মৃত স্বামীর লাশ পাশে নিয়ে বসে আছে নিতু। কিছুক্ষণ আগেই নিজ হাতে খুন করেছে তাকে। রক্তমাখা বটিটা পাশেই পড়ে আছে। ঘর থেকে বের হয়ে পালানোর পথ খুঁজবে নাকি স্বামীর লাশটা কোথাও গুম করে ফেলবে তা ভাবছে। পরক্ষণেই মনে হলো, এতে কি কোন লাভ আদৌ হবে? আজ পর্যন্ত কোন অপরাধী কি পার পেয়েছে? যখনই হোক ধরা সে পড়বেই। তাই বৃথা চেষ্টা না করে নিয়তিকেই মেনে নেয়া উত্তম।
দেখতে দেখতে সকাল সাতটা বেজে গেছে। প্রায় আট ঘন্টা সে একটা মৃত মানুষের পাশে কাটিয়ে দিয়েছে নির্ঘুম। এদিকে ময়লা নিতে আসার সময় হয়ে গেছে। যে কোন সময় কলিংবেল টা বেজে উঠবে।
ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল টা বেজে উঠলো। কিন্তু দরজা খোলার সাহস বা শক্তি যে নিতুর নেই। এদিকে লোকটা ভালো করেই জানে, নিতু ভাবি যত গভীর ঘুমেই থাকুক না কেন, দরজা তার খুলতে ভুল হবেনা। তাই সে অনবরত বাজিয়েই যাচ্ছে বেল। কেন জানি তার ও খটকা লাগছে। মিনিট তিরিশের মত অপেক্ষা করে না পেরে দারোয়ান আর পাশের বাসার জামান সাহেবকে জানায় সে। জামান সাহেব ও নিতুর সদ্য মৃত স্বামী ফাহিমের নাম্বারে ফোন দিতে থাকেন। কিন্তু না, দুজনের কেউই ফোন ধরছেনা। এদিকে নিতু যেন লাশটার পাশে নিজেও লাশের মত পড়ে থাকে। বাইরের হট্টগোল কিছুই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছেনা এই মূহুর্তে।
ফাহিমের পরিবারের সাথে ফোনে কথা বলার পর তাদের অনুমতি নিয়ে পুলিশে খবর দেয়া হলে,পুলিশ ও চলে আসে ঘটনাস্থলে খুব দ্রুতই।
দরজা ভাঙার পর সবার চোখ ছানাবড়া। কেউ ভাবতেই পারেনা নিতুর মত এমন গোবেচারি স্বভাবের মেয়েটা এই কাজও করতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাহিম ও নিতুর ঢাকাস্থ কিছু আত্মীয়স্বজন পৌঁছে যায় ঘটনাস্থলে। তাদের সামনে দিয়েই লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হয়। আর নিতুকে পরানো হয় হাতকড়া।
পুলিশের সামনেই ফাহিমের বোন এসে নিতুর গালে, মাথায় এলোপাতাড়ি চড়, ঘুষি মারতে থাকে।
তবে নিতুর পরিবার নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে। একে তো দুই বছর আগে তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পালিয়ে এই ছেলেকে বিয়ে করে একবার মুখে চুনকালি লাগিয়েছিল, এখন তো আবার সংবাদপত্রের শিরোনাম বানিয়ে ছাড়লো। এমন মেয়ে জন্মের সাথে সাথে মরে গেলেই তারা যেন বেঁচে যেত৷ নেহাতই পুলিশ কেস, তাই তারা এসেছে। না আসলেও পুলিশ আরেক ক্যাচাল করতো। তবে এই মেয়ের জন্য একটা পয়সাও তারা খরচ করবেনা। জেলে পচে মরুক, ফাঁসি হলে আরও ভালো।
না, কথাগুলো মুখ ফুটে না বললেও নিতু যেন তার ভাই ভাবির মুখো ভঙ্গিমা দেখে ঠিক আঁচ করতে পারছে। আর তারা বলবেই না কেন? ভাবির পছন্দ করা তার দুঃসম্পর্কের মামাতো ভাইকে বিয়ে না করে, তার স্বপ্নভঙ্গের জন্য নিতুই যে দায়ী।
যাবার সময় নিতু স্পষ্ট যেন শুনতে পেলো, পাশের বাসার কাজের মেয়েটা নিচতলার ভাবিকে বলছে,” আগেই বুঝছিলাম খালা, বাড়িত যে ভাইয়ের বন্ধুর এত আনাগোনা, তা কিয়ের লাইগ্যা। ইশ, ওই ব্যাডার হাত ধইরা গেলে যাইতি, জামাইরে মারোণের দরকার কি আছিলো?”
