বড় আপা
আমার মায়ের একটা বড় দুঃখ ছিল তার কোন মেয়ে নাই। এদুঃখ ঘোচাতে একটা বয়স পর্যন্ত আমাকে মেয়ে সাজে কাটাতে হয়েছে! ছোট আমাকে মেয়েদের পোশাক পরিয়ে রাখা হতো। আমার ছোটবেলার চেহারাখানা মেয়েলি ছিলো, না, পোশাকের কারনে জানি না, সবাই আমাকে মেয়ে ভাবতো। এনিয়ে মা এখনও হাসাহাসি করে। বড় আপুরা আমাকে চিম্বুক ধরে আদর করে খুকি বলে ডাকতো! বড় অপমানবোধ হতো সে সময়টাতে! সমস্ত রাগটা মায়ের উপরে যেয়ে পড়তো।
বড় আপা না থাকার একটা কষ্ট আমার মাঝেও ছিল। অনেক বন্ধুর বড় আপাদের যখন দেখতাম ওদের কি আদর করে, তখন কেমন একটা কষ্টের মেঘ মনের আকাসটা দখল করে নিত! কিছু দুঃখ মানুষ সারাজীবন বহন করে। বড় আপা না থাকার দুঃখটা বড় হতে লাগল, যখন আমার বন্ধু সোহেলের আপা ওকে সাইকেল কিনে দিলো।
বড় আপা না থাকার দীর্ঘদিনের অভাব হঠাৎ করে পূরণ হয়েছিল।আমার বাবা এক মেয়ের বিয়ের উকিল বাবা হলো। সেই শাহিদা আপা আমাদের পরিবারে আসা -যাওয়া শুরু হলো।
ধীরে ধীরে শাহিদা আপা আমার বড় বোন হয়ে উঠল। আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে আপা হাজির হতো। আপার বাসায় আমরা বেড়াতে যেতাম। আপার বাড়ি ছিলো নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগন্জ থানায়।
আমরা থাকি ডেমরা থানার সারুলিয়ায়। আমাদের বাসা থেকে আপার বাসা দশ কিঃমি দূর হবে। আপা একটা স্কুলে শিক্ষকতা করত। জুট মিলের এক অফিসারের সাথে আপার বিয়ে হয়।
আমি আপার জামাই কে কখনো দেখিনি। উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন না। আমরা যখন যেতাম তার সাথে দেখা হতো না। এনিয়ে আমাদের আপার মাঝে কোন দুঃখবোধ ছিলো না।আপার সংসার হয়েছে তাতে সে খুব খুশি। সবসময় আপা থাকতো হাসিখুশী! দেখলে সবাই বলতো মেয়েটা কত সুখি!
মা ও আপাকে নিজের মেয়ে মনে করা শুরু করেছেন। আমি কোন দুষ্টামি করলে আপাকে বলতো, “তোর ভাই দেখ কী করেছে? তুই এসে বুঝা।”
আপা আমাকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, “কী রে এতো দুষ্টামি করিস কেন? মায়ের কষ্ট টা বুঝিস না! তুই একটু ভালো করে পড়াশোনা কর। দেখোস না আব্বা কতো কষ্ট করে তোর জন্য। “
আপার মায়া জড়ানো শাষন আমার খুব ভালো লাগত। বাবা কোন কারনে মারলে আমি সোজা আপার বাসায় হাজির হতাম। আমায় দেখলে কেমন চাঁদের মতো একটা হাসি দিতো আপা। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো,” কী রে মুখখানা এতো মলিন কেন? আব্বা বুঝি বকা দিছে।
আবার দুষ্টামি করেছিস? ” বাসায় নিয়ে আদর করে খাওয়াতো।
আদর করতে করতে বলতো, ” দুষ্টামি কেন করিস? তোকে নিয়ে আব্বার কতো স্বপ্ন বুঝিস না।” আপার আদরে আমার চোখ বুঝে যেতো।
বাবা যখন মারা যায় আপা এমন করে কাদঁছিলো, আত্মীয় স্বজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, “এ মেয়ে কে!” বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের সংসার এলোমেলো হয়ে গেলো। মা আমায় নিয়ে চলে এলে গ্রামের বাড়ি।
আপার সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। মা প্রায় দুঃখ করে মেয়েটা “কেমন আছে! ” আমি একবার আপা যেখানে থাকতো সেখানে গেছি আপা কে পায়নি। এলাকার লোকজন বলতে পারে না। কোথায় গেছে?
আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি প্রায়ই ওই এলাকায় যেতাম আপাকে খুজঁতে কিন্তু পেতাম না। বাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মনে হতো আপা হঠাৎ করে এসে বলবে, “কী রে তুই এখানে? এমন করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! আমার বাসা ভুলে গেছিস বুঝি! তোর চেহারা এতো শুকনো কেন! কিছু খাসনি? আয় বাড়িতে আয়। “আমি আপার পিছু পিছু বাসায় গেলাম।আপা পাশে বসিয়ে খাবার দিচ্ছে আর আমি খাচ্ছি। আপা মায়া মায়া কন্ঠে ছোট ছোট গল্প করছে। দাঁড়িয়ে থাকতাম আপা আসতো না। একটা হাহাকার নিয়ে হলে ফিরে আসতাম।
পড়াশোনা শেষ করেছি এখন চাকুরি করি। না,আপাকে খুঁজে পায়নি।মা এখনও আপার কথা বলে, কেমন উদাস হয়ে যায়। মায়া বড় কঠিন জিনিস! অনাত্মীয় একজন মানুষের মায়াও মানুষ ভুলতে পারে না।
আমার আপার কথা মনে পড়লে মনটা কেমন শুন্য হয়ে যায়!
একটা গ্রুপে গল্প লিখেছি তা পড়ে একজন মন্তব্য করেছে, “কী রে তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস! খুব ভালো লিখিস! “
কতটা সময় ধরে কমেন্ট দিকের চেয়েছিলাম জানি না।টের পেলাম লেখা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে চোখের জলে। নামটা দেখে সারা দেহে আনন্দের একটা হিমেল হাওয়া বয়ে গেল! কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে বলা যায় না। সব কিছু ভাষায় বলা যায়?
যায় না!
আমি উত্তেজিত হয়ে মা কে ডাকলাম, আমার এমন কন্ঠ শুনে মা ছুটে আসে।
“কী রে সাজু কী হয়েছে? এমন করছোস কেন! “
আমি খুশিতে কথা বলতে পারছিনা,, বানের জলের মতো ভীতর থেকে জমে থাকে কথা একসাথে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কোনোমতে বললাম, “মা শাহিদা আপা!”
“কই দেখি! মায়ের কান্না জড়ানো স্বর।”
দুজনে মেসেঞ্জারে কথা বলছে, আমি দেখছি আমার মোবাইলের স্কিন ভিজে যাচ্ছে মায়ের অশ্রু তে। মা বলছে,” এসে তোর ভাই কে বিয়ে করা।”
® নাবিল মাহমুদ ( Nabil Mahmud)
Send private message to author






