করোনার দিনগুলো


আমি গুলিস্তানের রাজধানী হোটেলের সামনের ফুটপাতে বসে আছি। হাতে ঘড়ি না থাকায় নিখুঁত সময় বলতে পারছি না৷ এশার আজান দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। রাস্তার সাদা বাতি জ্বলে উঠেছে। এক হকার আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। বোকা বোকা চেহারা। বয়স ১৫ কি ১৬ হবে। মুখে পিংক কালারের জুটের কাপড় দিয়ে বানানো মাস্ক। এক নাগাড়ে ‘বাইছ্যা লন ১২০, দেইখা লন ১২০’ বলে যাচ্ছে। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। চোখে চোখ পড়লেই অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে ছেলেটা। এর চোখ অনেকটা গরুর চোখের মতো। বড় বড়। অনেকটা বাধ্য হয়েই ওর হাক-ডাক বন্ধ করে আমাকে বললো,

  • আমার দিকে এমনে তাকায় আছেন ক্যান?
    আমি নীরবতা পালন করছি। আমি উঠে দাড়িয়ে আন্তরিক গলায় বললাম,
  • তোর নাম কি?

ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বললো,

  • আমার নাম রকি। আপনে কাছে আইবেন না। আপনার মাস্ক কই? করোনারে ডরান না?

আমি ইচ্ছে করে কয়েকটা কাশি দিয়ে বললাম,

  • যাদের করোনা হয়ে গেছে তাদের মাস্ক পড়তে হয় না।

এবার ছেলেটি ভড়কে গেলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

  • আপনার করোনা হইছে?

আমি সহজ গলায় সম্মতি দিয়ে বললাম,

  • হ্যা হয়েছে৷ তুই ভয় পাস নে। তোর করোনা হবে না৷
  • আপনি এখান থেকে যান। তা না হইলে আমি কিন্তু কাকারে ডাক দিমু।
  • তোর আপন কাকা?
  • না। আমাগো সবার নেতা। যান কইতাছি।

এবার আমি ওর দোকানের সামনে বসে পড়লাম।

  • ডাক দে তোর নেতারে।

রকির চোখেমুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্টত। লুংগীর ভাজ থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন দিলো। সম্ভবত ওর নেতা কাকাকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই রকির দোকানের সামনে লোকে লোকারন্য হয়ে গেলো। আমি কিছুক্ষণ পর পর কাশি দিয়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছি। কেউ কোন কথা বলছে না। আমাকে এক নজর দেখার জন্য সমাবেশের দুই চারজনের মধ্যে মারামারিও লেগে গেলো৷

আমার দিকে রকির নেতা কাকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি এবার জোরে জোরে কাশি দিচ্ছি। আমার কাশির সাথে সাথে আশেপাশের মানুষগুলো একটু পিছিয়ে যাচ্ছে। কাশি দেয়া বন্ধ করলেই আবার ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যাচ্ছে। উপভোগ করার মতো দৃশ্য।

  • আপনি করোনা নিয়ে বাসা থেকে বের হইছেন ক্যান? রকির নেতা কাকা জিজ্ঞেস করলেন৷

আমি মুখটা যথাসম্ভব ফ্যাকাশে করে বললাম,

  • কাকা আমাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
  • আপনি মাস্ক না পড়ে এমন একটা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?
  • কাকা আমার কাছে কোন টাকা নাই।
  • ঠিক আছে আমি মাস্ক কিনে দিচ্ছি। মাস্ক নিয়ে বাড়ি চলে যান।
  • না কাকা। আমি মাস্ক পড়তে পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে।
  • আপনি এখান থেকে যাবেন নাকি পুলিশ ফোন দিবো?
  • আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না। আপনি যা ইচ্ছা করেন।

আমাকে আশেপাশের সবাই কৌতুহল নিয়ে দেখছে। আমি পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বংশাল থানার একজন এস আই সহ চার-পাঁচজন কনেষ্টবল এসে হাজির। কাকার সাথে কথা বলে এস আই আমার সামনে এসে দাড়ালো।

  • রিপন ভাইয়ের কাছে যা শুনলাম তা কি সত্যি?
  • না স্যার।

আশেপাশের সবাই হতভম্বের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এস আই রকির কাকার দিকে একবার তাকিয়ে আমাকে বললো,

  • আপনি করোনা রুগী না?
  • না স্যার। আমি একদম সুস্থ একজন মানুষ।

রকি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থেকে বললো,

  • মিথ্যা কন ক্যান? আপনি না কইলেন আপনার করোনা?

রকির কাকা এস আইকে ডেকে নিয়ে কি যেন বললো৷ কিছুক্ষণ পর একজন কনেষ্টবল আমার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে নীল কালারের পুলিশ কাভার্ড ব্যানে উঠিয়ে নিয়ে গেলো।

থানার হাজত খানায় বসে আছি৷ একজন কনেষ্টবল এসে বললো,

  • আপনারে স্যার ডাকে।

থানার সেকেন্ড অফিসারের সামনে বসে আছি৷ ন্যামপ্লেটে নাম লেখা রুস্তম৷ নামের সাথে উনার কোন মিল নেই৷ একদম হ্যাংলা পাতলা গায়ের গড়ন।

  • আপনার সমস্যা কি?

রুস্তম সাহেবের গলার স্বর মেয়েলী। আমিও গলার স্বর কিছুটা মেয়েলী করে বললাম,

  • স্যার কোন সমস্যা নেই।

রুস্তম সাহেব কিঞ্চিত ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন। তিনি অপমানিত হয়েছেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,

  • পাগলের ভান ধরেছিস?

