লাশ

১.

ভুলু কে শেষ কবে কথা বলতে দেখা গেছে তা কেউই সঠিকভাবে বলতে পারবেনা। সে আদৌ কথা বলতে জানে কিনা তাও কেউ জানেনা। আর জানবেই বা কী করে? এ তল্লাটে কেউ কোনদিন ওর সাথে কথা বলেনি। এলাকার মানুষজন পারতপক্ষে কেউ ঘাটায় না তাকে। সবাই এড়িয়েই চলে বলা যায়। তার বয়স কত তাও কেউ জানেনা। বুড়ো থেকে শিশু সবাই তাকে আজীবন এই অবস্থাতেই দেখেছে। রোদে পোড়া তামাটে দেহ, লম্বা জট পাকানো কাঁচা-পাকা  চুল, মুখ ভর্তি দাঁড়ি, রক্তবর্ণ চোখ, যেন সাক্ষাত পিশাচ।

মানুষজন বলে, সে নাকি এই কবরস্থান ছেড়ে কোথাও যায়না। দিনের বেলা সে তার বাটভাঙা ছুরিটাতে শান দেয়। আর রাতের বেলা লাশের গা থেকে মাংস কেটে খায়। এই জন্যই নাকি তার বয়স কখনো বাড়েনা। বয়স সবসময় একই থাকে। 

মানুষের কথায় কিছু যায় আসেনা ভুলুর। সে লাশের মাংস খায়না ঠিকই কিন্তু সে লাশ চুরি করে। সরাসরি চুরি করে বললে ভুল হবে। চুরি করতে সাহায্য করে। ঢাকা থেকে  মাঝে মাঝে লাশবাহী গাড়ি আসে। তারা নতুন কবর থেকে লাশ তুলে নিয়ে যায়। ভুলু তাদের কবর খুঁড়ে দেয়, লাশ গাড়ি পর্যন্ত পৌছে দেয়। বিনিময়ে কখনো দুইশ কখনো বা পাঁচশ এরকম পায়। তার এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। দুইবেলা ভাত আর কল্কের জন্য একটু গাঁজা, এতটুকু হলেই তার হয়ে যায়। 

ইদানীং কবরস্থানে প্রায় প্রতিদিনই নতুন লাশ আসে। লাশের খুব কাছে মানুষজন যায় না। এমনকি লাশের আত্মীয় স্বজন ও না। কি যেন ভাইরাস এসেছে দেশে আর তাতেই এরা মারা যাচ্ছে। বেশির ভাগই বুড়োবুড়ি, অনেক সময় এদের সাথে কেউ থাকেও না। হাসপাতালের লোকজন এসে মাটি দিয়ে যায়। এরপর এরা মাটি ও সময় দুটোর সাথেই মিশে যায়, হারিয়ে যায়। মাঝে মাঝে তার মনে প্রশ্ন জাগে, মৃত্যুর পর লাশের মালিক কে হয়? বেঁচে থাকতে হয়তো মানুষের উপর তার পরিবারের অধিকার থাকে, মৃত্যুর সাথে সাথেই কি সেই অধিকার হারিয়ে যায়না? যদি থাকত তাহলে তো তারা লাশটা নিজের কাছেই রাখতো। কবরস্থানে ফেলে যেতনা।

২.

সময়ের সাথে চাঁদ টাও তার রঙ বদলাচ্ছে। লালচে হয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রাত বেড়েছে। কবরস্থানের পেছনের বাঁশঝাড় থেকে প্যাঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। ভুলুও সবেমাত্র তার কল্কেটায় শেষ টান দিয়েছে। এমন সময় গেটে লাশের গাড়িটা থামল। সে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে গাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়। ভেতর থেকে ড্রাইভার নেমে একটা সিগারেট ধরায়। আরেকজন পেছন থেকে একটা বেলচা বের করে ভুলুর হাতে দেয়। কোন কথা না বলেই আজকের সদ্য মাটি দেয়া কবরটার দিকে হাঁটা শুরু করে ভুলু। গাড়ির দুজন আগন্তক ও অনুসরণ করে তাকে। এসব করতে করতে ভুলুর হাত এত পেঁকে গিয়েছে যে এখন কারো সাথে কোন কথা বলার দরকার হয়না। হয়ত ঘুমের মধ্যেও সে দু-চারটা লাশ একাই অনায়াসে গাড়িতে চালান করে দিতে পারবে।

কবরের মাটি সরাতে সরাতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ায় ভুলু। সচরাচর সে লাশের চেহারার দিকে খেয়াল করেনা। কিন্তু আজ মাটি সরানোর সময় লাশের কাফনটা সরে গিয়ে এক পলকের জন্য ভেসে উঠে মুখ। মুখটা দেখেই শরীরটা অবশ হয়ে আসে ভুলুর। একজন বয়ষ্ক মহিলার  লাশ, কমপক্ষে সত্তর-আশি তো হবেই বয়স। কিন্তু লাশের চেহারার সাথে তার মায়ের চেহারার আশ্চর্য রকমের মিল। তার মাকে সে শেষ কবে দেখেছে মনে পড়েনা, বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানেনা, শুধু জানে এই চেহারার সাথে তার মায়ের চেহারা হুবুহু মিলে যায়।

কবরের পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার হঠাৎ পরিবর্তন দেখে আগন্তুক দুজন ও তব্দা খেয়ে যায়। এরকম তো কখনো হয়নি। একজন তার পাশে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকে, ভুলু, অ্যাঁই ভুলু, কি হইছে তোর?” কোন প্রতিক্রিয়া হয়না তার। অপরজন এগিয়ে এসে একটু জোরে ধাক্কা দেয় তাকে। তাতেও তার কোন নড়চড় হয়না। প্রথমজন বেলচাটা তুলে নিয়ে সজোরে একটা ঘা বসায় ভুলুর কোমর বরাবর। ব্যাথায় ক্যোঁৎ করে বসে পড়ে সে। “ শুয়োরের বাচ্চায় আজকে কি গাঁজার লগে মদও খাইছে নাকি?” ফিক করে হেসে প্রথম জনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় দ্বিতীয় জন। “বুঝছি, আজকে ওরে দিয়া কিস্যু অইবোনা। যা করার তোর আর আমারই করন লাগব। যা লাশের মাথার দিকটা ধর” উত্তর দেয় দ্বিতীয় জন। 

ব্যাথায় কোমরের হাড়টা ঝিমঝিম করছে ভুলুর। কোমরের উপরের চামড়া বেশ খানিকটা কেটে গেছে, রক্তও পড়ছে অনেক। কোনমতে হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে সে। লাশ নিয়ে আগন্তক দুইজন অনেকখানি এগিয়ে গেছে গেটের দিকে। হঠাৎ করে কোমরে গোঁজা বাটভাঙা ছুরিটার উপর হাত পড়ল তার। দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়াল সে। ছুরিটা হাতে নিয়ে আগন্তক দের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।পেছন থেকে গলা কাটতে হবে। লাশ দুটোর কোন ক্ষতি করা যাবেনা।   

-Asaduzzaman Faisal

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
1
0
0
1
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Asaduzzaman Faisal
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!