তিন দিন ধরে জ্বরে ভোগার পর অরুণার স্বামী মারা গেল আজকে বিকেলে। অরুণার মাথায় তারপরেই যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। যতটা না স্বামীর শোকে,তার চেয়ে বেশি ছোট ভাই সুবলের জন্য। সুবলের বয়স এখনো ছয় পেরোয় নি।আসলে বাবা মা মারা যাবার পর অরুণাই সুবলকে আগলে রেখেছে মায়ের স্নেহ দিয়ে।দিদির শ্বশুরবাড়িতে সুবলের অবস্থা যেন গাছের তুচ্ছ আগাছা,যাকে কেউ ছাঁটাই করেও ফেলতে পারছে না।শুধু দিদির জোরেই টিকে আছে সুবল এ বাড়িতে।তবুও প্রতিদিন উঠতে বসতে কম কথা শুনতে হয় নি ওকে।সেদিন তো সুবলের জামাইবাবু ওকে ভাঙা ছড়িটা দিয়ে…একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরুণা।আর কিছুই করার নেই তার।এবার ভাইকে বিধাতার হাতে ছেড়ে দেবার সময় এসে গেছে।অরুণার দুশ্চিন্তা একটাই, সুবল তার সম্মুখাগত এক সমুদ্র দুঃখ পাড়ি দিতে পারবে তো?
কান্নাকাটির পর্ব শেষ হলো যখন,তখন রাত্রি দুইপ্রহর।পশ্চিমের বারান্দায় লাশটা স্থির হয়ে পড়ে রয়েছে এখন।পাশে দুজন লোক বসে পাহারা দিচ্ছে লাশটাকে।কাল প্রভাতেই দাহ সম্পন্ন হবে।
আজকের রাতটা অদ্ভুত সুন্দর। আকাশের অজস্র তারকারাজি যেন যত্ন করে বুনন করা নকশি কাঁথার সুক্ষ্ম নকশা।ঝিঁঝিঁ পোকা ও পেঁচার সম্মিলিত ডাক নিস্তব্ধ রাতের বুকে যেন বিরহের কাব্য লিখছে।আর বাতাসের শব্দ সেই কাব্যের আবহ যোগান দিচ্ছে।
অরুণা সুবলকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।সুবল কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘুরে ওর দিদিকে বললো,”দিদি,তোর এই নাকফুলটা কী সুন্দর রে!গোলাপি মুক্তোটা অনেক দামি,তাই না দিদি?”
অরুণা একটু দম নিয়ে কাঁপা গলায় বললো,”হ্যাঁ,ভাই।ওটা অনেক দামি।তুই নিবি?”
সুবল ইতস্তত করে বললো,”না,না।ওটা তোর নাকেই ভীষণ মানায় রে।এই দিদি, তুই কি কাঁদছিস?”
অরুণা চোখ মুছে কান্না লুকোনোর চেষ্টা করে বললো,”না তো,কাঁদছি নে।”
সুবল বললো, “আমি যে স্পষ্ট দেখলুম,তুই কাঁদছিস!”
অরুণা কাঁপা গলায় বললো,”শোন ভাই,আমিও যদি মরে যাই, তুই একা একা থাকতে পারবি নে?”
সুবল এটা শুনেই ওর দিদিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো,”কী বলছিস এসব দিদি।তোকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকতে পারবো বল।আমি পারবোই নে।আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাস নে,দিদি।”
অরুণা কিছুটা হাসার ভঙ্গি করে বললো,”পাগল ছেলে!মরে গেলেই কি মানুষ দূরে চলে যায়? আকাশের তারা হয়ে সবসময় আমাদের দেখে।”
সুবল আগ্রহী গলায় বললো,”জামাইবাবুও কি আমাদের দেখছে দিদি?”