আমি আবারো রুস্তম সাহেবের কন্ঠ অবিকল নকল করে বললাম,

  • না স্যার।

তিনি আরো ক্ষেপে গেলেন৷ আমার আপাদমস্তক দেখে বললেন,

  • তোর চুল এতো বড় কেন?
  • স্যার আমি টিকটক করি। তাই এভাবে চুল রেখেছি৷

রুস্তম সাহেব এবার হেসে দিলেন। তিনি যে অপমানিত হয়েছেন সেটার প্রতিশোধ হিসেবে তিনি আমার চুল কেটে দিবেন৷
একজন কনেষ্টবলকে ডাক দিয়ে কেঁচি নিয়ে আসার জন্য বললেন। আমি টি শার্ট খুলে হাসিমুখে বসে আছি। রুস্তম সাহেবের হাসিমাখা মুখ মলিন হয়ে গেলো৷ আসলে তার প্রতিশোধটাকে আমি পাত্তা না দেয়াতে তিনি হতাশ। তবুও কেঁচি দিয়ে আমার চুল কাটতে শুরু করলেন৷ আমি মহানন্দে মাথা পেতে দিলাম। একটু হাসিমাখা কণ্ঠে বললাম,

  • স্যার ন্যাড়া করে দিন। আরাম পাবো।

তিনি কোন কথা না বলে খুব ছোট করে চুল কেটে দিলেন।

আমি হাসি হাসি মুখ নিয়ে টি শার্ট পড়ে দাড়িয়ে রইলাম৷ রুস্তম সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে হতাশ। তিনি যে উদ্দেশ্যে আমার চুল কেটে দিলেন সেই উদ্দেশ্য সফল না হওয়াতে তার মুখ আগ্নেয়গিরির মতো রুপ ধারণ করেছেন৷ এবার তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন,

  • এই তুই হাসছিস কেন?

আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,

  • স্যার আমি টিকটকার নই৷ যখনি বাসা থেকে চুল কাটার টাকা দেয়া হয় তখনি টাকাটা অন্য কাজে ব্যবহার করে ফেলি। এভাবে প্রায় ১ বছরের মতো হয়ে গেছে। তাই বাসা থেকে আর টাকা দিবে না বলে দিয়েছে। ইদানিং ফেসবুকে দেখেছি আপনারা থানায় ফ্রী-তে চুল কেটে দিন। তাই একটা হট্টগোল পাকিয়ে নিজের কাজটা করে নিলাম৷

রুস্তম সাহেব আমার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে বসে পড়লো। আমি তাকে ক্ষেপানোর জন্য বললাম,
-স্যার যে নাপিত আমার চুল কেটে দিতো সে নাপিত গেলেই আমাকে চা খাওয়াতো। আপনি কি এক কাপ চা খাওয়াবেন?

রুস্তম সাহেব এবার পুরোদস্তুর ক্ষেপে গেলেন৷ কনেষ্টবল ডাক দিয়ে বললেন,

  • এই ছেলেটাকে হাজতে নিয়ে রাখো।

কনেষ্টবল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, -স্যার উনাকে হাজতে রাখা যাবে না৷
রুস্তম সাহেব অবাক হয়ে বললেন,

  • কেন?
  • স্যার উনি হাজতের সবাইকে কি যেন বলেছে। সবগুলো এখন চুল ফেলে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমাদের একজনকেও ভালোভাবে ডিউটি করতে দিচ্ছে না৷ স্যার উনাকে ছেড়ে দিন৷

রুস্তম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে কনেষ্টবলকে বললেন,

  • ওরে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে শান্তি দাও প্লীজ।

কনেষ্টবল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,

  • স্যার ছেড়ে দেই। এসব পাগল হাজতে না থাকাই ভালো।
  • যা ইচ্ছা করো। ওরে এখান থেকে নিয়ে যাও।

কনেষ্টবল আমাকে থানা থেকে বের করে দিয়ে বললেন,

  • ভাই আপনার রাস্তা মাপেন৷ আর বিরক্ত কইরেন না৷

আমি বললাম,

  • আপনি আমার উপকার করেছেন। আপনাকে একটি পরামর্শ দেই। পুরান ঢাকায় এক পীর আছেন। তিনি যা বলেন তাই লেগে যায়। আমার সাথে ভালো খাতির৷ দুইদিন আগে উনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পীরবাবা আমাকে বললেন,
  • এই করোনায় তুমি চুল ফেলে দাও। আমি স্বপ্নে দেখেছি যারা চুল ফেলে দিবে তাদের কখনো করোনা হবে না৷

কনেষ্টবল আমার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে বললো,

  • ভাই এটা কি সত্যি?

আমি বললাম,

  • সত্যি মানে। আলবাত সত্যি৷

কনেষ্টবল খুশি হয়ে থানায় ফিরে গেলেন। আমি আবার গুলিস্তানের রাজধানী হোটেলের সামনে যাবো। ফুটপাত হকার রকির কাছে যাবো৷ ওকে আবার ভয় দেখাবো……

সমাপ্ত

লেখা: আসিফ হোসাইন ( Asif Hossain)

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
3
3
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Asif Hossain
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Eli
Guest
Eli
4 years ago

আমি হুমায়ুন আহমেদ এর অনেক বড় একজন ভক্ত। আপনার গল্প টা পড়ছিলাম আর আমার চোখের সামনে হিমু ভেসে উঠছিলো।
অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।

1

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!