নারী দেহের যে অংশে পুরুষের চোখ আটকে যায় বুকের সেই মাংস পিণ্ডটা আমার শুকিয়ে গেছে সেই কবেই, যেই বছর আমার ছেলে কিশোর আমার হাতটা ছেড়ে একাই হাঁটতে শিখেছিল।
শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তাই হয়তো এই পুরুষের ভীড়ে কারো নজর পড়ছে না আমার দিকে। এই ছোটো চায়ের দোকানের একটা খুঁটির মতো আমিও প্রয়োজনীয় বস্তু, পাশের পুরুষেরা অনায়াসে শরীরে ভর করছে, কেউ ধ্বাক্কা খেয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছে।
আমি ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলছে, এই দোকানের ভীড়টাও ক্রমশ বাড়ছে।
সুন্দরী মেয়েদের সামনে সকল পুরুষেরাই ভদ্রতার ভান করলেও আমার সামনে তা করার যুক্তি নেই৷ এই যেমন পাশের লোক দুইজন অশ্লীল ভাষায় একে অপরকে গালি দিচ্ছে, পানের পিচকারিতে আরেকজনের মুখ লেপ্টে গিয়ে কী বিশ্রী মুখ ভঙ্গি করে যাচ্ছে; সামনে দাঁড়ানো লোকটি তার লুঙ্গিটা উরু পর্যন্ত তুলে আছে। এই ভীড়ের মাঝে আমি একজন মেয়ে সেটার দিকে নজর দেওয়ার মতো কারণ নেই, শরীরের সৌন্দর্য ক্ষয় হয়ে গেছে সেই কবেই যেদিন আমার স্বামীর শরীরের ডানপাশ-টা অবশ হয়ে বিছানায় পড়ে গেল।
ভীড়ের মাঝেই সাইকেলের হর্নটা শুনতে পেলাম, আমার পরিচিত, খুব পরিচিত এই শব্দ। এই শব্দের সাথে আমার পরিচয় তখন যখন আমি নিরুপমা দাস থেকে নিরুপমা সরকার হয়ে উঠি-নি। টিউশন শেষ করে গলির মুখে ঢুকলেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের মুখে এই বাক্য- ” ঐ দেখ সেই একটা মাল যাচ্ছে” শুনার দিনগুলিতে এই শব্দটার সাথে পরিচয়। রাস্তার এক পাশে দেখতাম সোজা পথে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে সাইকেলটি, আরেকপাশে আমি। তাকে তাকিয়ে দেখার সাহস পাইনি কখনও, পাড়ার কেউ দেখে নিলেই তো কথার শেষ ছিলো না৷ তবুও মনে হতো এই রাস্তায় আমি একা না আরও একজন কেউ আছে।
বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলছিলো, এই ছোটো দোকানের চালার নিচে এখন আরও একজন মানুষ বেড়ে গেল।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পাড় হয়ে গেলেই আমার স্বামী আবার আমাকে কাছে,ডেকে নিয়ে বলবে, ‘শাড়িটা খুলে ফেল, দেখি শরীরে কোনো দাগ আছে না-কি, দেখি কোন পুরুষের সাথে শুইতে গেছিলি।’ আমি চুপচাপ শাড়িটা খসিয়ে ফেলবো শরীর থেকে, তারপর মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকে দেখাতে হবে৷ শুকিয়ে যাওয়া বুকের মাংস্পিণ্ড হাত দিয়ে স্পর্শ করার চেষ্টা করবে সে, কাছে গেলে নখের আঁচড় দিয়ে বলবে, যা স্নান করে আয়।
একটা ভেজা হাতের স্পর্শে আমি চমকে উঠলাম, হাতের মুঠিতে একটা কাগজের টুকরো দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলো সাইকেলটা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টির এই শব্দ আমার কাছে অচেনা, একদম অচেনা। আমি সাইকেলের চলে যাওয়াটা দেখলাম। এইরকম করেই একদিন দুপুরে দেখেছিলাম তাকে। প্রতিমা বিসর্জন শেষ করে ফিরছিলাম সবাই। সাইকেলটাকে দেখলাম মসজিদের পাশে দাঁড় করানো। কিছুক্ষণের জন্য আমার দম আটকে আসছিলো। সাদা পাঞ্জাবি পরা, মাথায় টুপি পরা ছেলেটার সেই চোখ দুটো একবারের জন্য দেখেই চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। তখনও আমার মুখমণ্ডল জুড়ে লাল আবিরে মাখানো ছিলো। তেমনি এক সন্ধ্যায় সুধাংশু সরকারের সিঁদুরে সিঁথি রাঙ্গিয়ে ছিলাম আমি।
চিরকুটের গায়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে। কাগজটা ভিজে নরম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই! সেই বিকেলের কথা মনে পড়ছিলো বারবার। বইয়ের দোকানে বই কিনতে গেলে দোকানদার এক প্যাকেট বই হাতে দিয়ে বললো, কেউ একজন এই এক প্যাকেট বই আমার জন্য দিয়ে গেছে। বইগুলো নিয়ে সোজা চলে গেলাম নদীর পাড়ে। খালি একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম আমি৷ চারপাশটা বেশ ফাঁকাই ছিলো। বইয়ের প্যাকেট খুললাম, নাম গুলো পড়লাম, বইয়ের পেজ উল্টালাম, আর কয়েকটি ভাজ করা চিরকুট খুঁজে পেলাম। আমার সেদিনও সাহস হয়নি চিরকুট গুলো খুলে দেখার। প্যাকেট সুদ্ধ বইগুলো সেই বেঞ্চে ফেলে রেখেই বাড়ি ফিরেছিলাম।
আমার নিজের কোনো ঘর ছিল না। ছোট’দা যখন বাইরে কাজে যেতো তখন বৌদির সাথেই রাতে ঘুমাতাম। আমার সব জিনিসেই তো বৌদির অধিকার ছিলো। তাই সেই বই কিংবা চিরকুট নিয়ে আসা হয়নি আমার। ঘর ছিল না বলছি কেন, আজও কি নিজের ঘর বলে কিছু আছে? সেই ঘরের বিছানা জুড়ে আছে পৌনে চারহাত লম্বা একজন পুরুষ, ঘর জুড়ে আছে তার কর্তৃত্ব!
