আমার মেয়ের শরীরে জোরপূর্বক হাত দিয়েছে ওর স্কুলের শিক্ষক। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম থানায় যাব, মামলা করবো। আমার স্বামী এসব নিয়ে চিৎকার চেচামেচি করেই যাচ্ছে৷ আমি না-কি বাড়াবাড়ি করছি। এসব করার কোনো দরকার নেই। দরকার হলে মেয়েকে নতুন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে।
শ্বশুর শাশুড়িও বুঝাচ্ছেন। মেয়ে মানুষের মান সম্মানটাই সবকিছু। এই কথা লোক জানাজানি হলে আমাদের মেয়ের বদনাম হবে। মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। সবাই বুঝাচ্ছে। আমার মাও ফোন দিয়ে বুঝালেন। সব বাদ দিতে বললেন।আমার সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে সবকিছু দেখে চুপসে গেছে।
অন্যান্য দিনের মতোই আমার মেয়ে আজ স্কুলে গিয়েছিল। টিফিন পিরিয়ডে টিফিন খেয়েছিল। বান্ধবীদের সাথে গল্প করেছিল। আড্ডা দিয়েছিল। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল।
স্কুল ছুটির পর আজকেও ওরা পড়ছিল। প্রাইভেটে বাকি বান্ধবীদের ছুটি হলেও স্যার ওকে অংক করানোর কথা বলে আরও কিছু সময় বসিয়ে রাখলো।
মেয়ে বাসায় আসলো। আমার কাছে সবকিছু বললো। স্যার ওর শরীরে হাত দিয়েছে। মা হয়ে মেয়ের কাছে এই কথাগুলো শুনার পর আমি চুপ করে বসে থাকতে পারবো না। সিদ্ধান্ত যা নিলাম তাই করবো। মেয়েকে কাছে টেনে বললাম, “তোমার কি ভয় করছে? তোমার সাথে যা হয়েছে তুমি থানায় গিয়ে সবকিছু বলতে পারবে না?”
আমার মেয়ে মাথা নাড়লো। আমি মেয়েকে সেক্স এডুকেশন সম্পর্কে আগেই জানিয়েছিলাম। ওর স্বাস্থ্যশিক্ষা বইয়ের এই বিষয়ের অধ্যায়গুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই বুঝিয়েছি৷ বিষয়টা ট্যাবু নয়৷ লজ্জা পেতে হবে না৷ মেয়ের জন্য এই শিক্ষাটা দরকার ছিল।
আমি মেয়েকে নিয়ে থানায় গেলাম। থানার অফিসার ইনচার্জ বেশ কৌতুহল নিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। “র্যাপ কেস” বিষয়টা জটিল। আমার মেয়ে কোনোরকম না ঘাবড়িয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
” তোমার শরীরের কোথায় কোথায় হাত দিয়েছে সামান্তা?
” আমার বুকে হাত দিয়েছে৷ আমার পাজামার ভেতর হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে।”
” তুমি চিৎকার চেচামেচি করোনি? “
” আমার মুখে জোর করে চেপে ধরেছিল। চিৎকারের চেষ্টা করেছি। কিন্তু দরজা জানালা সব বন্ধ ছিল। আমরা পাঁচতলার উপরে ক্লাশ করি। নিচের তলায় অফিসরুমে কিছু মানুষ থাকে। তাছাড়া স্কুল ফাঁকা হয়ে যায় তখন। কেউ শুনেনি। “
” তোমার সাথে আর কি কিছু হয়েছে?”
” না আর কিছু হয়নি। বারান্দায় একজন কেউ আসছিল। পায়ের শব্দ পেয়ে স্যার আমাকে ছাড়েন। তারপর দরজা খুলে বের হয়ে চলে আসি। “
” এ ঘটনার কেউ কি প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী আছে? কেউ কি দেখেছে বা শুনেছে কিছু?”
” না, কেউ ছিল না।”
অফিসার আমার দিকে তাকালেন তারপর বললেন, “আমার পুরো ঘটনার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে আপনারা গল্প বানাচ্ছেন। আপনার মেয়ের বয়স খুবই অল্প। আপনিই হয়তো শিখিয়ে এনেছেন এসব।”
” আপনার এসব মনে হওয়ার কারণ?”
