যখন স্কুলে পড়তাম তখন শবে বরাতে স্কুল ছুটি থাকে না বলে খুব দুঃখ হতো। শবে বরাতের কতো কাজ। স্কুলেই আধা বেলা কাটিয়ে এলে চলবে কী করে? মায়ের সাথে সব কাজে হাত লাগাতে না পারলে মনটাই খারাপ হয়ে যেতো তখন। চালের রুটি বানাবার পর সেগুলো টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি বসিয়ে নিখুঁত বৃত্ত বানাবার কাজটা সবসময় আমিই করতাম। স্কুলে যাবার সময় পইপই করে বলে যেতাম,
“হালুয়া ট্রে তে ঢেলে কিন্তু আমার জন্য রেখে দেবে। আমি এসে বরফি কাটবো। “
শবে বরাত এলেই সেসব দিনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমাদের ছোটবেলায় শবে বরাত বেশ গুরুত্বের সাথে পালন করা হতো। এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হতো প্রস্তুতি। চাল ভাঙানো, বুটের ডাল বাটা.. ঘি, চিনি, বাদাম সহ সমস্ত হালুয়া বানানোর সরঞ্জাম জোগাড় করা। শবে বরাত আছে কী নেই, বা এর তাৎপর্য কতটুকু তা নিয়ে তর্ক বির্তক করতে কখনো কাওকে দেখিনি।
একদম ছোটবেলায় আমাদের কাছে শবে বরাত মানে হালুয়া রুটি। নামাজ যখন পুরোপুরি পড়তে শিখিনি তখনো শবে বরাতে ঠিক ঢুলুঢুলু চোখে সারারাত নামাজ পড়া চাই। বড় বোনরা সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতো, ছোটরা পেছনের সারিতে তাদের অনুসরণ করতাম। প্রথম দিকে শুধু ওঠাবসাই সার ছিল। এরপর যখন নামাজ পড়া শিখলাম তখন চলতো প্রতিযোগিতা। কে কার চাইতে বেশী রাকাত নামাজ পড়তে পারবো। অথবা কে কয় পাতা কুরআন পড়লাম, কতবার তসবিহ গুনলাম।
সেই সময় শবে বরাতে হাতে মেহেদী দেয়ার রেওয়াজও ছিল। ইবাদতে যেন বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্য মেহেদী দেয়ার কাজটা আগের দিন সেরে রাখতাম। শবে বরাতের দিন সারাদিন যেতো হালুয়া রুটি বিলানো নিয়ে ব্যাস্ততায়। আশেপাশের আত্মীয় পরিজনদের বাড়ি থেকে খাবার আসতো, সেই ট্রে টা আবার সাজিয়ে ফেরত পাঠানো। পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালুয়া দিয়ে আসা। রূপালি ট্রে তে খাবার সাজিয়ে মখমল বা সিল্কের কাপড় দিয়ে ঢেকে সেসব খাবার বিলি করতে নিয়ে যেতাম বাড়ির ছোট সদস্যরা। সেই কাপড়ে মায়েরা রঙীন সূতা দিয়ে নকশা করে বা চারপাশে কুশি কাটার কাজ করে আগেই রেডি করে রাখতো সব।
দুপুরের পর থেকে দল বেঁধে আসা শুরু হতো এলাকার ফকির মিসকিন, তাদেরকে নিজ হাতে হালুয়া রুটি দিতাম, গ্লাস জগ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পানি খাওয়াতাম, তারা মাথায় হাত বুলিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করে যেতেন। সে এক অন্য রকম আনন্দ ছিল।
ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছিলো মাগরিবের সময় সূর্যাস্তের আগে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পড়তে হয়। সব ভাই বোনরা লাইন ধরে পশ্চিম দিকে মুখ করে টিপে টিপে নাম্বার ওঠানো ডিজিটাল তসবিহ নিয়ে বসে যেতাম চল্লিশ বার এই দোয়া পড়ার জন্য। মাগরিবের নামাজ এর পর গোসল করে তাহিয়্যাতুল ওযু নামাজ। ভেজা চুল থেকে যত ফোঁটা পানি পরবে ততগুলা গুনাহ মাফ হবে। তাই চুল মুছতাম না।
একটু যখন ছোট ছিলাম তখন এরপর পরই ছুটতাম ছাদে। ভাইরা অপেক্ষা করতো তাদের গুপ্তধন নিয়ে। একেকজনকে সেদিন মনে হতো জেমস বন্ড। শাখারি বাজার থেকে বাবা কাকাদের চোখ এড়িয়ে জমানো টাকা দিয়ে কিনে আনা হতো সেসব গুপ্তধন। শুরু হতো তারাবাতি জ্বালানো দিয়ে। এরপর লুকিয়ে রাখা ঝোলাটা থেকে একে একে বের হতো মরিচা, চকলেট বোম, স্টেনগান বোম, ঝড়না, চর্কি, মোড়রা। ছোটদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো লাঠি বোম। হাতুড়ির মতো দেয়ালে বাড়ি মারলেই ফুটতো, আগুন দেয়া লাগতো না।