আহারে, এই মেয়েটাকে কত মায়াই না করতো নিতু। গতকালও ওর মেয়ের জন্য রান্না করা মুরগির লেগপিসটা টিফিনবক্সে করে দিয়েছিল।
নিতু এখন থানায়। লেডি পুলিশ এসে প্রচন্ড রকম মানসিক টর্চার করছে তাকে, যেন সব সত্যি সত্যি বলে দেয় সে। হাত-গলার ক্ষতগুলো দেখে তাদের ধারণা, ফাহিম আত্মরক্ষার একপর্যায়ে নিতুকে আঘাতগুলো করেছেন। কথাগুলো শুনে, নিতুর প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে, কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে তার গলা দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছেনা। গতকাল দুপুরের পর থেকে যে কিছুই খাওয়া হয়নি। গায়ে একদম শক্তি নেই। তল পেটেও প্রচন্ড ব্যাথা। ও হ্যাঁ, নিতু এখন দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী ফাহিম আর নিতু ছাড়া এখনো কেউ জানেনা। হঠাৎ পেটের ব্যাথাটা প্রচন্ড বাড়ছে, মাথাটাও বেশ ঘুরাচ্ছে৷ জ্ঞান হারানোর আগে চোখের সামনে ভাসছে কিছু আবছা আবছা স্মৃতি….
গ্রাম থেকে ভাই-ভাবি তাকে নিয়ে ঢাকায় আসে পড়ালেখা করানোর নামে। কিন্তু আসার পর বুঝতে পারে, ঢাকায় কাজের লোকের বড়ই দাম, তাই হয়তো নিতুকে ভাবির খুব দরকার এখন। ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ফাহিমের সাথে নিতুর প্রথম দেখা। সেই থেকে মাঝেমধ্যে কিছু কথা, পরিচয় থেকে পরিণয়।
ভাবির মামাতো ভাইয়ের তৃতীয় বৌ হবার হাত থেকে বাঁচতে ফাহিমের হাত ধরে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল নিতু। ফোনে বয়স্ক মা-বাবাকে জানিয়েছিলো অবশ্য, কিন্তু তাদের খুঁটিতে সেই জোর ছিলনা যে বড় ছেলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে তারা। বৃদ্ধ বয়সে ছেলেই তো চালাচ্ছে তাদের।
কিন্তু বিয়ের পর ফাহিমটাও যে বদলে গেল। কথায় কথায় গালাগালি, মারপিট করা তার স্বভাব। আসলে যৌতুকে যে কিছুই পায়নি, সেই আক্ষেপ তো মেটাতে হবে। হুজুগের বসে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু এখন পস্তাচ্ছে। আর নিতু মেয়েটাও দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে যাচ্ছে। এমন বেহায়া মেয়ে নিতু, ফাহিম আগে বোঝেনি। ভেবেছিলো, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেই চলে যাবে। কিন্তু নিতুর যে যাবার কোন জায়গা নেই, আর কোন মুখেই বা যাবে।
বাসায় স্ট্রিপ টেস্ট করে যখন জানতে পারলো মা হতে চলেছে, ভেবেছিলো ফাহিম বোধহয় খুশি হবে, ওর হৃদয় পরিবর্তন হবে, কিন্তু উলটো তেড়ে আসলো ফাহিম৷ এখন তো নিতু পাকাপোক্ত ভাবে এই সংসারের জুড়ে বসবে এই বাচ্চার অধিকার নিয়ে। রাত এগারোটায় বের হয়ে ফার্মেসী থেকে বাচ্চা নষ্ট করার ওষুধ এনে নিতুর মখে গুজে দিতে চাইলো। মেয়েটা খেতে না চাইলে বটি এনে ভয় দেখায় ফাহিম, ওষুধ না খেলে আজ জানেই শেষ করে দিবে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে কিভাবে জানি ফাহিমের গলার একপাশে একটা পোঁচ লেগে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে৷ নিতু ওড়না নিয়ে চেপেও ধরেছিলো রক্ত বন্ধ করার জন্য, কিন্তু লাভ হয়নি।
হঠাৎ নিতুর চোখেমুখে পানির ছিটা মারতে জ্ঞান ফেরে তার।
এ কি ফাহিম! এতক্ষণ তাহলে অবচেতন মনে এসব ভাবছিলো নিতু। তবে বটিটা পাশে ঠিকই পড়ে আছে। ঘড়ির কাটায় রাত এখন একটা বাজে। ফাহিম বটি এনে ভয় দেখানোর একপর্যায়ে নিতু জ্ঞান হারায়।
-কি রে, এই বাসায় থাকতে হলে আমার কথা মত চলতে হবে, বুঝলি?
-হুম বুঝলাম, সকাল হলেই তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে।
সকাল হবার সাথে সাথেই ঘুমন্ত ফাহিমকে রেখে নিতু তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে চললো এক অজানার পথে।
দুই সংসারে তো কাজের মানুষের মতই খেটেছে সে, এখন নাহয় অন্য কারো সংসারে খেটে পেট পালবে। কল্পনায় দেখার মত বদনাম তার এখনো হবে, খুব ভালো করেই জানে সে। হোক না, কি যায় আসে। নতুন শহরে নতুন করে বাঁচবে। অন্তত কল্পনায় দেখা জেল হাজতের মত পরিবেশে তো তার সন্তান জন্মাবে না।
-সমাপ্ত।