” যাদের ধর্ষণ করা হয় বা চেষ্টা করা হয় তারা সাধারণত এতটা সহজে সব কথার উত্তর দেয় না৷ বেশিরভাগ ধর্ষিতা মেয়েরাই মুখ খোলে না। অনেক বেশি ভয় থাকে৷ আপনার মেয়ের চোখ মুখ স্বাভাবিক। সব কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।”
” আপনাদের ধারণা যাদের ধর্ষণ করা হবে তারা কখনোই তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না বা মুখ খুলে বলবেও না তাদের সাথে অন্যায় হয়েছে৷ এমনটাই হলে বুঝি খুশি হতেন? আমার মেয়ের বেলায় উলটা হচ্ছে বুঝি? দেখেন, মা হয়ে মেয়ের শরীরের নোংরা লেগে যাওয়ার গল্প বলে মেয়েটাকে ছোটো করতে আসেনি৷ আমরা মামলা করতে এসেছি। যতটা জানানোর ছিল জানালাম। এখন রিপোর্ট লিখেন এবং সেই স্যারকে গ্রেপ্তারের কাজটা করেন। “
খবরটা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো। একটা স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষক ছাত্রীর শরীরে জোরপূর্বক হাত দেওয়া এবং ধর্ষণের চেষ্টা করেছে। মিডিয়া এই খবরটা খুব ভালোভাবেই কভার করছে। বাসায় সাংবাদিকেরা চলে এসেছে। আমি আমার মেয়েকেই সাংবাদিকদের সামনে পাঠালাম। আমার মেয়ে তো কোনো অন্যায় করেনি যে ঘরে মুখ লুকিয়ে থাকবে। ওর সাথে যা অন্যায় হয়েছে সেটার প্রতিবাদ ও নিজেই করবে।
একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনার তৈরি হলো। পক্ষে বিপক্ষে অনেক যুক্তি হলো৷ স্কুলের শিক্ষকেরা স্যারের পক্ষ নিলেন। স্যারের নাম খারাপ করতে এই কাজ করেছি এমনটাই ধারণা সবার৷ এই যে চতুর্দিকে নানা কথা ছড়ালো এই পরিস্থিতিতে আমি আমার মেয়েটাকে শক্ত রেখেছি৷ আমার স্বামীও একটা সময়ের পর আমাদেরকেই সমর্থন করেছেন।
কেসটা আদালতে উঠলো। আমার মেয়ের ঘটনায় প্রত্যক্ষ কোনো স্বাক্ষী ছিল না বলে প্রথমে আমরা সবাই খুব আতঙ্কিত ছিলাম আমরা জিতবো কীভাবে এই নিয়ে। ঘটনা ঘটার এক মাস পর আমার ফোনে একটা কল আসে। কল রিসিভ করার পর ফোনের অপাশে একটা বাচ্চা মতো মেয়ের গলা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। মেয়েটা আমার মেয়ের স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।
মেয়েটা বলেছিল, ” আন্টি, আমি তো এত কিছু বুঝি না। আমি কাউকে বলতেও পারিনি। সেই স্যার আমাকেও একদিন অফিস রুমে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আমার হাত চেপে ধরছিল। আমার পিঠে হাত দিয়েছিল। আমি অনেক জোর করে ছাড়িয়েছিলাম। আমিও সেই স্যারের বিচার চাই।”
এমন করেই আরও কিছু মেয়ে সংখ্যায় দশজনের বেশি হবে, বিভিন্ন ক্লাশের মেয়েরা নিজেদের সাথে ঘটা ছোটো-ছোটো অন্যায়ের বিরূদ্ধে স্বাক্ষী দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো।
আজ আসামির ক্রস একজামিন হবে৷ আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত৷ আমাদের পক্ষের উকিল একের পর এক প্রশ্ন করছেন আসামিকে। স্যার সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। আমার মেয়েকে প্রশ্ন করা হলো৷ স্বাক্ষীদের প্রশ্ন করা হলো। সবার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণের পর আদালত থেকে রায় ঘোষণা করা হলো। জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করার জন্য সেই শিক্ষকের সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডের রায় হলো।
আমার মেয়ের আজ জয় হলো। আমার মেয়ের পাশে আজ সবাই আছে। মা হিসাবে একটু শক্তি দিয়েছি, আমার মেয়ে বাকিটা পেরেছে। আমি কাঁদছি। আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে। আমার স্বামী আমাকে বললো, আজ তো আমার আনন্দের দিন, আমি কাঁদছি কেন? আমি বলতে পারবো না। কাউকে পারবো না।
আমার চোখের সামনে ভাসছে একটা সন্ধ্যা। আমার বয়স তখন পনেরো বছর৷ দশম শ্রেণির ছাত্রী। ঘুরতে গেলাম মামা বাড়ি। সন্ধ্যায় গ্রামের হাট দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা হলে আমার বড়ো আপার স্বামী আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। সাইকেলে করে ফিরছিলাম। গ্রামের রাস্তা সন্ধ্যার পর বেশ ফাঁকাই থাকে। ফাঁকা রাস্তায় দুলাভাই আমার শরীরে হাত রাখলেন। এই কথা আমি কাউকেই বলতে পারিনি। মা,বাবা, আপা কাউকেই না। জীবন থেকে এই সন্ধ্যার অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করেছি বারবার।
তবে আজ আমি মুক্তি পেয়েছি। মনের ভেতরের বন্ধ দরজাটা আজ খুলে গেল। একটা নতুন আলোর স্পর্শ পেলাম…।
লেখা: Esrat Emu.
Send private message to author