বাড়ির মুরব্বিরা বোম ফুটানো নিয়ে বকাবকি করলে আমরা বলতাম নামাজ পড়তে পড়তে কেউ যেন না ঘুমিয়ে পড়ে তাই বোম ফুটাই।
বোমাবাজির পর্ব শেষ হলে বাড়ির ছেলেরা পরিষ্কার পাঞ্জাবী পাজামা পরে বেড়িয়ে পড়তো বন্ধু বান্ধবের সাথে। ভ্যান ভাড়া করে সারারাত ঘুরে বেড়াতো বিভিন্ন মসজিদে, কবরস্থানে। মাঝে মাঝে এর ওর বাড়িতে তেহারি খেয়ে সারারাত কাটিয়ে দিতো বাড়ির বাইরে। ওই একটা রাতেই বাড়ির বাইরে থাকলে কেউ তাদের বকাঝকা করতো না।
আর আমরা মেয়েরা ছোট ছোট মোমবাতি দিয়ে সিড়ি, বারান্দা, জানালার কার্নিশ সাজাতাম। সেই মোমবাতির আলোয় একটা ঐশ্বরিক পরিবেশ তৈরী হতো ঘরময়। সেই আধো আলোতে জায়নামাজ বিছিয়ে সবাই মিলে এক সাথে নামাজ পড়তাম। কিছুক্ষণ পরপর কেউ একজন চা বানিয়ে আনতো সবাইকে চাঙা রাখার জন্য। নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া, জিকির… সাথে কিছু গল্প, যারা চলে গেছেন তাদের স্মরণ করে কিছু স্মৃতিকথা..
এই করতে করতে যখন ফজরের ওয়াক্ত হতো তখন শেষ সময়ের ইবাদত এ জানপ্রাণ ঢেলে দিতাম। মা কে দেখতাম হাপুস নয়নে কাঁদতো, কখনো আমাদের মাথায় ফুঁ দিয়ে যেতো। আল্লাহর কাছে মনের যত আকুতি, যত চাওয়া, যত স্বীকারোক্তি সব উগলে দিতাম। শেষে লম্বা করে একটা মুনাজাত দিয়ে যখন শবে বরাতের নামাজ শেষ করতাম তখন মন টা ভারী হয়ে উঠতো। মনে হতো রাতটা ফুরিয়ে গেলো, আল্লাহর সাথে সব কথা বলাই হলো না। সেহরি খেয়ে পরদিন রোযা রাখার নিয়ত করে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যেতাম।
এখন শবে বরাত নিয়ে অনেক তর্ক বির্তক, আলোচনা সমালোচনা হয়। ছোটবেলা থেকেই ফরজ নামাজ পড়ি বলে কখনো নফল ইবাদত নিয়ে আমার মনে দ্বিধা কাজ করে না। আমার মন থেকে যতটুকু আসে, পরিবার থেকে যা শিক্ষা পেয়েছি সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই শবে বরাত পালন করি। একটা বিশেষ রাত উপলক্ষে যদি কিছু নফল ইবাদত বেশী করা যায়, আমাদের মা খালাদের মতো আমরাও যদি কিছু ভাল মন্দ খাবার বানিয়ে, মানুষকে খাইয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রাখি তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না।
আমার মা সব সময় বলেন, আল্লাহ কে ডাকার জন্য, তাঁর ইবাদত করার জন্য কোনো উপলক্ষ লাগে না। যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় পবিত্র শরীর আর মনে ডাকলে তিনি অবশ্যই শুনবেন। শবে বরাত কে অনেকেই ভাগ্য রজনী বলে থাকেন। বরাত শব্দের অর্থ থেকেই বোধ করি এরকম ভাবা হয়। তবে আরবিতে বারআত শব্দের অর্থ মুক্তি। নাফস ই শাবান, অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনী… ক্ষমা প্রার্থনা করার রাত। সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইলে বিগত বছরের গুনাহ মাফ করে আগামী বছরের ভাগ্য পরিবর্তন করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই তিনি রাখেন।
তাই এই মহিমান্বিত রাত আমাদের সবার জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনুক। এই রাতের উছিলায় আল্লাহ আমাদের সবার গুনাহ মাফ করে দেক, মহামারী থেকে পৃথিবীকে মুক্তি দেক এই প্রার্থনা করি।
সর্বোপরি… “কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক… কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর…”
মানুষকে ভালোবাসি, মানুষের মতো ভালোবাসি।
– Sanjida Hossain
Send private message to author






