বেনারশী শাড়ি পড়েছে মেয়েটি।পরীর মত লাগছে তাকে।ফুলেল সজ্জিত বিয়ের স্টেজে বসে আছে সে।আত্মীয় স্বজন সবাই আছে।সবাই এসে তার সাথে ছবি তুলছে।কত আনন্দ চারদিকে।কিন্ত মেয়েটির গাল ভিজে গড়িয়ে অশ্রু নামছে।চিৎকার করে কান্না আসছে।একটা সাধারণ মানুষকে সে খুব খুঁজতেছে আজ।সবাইকে দেখা গেলেও সেই মানুষটিকে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও। মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।পাশে বসা দাদী মেয়েটির মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।দুইজনের অনুভূতি যেন এক।একজন মানুষের অভাব তাদের ভেতরের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে তা স্পষ্ট। মেয়েটি খুঁজে বাবাকে,বৃদ্ধা খুঁজেন ছেলেকে।কিন্ত যে হারিয়ে গেছে সে আর ফিরবেনা কোনদিন।
মেডিকেল এডমিশন টেস্টে এবার ছেলেটি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলেটি অনেক বড় ডাক্তার হবেন।গরীব বাবার সন্তান ছিলেন,ডাক্তার হয়ে পরিবারের হাল ধরেছেন,বোনদের বিয়ে দিয়েছেন।সব দায়িত্ব শেষে দেখলেন অনেক সময় গড়িয়ে গেছে।নিজের সংসার হয়েছে।চার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সংসার সব কিছুর দায়িত্ব পালন করতে করতে নিজে আর বেশি এগুতে পারলেন না।জীবনে স্বচ্ছলতা আসলেও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে না পারার একটা গোপন বিষাদে ভুগতেন। বড় ছেলেটাকে ডাক্তার বানানোর ইচ্ছা।ছেলেটার মাঝে নিজ স্বপ্ন পূরণের প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিলেন।
ছেলেটাও বাবার ব্যাথা বুঝতো।অন্য সহপাঠীরা যখন ফেসবুকে, বন্ধুদের আড্ডায় ব্যস্ত, তখন সে দিনরাত ভুলে পড়ার টেবিলে মগ্ন থেকেছে।
আজ রেজাল্ট পেয়ে ছেলেটা তার ডাক্তার বাবাকে খুঁজতেছে।বাসায় অনেক মিষ্টি এসেছে।বাবার মিষ্টি অনেক পছন্দ ছিলো।মা যখন একটা মিষ্টি ছেলেটার মুখে দিলো,তখন ছেলেটার দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি জাগলো।চোখ গড়িয়ে অশ্রু নামছে।সবাই কত শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাচ্ছে।শুধু একজন মানুষ আর নেই।বাবা নেই।
ছোট্ট মেয়েটার মা ছিলো ডাক্তার। চেম্বার থেকে ফিরলে দৌড়ে মায়ের কোলে উঠতো সে।সারাদিন কাজের বুয়ার কাছে থেকে সে খিটমিটে হয়ে যেতো।মা ফিরলে মায়ের বুকে লেপ্টে থাকতো মেয়েটি।অনেকদিন আর মা বাসায় ফিরে আসেননি।সেই যে গেলেন, তারপর মাকে আর দেখতেও পায়নি সে।বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বাবা শুধু কান্না করে কেন?ছোট্ট মানুষের মন।উত্তর পায়না।মাকেও পায়না।
ছেলে দুটোর বাবা ছিলেন মেডিসিন ও হৃদরোগ স্পেশালিষ্ট। গরীবদের দুঃখ বুঝতেন মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন।রোগীরা তাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরতো পরম মমতায়।গরীবের ডাক্তার হয়ে উঠেছিলেন।কেউ তাকে কসাই বলে গালি দেয়নি কোনদিন।শহর থেকে নিজ গাঁয়ে গিয়ে প্রতি শুক্রবার রোগী দেখতেন।মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় সিক্ত ছিলেন তিনি।
রাতে ছেলে দুটোর ঘুম না আসলে বাবাকে খুঁজে। মা আজকাল চুপচাপ হয়ে গেছেন।কতদিন তারা মাকে আর হাসতে দেখে না।
