্প লিখছি।
আমার দুই মুক্তিযাদ্ধা মামার কথা লিখছি!!
আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের নিজ নিজ যুদ্ধের কথা লিখছি,তাদের বীরত্বের কথা লিখছি।
আমি এই যুদ্ধকালীন নয় মাসের ঘটনাগুলো জেনেছি আমার মা’র কাছে,খালার কাছে,আমার মামাদের কাছে।
আজ আমি আমার মায়ের মুখেই সবাইকে শোনাবো তার মুক্তিযাদ্ধা ভাইদের গল্প ,তাদের যুদ্ধ কালীন সময়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প !!
একাওরে আমরা!!
আমার নাম শামসুন নাহার।
পুরানো ঢাকার গেন্ডারিয়ার শশীভূষন চ্যাটার্জি লেনের হলুদ রংয়ের দোতলা গাছপালায় ঘেরা বাড়িটি আমাদের।আমাদের বাড়ির প্রধান কর্তাব্যক্তি আমার দাদু।উনি একজন বি এ ,এল এল বি,উকিল সাহেব।
উনার অফিস নিচতলার দক্ষিনের ঘরে।ঘরের দুই আলমারী ভর্তি আইনের বই!!
খুব রাশভারী আর অল্প কথার মানুষ দাদু!!ওনার কথা আব্বা খুব মেনে চলেন।
আমাদেরকে বন্ধুরা ‘উকিলের নাতি’ বলে ডাকে ।
রাগও লাগে আবার মজাও লাগে এই ভেবে যে ওরা দাদুকে বেশ ভয় পায়।
মার্চ মাস শুরু হয়েছে ।
দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।
বাড়ীর বাইরে উওেজিত মিছিল যেতে দেখি।কখনো ছোট মিছিল,কখনো বড় ।ওরা গর্জন করে আকাশ বাতাস ভারী করে উওেজনা ছড়িয়ে দেয়।
আমি আর আমার বড় ভাই ছাড়া সব ভাইবোন বেশ ছোট।
বারো বছরের ছোট ভাইটা খুব চন্চল।প্রায়ই মিছিলের সাথে মিশে যায়,শ্লোগান দেয়।আমার খুব ভয় লাগে।
কিন্তু ও কি কথা শোনে?
দাদুর ঘরে বসে ছেলেরা সবাই রেডিও শোনে।
৭ ই মার্চে শেখ মুজিবর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ভাষন দেবেন।সকাল থেকে এই নিয়ে চারিদিকে গুমোট আবহাওয়া।কিছু একটা তিনি বলবেন!!
আমার বড় ভাই আর মেজো ভাইয়ের চোখেমুখে চাপা উওেজনা !!
দাদু বলছেন,সব দরকারী জিনিষপত্র কিনে রেখে দিতে হবে।সামনের সময়টা ভালো যাবে না।
আমার বর ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তানের জুনিয়র অফিসার হিসাবে নতুন জয়েন করেছেন।দাদুর আদরের নাতজামাই আর আমার ভাইবোনদের অতি প্রিয় নতুন দুলাভাই।
দাদুর সাথে বসে সে ও সনির চার ব্যান্ডের রেডিও তে ঢাকা স্টেশন ধরার চেস্টা করে যাচ্ছে ।কিন্তু ধরতে পারছে না!!
সকাল থেকে বড় ভাই আর মেজো ভাইকে দেখতে পাচ্ছি না।আমার মনে হয় ওরা ঠিক ভাষন শুনতে গেছে।আমার প্র্যাগন্যন্সির ছয় মাস চলছে।
তাই মা’র কাছে আছি।প্রথম মা হবো,কিছুই জানি না ,বুঝি না।এই শরীরে এত টেনশন ভালো লাগে না।
রেডিও তে ভাষন শোনা গেল না।তবে সাংঘাতিক কিছু হয়েছে বেশ বোঝা গেল বিকেলের উওেজিত মশাল মিছিল আর ‘জয় বাংলা’ গর্জনে!!
ভাই দুজন ঘরে ফিরে এলো সন্ধ্যায়!
