আমার বিয়ের দশ বছর চলছে। আমার কোনো সন্তান নেই। আমার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউ এই বিষয় নিয়ে আক্ষেপ করেনি বা আমাকে দোষারোপও করেনি কখনও।
বিয়ের দুই বছর পর জানা গেল আমি কখনোই মা হতে পারব না। আমাকে এই খবরটা জানিয়েছিল আমার শ্বশুর। আমার হাত ধরে সেদিন তিনি বলেছিলেন,
” মাগো, আমি যদি তোমাকে সারাজীবন মা বলে ডাকি, তারপরও কি তোমার সন্তানের অভাব পূরণ হবে না?”
আমি সেদিন কথা বলতে পারিনি, চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরেছিল।
আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশিরা বাড়ি বয়ে এসে কথা শুনাতে এলে আমার শাশুড়ি-ই সবার আগে প্রতিবাদ করেন। শারীরিক যন্ত্রণা দূর হয়ে যায় সহজেই কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার জন্য তৈরি হওয়া মানসিক যন্ত্রণা দূর হয় না কখনোই।
একটা বয়সে এসে মানুষ খুব বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। ছেলে মেয়েদের বিয়ে হলে বেশিরভাগই আলাদা সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেইসময় বাবা মায়ের সাথে ছেলে মেয়েদের অনেক বেশি দূরত্ব তৈরি হয়। অসহায় বাবা মায়েরা সেই সময় নিজেদের কথা বলার জন্য কাউকে খুঁজেন, নিজেদের গল্প বলাটা খুব বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ মানুষ-ই মনে করেন যে, বৃদ্ধ মানুষেরা অযথায় কথা বলেন এবং সেটা অনেক বেশি বিরক্তিকর। সেই অসহায়ত্বের জায়গা বুঝা হয়ে উঠে খুব কম মানুষের-ই।
রোজ অফিস থেকে ফেরার পরে আমার শ্বশুর এবং শাশুড়ি দুইজনেই বাচ্চাদের মতো আমার কাছে ছুটে আসেন। দুজনের অনেক অনেক বায়না থাকে আমার কাছে। আমি যখন উনাদের জন্য কিছু কিনি তখন মনে হয় আমি আমার সন্তানদের জন্য কিছু কিনলাম। এসব কিছু মিলিয়েই আমি একটু একটু করে মা হয়ে উঠলাম। শুরুতে ভুল বলেছিলাম, আমি গর্ভধারিণী হতে পারিনি, কিন্তু মা হয়েছি।
এইতো গতমাসে আমার শ্বশুর তার ছেলেকে বলেছিল,
” আমাদের হাইস্কুলের সব বন্ধুরা মিলনমেলার আয়োজন করছে। ষাট বছর তো পেড়িয়ে গেলাম, কবে যেন মরে যাই। শেষ বয়সে সবার সাথে একবার দেখা হলো, আনন্দ করলাম ভালোই হবে। আমরা সবাই একটা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে চাই। আমার জন্য খেলার পোশাক এনে দিতে পারবি?”
” না বাবা পারব না। এই বয়সে এসব খেলতে হবে না। এমনিতেই অনেক বয়স হয়েছে। হঠাৎ পড়ে গেলে হাত পায়ে ব্যথা পাবে৷ মিলনমেলা হচ্ছে। যাও, আনন্দ করো। খেলাধুলা করতে হবে না। তোমার শরীরে দৌড়ানোর মতো এতটাও শক্তি নাই।”
তার মেয়ের কাছেও সে কথাটা বলেছিলো। মেয়েও মুখের উপর না করে দিয়েছে। এই বয়সে খেলাধুলা করলে সবাই না-কি হাসাহাসি করবে৷
সন্ধ্যার কিছু আগে বারান্দায় একটা অসহায় বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সেদিন চেয়েছিলাম- ‘সময়ের আগেই সন্ধ্যা নামুক, অন্ধকার হোক। পৃথিবীর সব আলো নিভে যাক। অন্ধকারে দুফোঁটা চোখের পানি পড়লেও কারো নজরে না পড়ুক।’
পরদিন অফিস শেষ করেই খেলাঘরে চলে গেলাম।সাদা জার্সি, সাদা প্যান্ট,হাতের গ্লাভস,পায়ের প্যাডস,উরুর আর্ম প্যাড,বুকের চেস্ট গার্ড,মাথায় হেলমেট, স্পোর্টস সু কিনে বাড়ি ফিরলাম। একটা বয়স্ক মানুষ সেদিন বাচ্চাদের মতো করে কাঁদলেন। আমি তো মা, মায়েরা সন্তানদের সবকিছু বুঝতে পারেন। তারপর প্রতিদিন নিয়ম করে খেলার মাঠে যেতে হতো আমাদের। সবাই তাদের সন্তানদের নিয়ে মাঠে যান। মাঠের একপাশে অন্য মায়েদের সাথে আমিও দাঁড়িয়ে থাকতাম। খেলা শেষ হলে মা আর ছেলে একসাথে বাড়ি ফিরতাম।