অরুণা বললো,”হ্যাঁ রে।দেখিস নি?আজ দক্ষিণের ওই বড় তালগাছটার মাথায় একটা নতুন তারা উঠেছে।ওটাই তোর জামাইবাবু রে।আচ্ছা শোন,আমিও যদি মরে যাই,আমি কিন্তু তোর ওই নিজের হাতে পোঁতা বকুলগাছটার ওপরের আকাশে থাকব।বুঝলি?”
সুবল অরুণাকে আরো জাপটে ধরে বললো,”দিদি এসব বলিস নে।আমার ভয় করে।”
অরুণা অভয় দিয়ে বললো,”ভয় পাস নে,ভাই।এখন ঘুমো।আমি তোকে বরং লালকমল আর নীলকমলের গল্প শোনাই।সে অনেককাল আগের কথা….”
দিদির কিন্নরী কণ্ঠে গল্প শুনতে শুনতে সুবলও যেন ডুবে গেল রূপকথার বিস্ময়কর জগতে,যেখানে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাক্ষস-খোক্কস আর সুবল যেন লালকমল হয়ে তাদের যুদ্ধে হারিয়ে দিচ্ছে।একসময় দুচোখ ভরে ঘুম নেমে এলো সুবলের।ঘুমিয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে ওর মনে হলো,দিদি যেন থর থর করে কাঁপছে! সুবল ঘুম জড়ানো গলাতেই ওর দিদিকে বললো,”দিদি, ভয় পাস নে।আমি লালকমল!রাক্ষস তোর কিচ্ছু করতে পারবে নে!”
অরুণা সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না।ওর শুধুই মনে হতে লাগলো,রাতটা ঝড়ের গতিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।আর সেই সাথে একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন ওকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে।বুকের ভেতর অনবরত হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ।
দেখতে দেখতেই রাত্রিমণির বিদায়কাল চলে এলো।ভোরের আলো তখনো ফোটে নি,পুবের জানলা দিয়ে ঘরে ভেসে আসছে হাড় হিম করা ঠাণ্ডা বাতাস। একটা দুটো রাতজাগা পাখিও ডাকছে থেকে থেকে।সারারাত না ঘুমিয়ে কেবলই দুচোখ ঘুমে বুজে এসেছে অরুণার,ঠিক এমন সময় ওর শ্বশুরমশাই এসে ডাকলেন,”বউমা এসো,সময় হয়েছে।”
একটু কেঁপে উঠলো অরুণা।সুবল ওকে এখনো ছোট্ট দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে।অরুণা একবার তাকালো ওর ঘুমন্ত মুখখানার দিকে।কী সুন্দর মুখ!ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির আস্তরণ,সাক্ষাৎ কার্তিক ঠাকুর যেন!একটা চুমু খেলো অরুণা সুবলের কপালে।তারপর কিছুক্ষণ ওর কোঁকড়া চুলে একটু বিলি কেটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে।দুচোখে আজ অন্ধকার সমুদ্রের ঢেউ নেমেছে অরুণার।সেই ঢেউ এর স্রোত গাল বেয়ে যেন পায়ের ওপর গিয়েও পড়ছে!
***
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই সুবল দেখলো, পাশে দিদি নেই।ও ভাবলো,নিশ্চয়ই এতক্ষণে দিদি রান্না-বান্না শুরু করেছে।চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। দেখলো,বিনিমাসির ছেলে টোকাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁতন করছে।সুবল টোকাইকে জিজ্ঞেস করলো,” দিদি কোথায় রে, টোকাইদা?”
টোকাই অবাক হয়ে বলল,”সেকী! তুই জানিস নে? বৌদিমণি তো জামাইবাবুর সাথে চিতেয় উঠেছে!”
সুবল বিভ্রান্ত হয়ে বলল,”মানে?”
টোকাই বললো,”কেন? তুই সতীদাহ বুঝিস নে? সতী মেয়েছেলের স্বামী মারা গেলে মৃত স্বামীর সাথেই চিতেয় উঠতে হয়।নইলে আবার কীসের সতী!”