দাদুসহ বাড়ির সবার মুখ গম্ভীর ।
পরেরদিন সকালে শুনলাম শেখ মুজিবের সেই ঐতিহাসিক ভাষন!!ভাষন শুনে বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই !!
আব্বা এই মুহূর্ত ঢাকায় নেই।কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট আমাদের আব্বার পোস্টিং এখন আখাউড়া তে ।আব্বা ঢাকায় আসতে পারবে তো,আটকে যাবে না তো?
দাদু আব্বা কে ঢাকা আসার জন্য খবর পাঠালেন।
উনি বলছেন, শেখ মুজিবর রহমানকে যে কোন সময় গ্রেফতার করতে পারে পাকিস্তানিরা।তখন দেশের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে।
তাঁর কথা সত্যি হলো।
২৫ শে মার্চের কালো রাত এলো!!
সেই রাতের কথা আজও মনে হলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
গভীর রাতে হঠাৎ করে শুরু হলো গোলাগুলির শব্দ ।মার্শাল ল’ চলছিল শুনেছি।কিন্তু এতো গুলি চলছে কেন?
আব্বা ঢাকায় এসে আটকে গেছেন।উনি সহ
আমরা সবাই দোতালার ঘরে অন্ধকার করে বসে আছি।ছোট ভাই দুজন ঘুমাচ্ছিল।আমাদের সবার ফিসফাস কথার শব্দে জেগে গেল।আমি আর আমার ছোট বোন ভয়ে রীতিমতো কাঁপছি।ওরা আমাদের সবাই কে মেরে ফেলবে না তো?
দোতালার ছাদ বারান্দা থেকে চারপাশে অনেকটা দূর দেখা যায়।আকাশে কিছুক্ষন পরপর আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে।
আমাদের কপালে আজ কি আছে কে জানে!!
রাত আরো গভীর হতে বড় ভাইয়ের বন্ধু বটু ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম।
উনি দাদু আর আব্বাকে খবর দিলেন যে,মিলিটারীরা ঢাকার রাজপথে মানুষ মারছে !!আমাদেরকেও মারতে আসবে।
আমাদের বাড়িতে পাখি শিকার করার দুটা বন্দুক ছিল।কিছু লাল ,হলুদ টোটার গুলিও ছিল।
বটুভাই অনুরোধ করলেন সেসব নিয়ে তৈরি থাকার জন্য।অন্তত কিছুটা আত্নরক্ষা করা যাবে।
বললেন,পাড়ার ছেলেরা সব একএ হয়ে কিছু একটা পরিকল্পনার চিন্তা করছে।
দাদু আর আব্বা সারারাত বন্দুক কোলে নিয়ে পাহারায় বসে থাকলেন।
সে রাতে কেউ এলো না।
নির্ঘুম রাত একসময় সকাল হলো।
এ যাএায় কি আমরা বেঁচে গেলাম?
—
আমার মেজো ভাই কাজী আবদুস সালাম।
মায়ের আদরের নান্নু !!
ষোল বছর বয়স।মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে।
এপ্রিলের এক দুপুরে নিজের কিছু কাপড় বেঁধে নিয়ে বলল,লনড্রিতে যাচ্ছি ।
আমাদের সবার কাপড় বাড়ীর কাছের রবিলাক লনড্রীতে ধোবার জন্য,ইস্ত্রী করার জন্য পাঠাতাম।
দাদু সামনের বারান্দায় বসে ছিলেন।ছোট ভাই দুজন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাই কে যেতে দেখলো।
সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
শেষ বিকেলে ছোট একজন ছেলে এসে নোটবুকের ছেড়াঁ পাতায় লেখা ছোট্ট একটা চিরকুট দিয়ে গেলো।
আমার মেজো ভাইয়ের লেখা !!