আমার ছেলে কিশোরকে আমি সাথে রাখতে পারি না, মায়ের কাছে রেখে আসি। রোজ রাতে সুধাংশুর পাশে নগ্ন হয়ে ঘুমাতে হয় আমাকে, সুধাংশু তার বাঁ হাতের পায়ের জোর প্রয়োগ করে আমার উপর। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি আমি। ভোরবেলা যে আজানটা হয় তখন আমার ঘুম ভাঙ্গে। আজানের শব্দ শেষ হতেই একটা অস্পষ্ট সাইকেলের হর্ন শুনতে পাওয়া যায়। এই শহরে কেউ একজন বলে যায় আমি আছি ভয় পেয়ো না। আমি বিছানা থেকে নামি, স্নান করতে যাই। সিঁদুরে মাখামাখি হয় আমার মুখ। জল ঢালি। শুধু সিঁদুর মুছি না। তুলসী তলায় আরতি দেই, গড় হয়ে প্রণাম করি। মসজিদের নামাজ শেষ হয়, সাইকেলের আওয়াজ শুনি।
কতশত-বার ঈশ্বরকে বলেছি, এই সাইকেলের আওয়াজ বন্ধ করে দাও,নয়তো শক্তি দাও এই আওয়াজ অনুসরণ করতে। কিন্তু পরক্ষণেই আটকে যাই মাথা ভর্তি সিঁদুরের কাছে।
বৃষ্টির পানিতে চিরকুটের কাগজ ছিড়ে গেছে সেই কখন মনে পড়ছে না, ছেড়া কাগজের অংশগুলো ফেলে দিয়ে হাত পরিস্কার করে রাস্তায় নামলাম।
বৃষ্টির বেগ কমেছে। অল্প অল্প বৃষ্টিতে কেউ কেউ ভিজে ভিজে যাচ্ছে। বৃষ্টি নামলেই ছাদে এসে ভীড় করে সুন্দরী মেয়েরা, মাথার চুল এলিয়ে দিয়ে ভিজতে থাকে। আমি সুন্দরী নই, কিংবা এখন আমি মেয়েই নই, একটা কেবল মানুষ, একটা শুকনো শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াই। এই শরীরেরও তবু কিছু দাম আছে, যার টাকাতেই সুধাংশু সরকার দুইবেলা খেতে পারে।
আজ একজন বলেই গেল, এই শরীরে হবে না, মোটাতাজা করার জন্য ঔষুধ খেতে৷ আমি তো এই পথে নতুন, এইতো দুইজনের সাথে শুয়েছি মাত্র। টাকা দিয়ে শুয়ে তারাও আনন্দ পায়নি জানি, তবুও আগে বায়না করা ছিল তাই আর না করতে পারেনি।
এই শহরে আমি একজন পতিতা কিংবা বেশ্যা বলা যেতেই পারে। আমাকে আর কে ভালোবাসবে। এই যে সাইকেলে ভর করে চলে যাওয়া মানুষটা যেদিন জানবে সেদিন মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। তারপর এই অন্ধকার পথে একাই চলতে হবে।
এই শহরে আমাদের ভালোবাসার কেউ নেই। স্বামী বা প্রেমিক কেউ আমাদের জন্য না। কেবল শরীর ভোগ করা কাস্টমাররাই আমাদের ভগবান, যারা দুবেলা খাওয়ার টাকা দিয়ে যায়…..।
লেখা : Esrat Emu.
Send private message to author






অনেক সুন্দর লিখা আপু❤️