টোকাইয়ের কথা শেষ না হতেই সুবল হঠাৎই উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে শুরু করলো।ওর মাথাটা অদ্ভুতভাবে ঘুরছে।চারপাশের সবকিছুকে মিথ্যে আর অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। সুবল শ্মশানে পৌঁছেই একবার চিৎকার করে ডাকলো,”দিদি….!”কোনো প্রত্যুত্তর নেই। কেবল নদীর ওপাড় থেকে ওর ডাকটাই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো এপাড়ে।আর সেই সাথে কতকগুলো গাঙচিল উড়ে গেল আকাশে। সুবল কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।তারপর হঠাৎ করেই খেয়াল করলো,শ্মশানের এক কোণে তাজা কিছু ছাই পড়ে রয়েছে।হালকা ধোঁয়াও বেরুচ্ছে সেখান থেকে।আনমনে ছাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল সে। তারপর এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।ছাইগুলো ওর দিদির?
আচ্ছা,দিদির দেহে তো প্রাণ ছিল,তারপরেও তাকে পুড়তে হলো কেন?দিদির ডাগর ডাগর চোখ দুটো নিশ্চয়ই অনেক কেঁদেছিল?
দিদির তো আপন বলতে সুবল ছাড়া কেউ ছিল না।একটা সমাজের সব মানুষ যখন চেয়েছিল,দিদি পুড়ে যাক,কেউ যখন চায় নি দিদি বাঁচুক,তখন এটা ভেবে দিদি কি অনেক ভয় পেয়েছিল? দিদির মাথার কালো মেঘের মতো লম্বা চুল,সেগুলোও কি আগুন পুড়িয়ে ফেলেছে?আগুন কি এতটাই শক্তিশালি যে একটা আস্ত মানুষকে পুড়িয়ে অদৃশ্য করে দিতে পারে?আচ্ছা, চামড়া পুড়ে গেলে নিশ্চয়ই অসম্ভব যন্ত্রণা হয়?দিদির গায়ের অমন ফরসা রঙ,আচ্ছা,চামড়া পুড়ে যাবার সময় দিদি নিশ্চয়ই অনেক চিৎকার করেছিল।করে নি?দিদিকে কেউ বাঁচালো না কেন?কী এমন দোষ করেছিল দিদি?সুবলের সমস্ত চিন্তাভাবনা লোপ পেতে শুরু করলো যেন।ও দেখলো,দূরের আমগাছটার ডালে বসে একটা কাক পাখি তারস্বরে চিৎকার করে ডাকছে।আমগাছ,দিদি আম খেতে বড্ড ভালোবাসতো!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সুবল ছাইয়ের এক কোণে ঘাসের ওপর কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখলো।অজান্তেই জিনিসটাকে হাতে তুলে নিল ও।সুবলের ডান হাতে দিদির গোলাপি রঙের মুক্তো বসানো নাকফুলটা সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে।ঠিক যেন সুবলের দিদি হাসছে ওকে দেখে!
______________
Nadim Satej
Send private message to author






আমরা যতটা না কল্পনা করতে পারি, বাস্তবতা হয়তো এক সময় তার থেকেও নির্মম ছিল। এরকম কত দিদি, শত কন্যার প্রাণ দিতে হয়েছে বিনা কারণে। তাদের গল্পগুলো হয়তো জানা হয়নি কারও।
…
লেখকের কলমে সমাজের সকল অসঙ্গতি ফুঁটে উঠুক, পৃথিবী হোক সুন্দরতর। এই কামনাই রইলো।
Ishmam ভাইয়া,অসংখ্য ধন্যবাদ। দোয়া করবেন আমার জন্য। আমার গল্পে এমন সুন্দর কমেন্ট পাব সত্যিই ভাবি নি।ভালোবাসা নেবেন।❤️