“আমি বন্ধুদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি।
দাদুর পকেট থেকে ২০ টাকা নিয়েছি।
আমাকে খুঁজো না।চিন্তা করো না।
দেশ স্বাধীন হলে আসব।”
আব্বা ,দাদু খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন ।মেজো ভাইয়ের যুদ্ধে যাবার খবর আমাদের পাড়ার শান্তি কমিটির মেম্বাররা কিভাবে যেন জেনে গেল।
তারা একদিন দাদুর অফিসে এসে বেশ জোরে জোরে কথা বলছিল।আমরা অবাক হয়ে গেলাম ।দাদুকে পাড়ার সবাই অনেক সন্মান করে।যারা এসেছে ,তারাও পরিচিত পাড়ার মানুষ।হঠাৎ করে তাদের এতো ঔদ্ধত্য কি করে হলো??
পরে দাদু জানালেন যে ওরা ওনাকে ধমকি দিয়ে গেছে যে,এই বাড়ীর ছেলে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয়াতে তারা অসন্তুষ্ট হয়েছে।তারা শান্তি চায়।ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে বলেছে।আর বলেছে,মুক্তি বাহিনীকে কোনভাবেই সমর্থন দেয়া যাবে না।
নাহলে বাড়ীতে মিলিটারী আসবে।কথা না শুনলে তারা বাড়ীতে আগুন দিয়ে দিবে!!
কি বিপদের কথা!!
সবার মুখে আতংকের ছায়া!
কিন্তু একজন ভয় পেলেন না।উনি আমার বড় ভাই!!
কাজী আবদুস সামাদ।
সবার আদরের ‘বাবু’!!
ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য মৃওিকা বিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করেছেন।তার কাছের বন্ধু মনা ভাই।উনি কিছুদিন হলো সামরিক বাহিনী তে যোগ দিয়েছেন।
তারা একসাথে যুদ্ধে যাবার পরিকল্পনা করেছেন।
মে মাসের এক দুপুরে সাইড ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ভাই চলে গেলেন তার বন্ধুদের সাথে দেশ স্বাধীন করতে!!
দাদু আব্বাকে বললেন ,ফিরে যাবার পথ নেই!!তোমাকে ,তোমার ছোট ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে কিছুদিন পালাতে হবে।
আমাদের বাড়ীতে রেল লাইনের ওপারের গ্রাম থেকে দুধওয়ালা দুধ দিতে আসতো।জায়গাটার নাম মীরহাজীর বাগ।তার সাথে কথা বলে আব্বা আর দাদু ঠিক করলেন ছোট ভাইবোনদের নিয়ে ওরা ওখানে কিছুদিন গা ঢাকা দেবেন।
আমার পিঠাপিঠি ছোট বোন নাজমা!!
দেখতে ভারী মিস্টি ।মাএ সতেরো/আঠারো বছর বয়স।ওকে নিয়ে সবার চিন্তা ।একে তো সে নজর কাড়া সুন্দরী ,তার ওপর একজন নয়,দুজন মুক্তিযাদ্ধার ছোট বোন।ওকে সাবধানে ,খুব সাবধানে রাখতে হবে!
আমার এখন আট মাস চলছে।
দাদু ঠিক করলেন আব্বা মা ছোট ভাইবোনদের নিয়ে গ্রামে চলে যাবেন ।আর আমি ,আমার বর আর দাদু বাড়ীতেই থাকব ।
দাদু আমাকে বললেন ,
“বুবু,তোমার এই অবস্থায় আমি তোমাকে রাস্তায় বের হতে দিব না।মরতেই যদি হয়,সন্মানের সাথে নিজের
বাড়ীতেই মরবে,অন্য কোথাও নয় !!”
বাইরে বৃস্টি পড়ছে ।
লাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে আমার পরিবারকে চলে যেতে দেখছি আর ভাবছি
আবার কি সবাই কে একসাথে দেখতে পাব!!
আবার সব আগের মতো হবে?
আমার ভাইরা কি পারবে স্বাধীনতা আনতে??
অবশ্যই পারবে!!
তাদের পারতেই হবে!!
চলবে….
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা:
শামসুন নাহার (আমার মা)
কাজী আবদুর রহমান (আমার মামা)
কাজী সুলতান আহমেদ(আমার মামা)
নাজমা আলী(আমার খালা)
সেলিনা সালাম(আমার মেজ মামী)
তনিমা তাজরীন (মামাতো বোন)
Shaila Sharmin