ব্যাংকে চাকুরী করতো ছেলেটি।বিয়ে ঠিকঠাক ছিলো।রাতে চুপিচুপি বাগদত্তার সাথে কথা হতো।কথার জাদুর মায়াবী আবেশে রাত কখন ফুরিয়ে যেতো টের পেতো না।মোবাইলের অন্য প্রান্তের মেয়েটি ছেলেটির কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খেতো।মেয়েটির চোখের নীচে আজ কালি জমেছে।এখনো বিয়ে হয়নি।বিয়ের অনেক প্রস্তাব আসলেও মেয়েটি ক্ষণিকের আলাপে মায়া পাওয়া ছেলেটিকে আজও ভুলতে পারছেনা।রাত জেগে থাকে।মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে।কিন্ত সেই ছেলেটির কল আর আসেনা।মেয়েটিও হাসতে ভুলে গেছে।
৩০ লাখ মানুষ এই পৃথিবীতে ছিলো।তাদের পরিবার ছিলো,সন্তান ছিলো।ভালবাসার মানুষ ছিলো।তারাও অনেকের প্রিয়জন ছিলেন।
তারা মেঘে ভিজতেন।জ্যোস্নারাতে চাঁদের আলোয় বিভোর হতেন।মায়াবী বিকেলে নীল আকাশে উড়ে যাওয়া সাদা বক দেখতেন।
সমুদ্র পাড়ে তাদেরও পদচারণা ছিলো।গোধুলির লাল অভায় তারাও আনমনা হতেন।কফিশপে প্রিয়ার সাথে কফিতে চুমুক দিতে দিতে তারাও সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতেন।
তারাও কবিতা ভালবাসতেন। অনেকে কবিতা লিখতেন। গান ও গজলে তারাও মাতোয়ারা হতেন।সিনেমা দেখে তারাও কেঁদে দিতেন।বন্ধুদের আড্ডায় তারাও মুখর ছিলেন।পাড়ার টি স্টলে তারাও দেশ ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনার ঝড় তুলতেন।
৩০ লক্ষ মানুষ সারা দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেলেন।আর কোনদিন তারা তাদের বাসার কলিংবেল বাজাতে আসবেন না।তাদের জন্য যারা অপেক্ষায় আছেন,সেই অপেক্ষা আর কোনদিন ফুরাবে না।
সেই ৩০ লক্ষ মানুষের বাঁচার আকুলতা ছিলো।কত স্বপ্ন ছিলো।দুনিয়াকে কতকিছু দেবার ছিলো।কিন্ত সব শুণ্যতায় ভরিয়ে তারা হারিয়ে গেছেন অজানায়।
কোভিড ১৯ এর নিষ্ঠুরতার গল্প বলছিলাম।বিচ্ছেদের যন্ত্রনা কেমন তা আপনি আজ বুঝবেন না।যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে শুনে নিবেন কতটা বিভীষিকাময় তাদের দিনরাত্রি।কতজন হাসতে ভুলে গেছেন।কতজন এতিম হয়ে গিয়েছেন।মাথার উপর থেকে কত পরিবারের বটগাছটা সরে গিয়েছে দূরে।
আজ বাংলাদেশে কোভিড ১৯এ আক্রান্ত ৭২৩১ জন।মৃত্যু ৬৬ জন।
প্রতিদিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।চারদিকে মৃত্যুর হাতছানি। কান্না চোখেমুখে।
হাসপাতাল গুলো রোগীতে ভরপুর।একটা সিটের জন্য হাহাকার। আইসিইউ গুলো পরিপূর্ণ।
কোটি টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরছেন একটা আইসিইউ এর জন্য।কিন্ত না উত্তর আসছে সব জায়গা থেকে।
আপনি সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত।আপনি কারো ব্যক্তিজীবন ঘাটাঘাটিতে ব্যস্ত।আপনি অডিও ভিডিও ফাঁস নিয়ে ব্যস্ত।
আপনার হুশ নেই।ন্যুনতম মাস্ক পরে নিজেকে,নিজ পরিবারকে সুরক্ষিত করার বিকার নেই আপনার।আপনি দায়িত্বশীল নাগরিক হতে পারেননি।আপনি আপনার অজান্তেই আক্রান্ত করছেন অন্য মানুষকে।আপনার দায় আছে অন্য মানুষের মৃত্যুতে।
তবু আপনি সজাগ হবেন না।তবু আপনি মাস্কটা ঠিকঠাক পড়বেন না।
আপনার আলোচনা সমালোচনায় প্রলয় থামবে না।
হুশে ফিরুন।স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।মাস্ক পরুন।মাস্ক পরুন।মাস্ক পরুন।
নিজে বাঁচুন।অন্যকে বাঁচান।সচেতন হউন।নিজ জীবনকে ভালবাসুন।
অন্যের প্রিয়জন হারানোর গল্প যদি আপনাকে নাড়া না দেয়,তবে আপনি হৃদয়হীন মানুষ। আমরা চাই পৃথিবীটা হৃদয়বানদের থাকুক।
-ডাঃ আহমেদ জোবায়ের।
Send private message to author







কোভিড-১৯, ইতোমধ্যে কেড়ে নিয়েছে অনেক আপনজনের অমূল্য প্রান।
সবাইকে সচেতন হতে হবে। নইলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা লেখকের জন্য।
আমৃত্যু চলতে থাক এ লেখনী,স্পন্দিত হোক প্রতিটি হৃদয়, শুভকামনা স্যার আপনার জন্য।