আজ এই বাড়িতে সকাল হয়েছে সময়ের অনেক আগেই। সকাল থেকে সবার তোড়জোড় চলছিল। আমার বিছানার এক পাশে একটা নীল শাড়ি রাখা ছিল। সাথে একটা চিরকুট। তাতে লেখা – ” মা, আজ একটু সাজবে? অনেকদিন তোমার পছন্দের শাড়িটা পরতে দেখিনি।”
আজ অনেকদিন পর আমি আয়নার সামনে বসলাম। শাড়িটা পরলাম। চোখে কাজল দিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখতে মোহনীয় লাগছিল।
আমি আর আমার শ্বশুর একটা রিকশা করে স্কুলে যাচ্ছি। বাচ্চা ছেলেদের মতো উনি আমার হাতটা চেপে ধরে আছেন। স্কুলের পথ খুব দূরে নয়। আমার মনে হতে লাগলো এই পথ যেন শেষ না হয়। আমি এতটা আনন্দ পাইনি বা কাউকে এতটা খুশি হতে দেখিনি। ইচ্ছে করছিল দুচোখ ভরে আমি আমার সন্তানের খুশি দেখি। তৃপ্তিভরা মুখটা বেশিক্ষণ দেখতে পারলাম না। খেয়াল করলাম আমার চোখ থেকে পানি ঝরছে…।
( প্রতিদিন অনেক অনেক খারাপ গল্প শুনি। পত্রিকার পাতায় খারাপ খবরগুলো-ই ফোকাস করে থাকে। শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে আমাদের সবার ভাবনাটাই ভিন্ন থাকে। বিয়ের আগে একটা মেয়ে সবকিছু নিয়েই আতঙ্কিত হয়ে থাকে। বাংলা সিনেমার গল্পের মতো ভাবতে থাকে সবসময়, এখানের চিত্রটা বোধহয় তেমনি হয়ে থাকবে। শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে এসব ধারণা নিয়ে নতুন পরিবেশে গিয়ে মেয়েটাও পারে না মানিয়ে নিতে। তারপর আলাদা সংসারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে৷ এত খারাপ গল্পের ভিড়ে ভালো কিছু তো অবশ্যই আছে। ভালো গল্পগুলো শুনালে কেউ বেশি শুনে না অথবা এগুলা শুনার আগ্রহ পায় না কেউ। সবার কাছে শ্বশুরবাড়ির খারাপ গল্পগুলোই প্রচলিত হয়ে আসছে। ভালো কিছু কি সত্যিই নেই? ভালো গল্পগুলোর প্রচার হোক।
নোট : একটা বয়সে এসে মানুষ অনেক বেশি অসহায় হয়ে পড়েন। এই বয়সটা সব মানুষের জীবনেই আসবে৷ এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার হলেও যোগাযোগটা কমেছে। আমরা সবাই ব্যস্ত দূর-দূরান্তের খবর নিতে। কিন্তু আমাদের সামনে বসে থাকা কোনো অসহায় মানুষের সাথে গল্প করার সময় বা ইচ্ছা হয় না আমাদের। আমরা ব্যস্ত আমাদের স্মার্ট আর ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে। আগের মতো করে পরিবারের সবাই মিলে গল্প করা হয় না। একসাথে বসে কোনো খেলা খেলি না। একসাথে এখন খাবার খাওয়ারও সময় হয় না।
এই মানুষেরাই সারাটা জীবন নিজের পরিবার আর সন্তানদের জন্য কাজ করে গেলেন। নিজেদের জন্য একটা দিনও বরাদ্ধ রাখেননি কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়ার। ছুটির দিনগুলোতেও অতিরিক্ত কাজ করেছেন কেবল সন্তানদের জন্যেই। বৃদ্ধ বয়সে এসে সন্তানেরাই সবচেয়ে বেশি পর করে দিলে উনারা কী নিয়ে থাকবেন বলতে পারেন?
প্রতিটা পরিবার আনন্দে বাস করুক, প্রতিটা মানুষের জীবনে আনন্দ থাকুক।
লেখা: Esrat Emu.
Send private message to author






ভিন্ন কল্পনাশক্তিতে গড়ে উঠে কিছু অন্যন্য গল্প।
এবং নানান গল্পের ছায়াতেই গড়ে উঠবে আগামীর সমাজ❤️