বিয়েটা অবশেষে ঠিক হয়েই গেল। পুরো বাড়িতে খুশির আমেজ। সোনার টুকরো পাত্র পেয়ে বাবা-মার মুখ থেকে হাসি সরছে না। আমিও কেন জানি মাঝে মাঝেই আনমনে হেসে ফেলছি, তারপর আবার লজ্জা পেয়ে টুক করে লুকিয়েও ফেলছি। দেখতে এসেছিল যখন, তখনকার মিনিট দশেকের আলাদা কথা বলার ফাঁকে কী জাদু করে ফেলল মানুষটা কে জানে!
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যেকোনো বিয়ের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন রকম মতামত থাকে। কারও এটা পছন্দ হয়নি, তাই বাদ দাও। কারও আবার কিছু পছন্দ না হলেও ঠিক আছে, দিয়ে দাও, সব তো মিলবে না। কিন্তু এ পাত্রের যেন সবকিছুই প্রশংসনীয়। মেজ চাচী তো ফোন করে সরাসরি আমাকেই বললেন, “রাজপুত্রের মতো বর পেয়ে গেলি, বুড়ি। সুখী হবি দেখিস”।
সব মিলিয়ে সবাই খুশি। আর তাদের সাথে আমিও। মানুষটা এক ফাঁকে হুট করে আমার নাম্বার চেয়ে ফেলেছিল। ততক্ষণে তার জাদুতে আমি বশীভূত। কিছু না ভেবেই নাম্বার দিয়ে দিয়েছিলাম। এখন নিজেকে বড্ড হ্যাংলা লাগছে। কারণ একটু পরই পরই আমার চোখ বাবাজিরা ফোনের দিকে ছুট দিচ্ছেন। ইশ! কী লজ্জার ব্যাপার।
রাত বাজে একটা। ফোনটা কাঁপছে। ঝট করে উঠে বসে দেখি অচেনা নাম্বার। তার নাম্বার জানা নেই, কিন্তু আমি শতভাগ নিশ্চিত, এই কল তারই। কারণ এরকম সময়ে কল দেয়ার মতো মানুষ আমার জীবনে কোনওদিন ছিলনা। ধরব কী ধরব না ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল। এবার নিজের উপর রাগ উঠল। উনি যদি আর কল না দেয়, তখন? কিন্তু না, উনি আবার কল দিয়েছেন। ফোনটা দ্বিতীয়বার কাঁপলে বুকের ভেতর বাজতে থাকা ড্রামটাকে ইগ্নোর করে রিসিভ করলাম।
চিরাচরিত অভ্যাস, অপরিচিত কলে আগে কথা বলিনা। আজও তাই করলাম। অপর পাশও দেখি চুপ। নিস্তব্ধতায় কেটে গেল পুরো একটা মিনিট। আমি নিশ্চিত এটা উনিই, তাও কেন কথা বলছেন না, এটা নিয়ে ভয়াবহ দুশ্চিন্তা হতে শুরু করল। শেষমেশ কল কেটে দিব ভাবছি যখন, তখন উনি পরিস্কার গলায় বলে উঠলেন, “আমি তামীম”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই কণ্ঠ শুনলাম আমি। একটা মানুষের সবকিছুই এত জাদুময় কেন হতে হবে? “জি, বলুন” আমি উত্তর দিলাম।
এরপর তিনি যা যা বললেন, তাতে আস্তে আস্তে ড্রামের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। মনের ভেতরে জ্বলে থাকা হাজার হাজার পুলক শিখা নিভে গিয়ে ছেয়ে গেল অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার। একদম প্রবল বর্ষণের আগে কালো মেঘে ঢাকা আকাশের মতো। ওপাশ থেকে ফোন কেটে দেয়ার পরেও আমি স্থানুর মতো বসে রইলাম। তারপর শুরু হলো বর্ষণ, প্রবল বর্ষণ।
আমাদের বাড়িতে আজ সকাল হয়েছে জলদি জলদি। বিয়ে মাত্র দুসপ্তাহ পর, তাই তোড়জোড় এখন থেকেই শুরু হবে, এ আর আশ্চর্য কী। আমিও অনেকক্ষণ হয় উঠেছি, কিন্তু বাইরে বেরোইনি। এই বিয়ে বিয়ে আমেজটা আরেকটু থাক, আর একটুখানি। তারপরেই তো সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু একটু বাদেই বাইরে সবার হাসি-কথার আওয়াজ আমার অসহ্য লাগতে লাগল। একবার যেন আব্বুকে দুলাইন গানও গাইতে শুনলাম। থমথমে মুখ নিয়ে বাইরে এলাম। আম্মুকে ডাকলাম, বললাম যে কিছু কথা আছে।
যতটা নরম স্বরে আর সহানুভূতির সাথে একটা মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধির কথা বলা যায়, আমি বললাম। আম্মুর চেহারা প্রথমে অবিশ্বাসে ফ্যাকাশে আর তারপর রাগে লাল হয়ে যেতে দেখলাম। ছেলেপক্ষের এহেন ঠকবাজি করার সাহস হলো কী করে, এমন কিছু একটা বলে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যা ভেবেছিলাম তাই। তুলকালাম শুরু হয়ে গেল বাসায়। আমি জানতাম, যে ছেলের কিডনী সমস্যা আছে, সপ্তাহে তিনটা ডায়ালাইসিস নিতে হয়, তার সাথে বংশের একমাত্র মেয়ের বিয়ে আমার ফ্যামিলি কোনভাবেই দিতে রাজি হবেনা। আমি চুপচাপ শুয়ে চোখ মুছতে লাগলাম। বেহায়া চোখ আর তার পানি। সারারাত ঝরেও তাদের সাধ মেটেনি যেন!
বিয়েটা ভেঙে গেল। অবশ্য লজ্জার মাথা খেয়ে একবার নিজের মত জানাতে গিয়েছিলাম যে, আমার এতে কোন অসুবিধা নেই। এই অসুখ তো বিয়ের পরেও ধরা পড়তে পারতো। আর উনি অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ বলেই ফ্যামিলির নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাকে জানিয়েছেন, আমাকে ধোঁকা দিতে চাননি। কিন্তু সবার দৃষ্টি দেখে মনে হলো আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কারণ এতক্ষণে তারা পাত্রপক্ষের আসল উদ্দেশ্য ধরে ফেলেছেন। ওরা কেন বারবার জিজ্ঞেস করে আমার ব্লাড গ্রুপ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে, এটা এখন পরিস্কার। নিশ্চয়ই ওরা বিয়ের পর আমাকে কিডনি দিতে বাধ্য করতো। আমি আর কিছু বলতে পারিনি, কারণ কথাটা সত্য। উনি আমাকে এটাও বলেছেন, “আপনার শরীরে আমার জন্য কাটাছেঁড়া করা হোক, এটা আমার ভালো লাগবে না। তবে থেকে থেকে ভেতরে একটা লোভ জেগে উঠছে, জানেন। বড্ড ইচ্ছে করছে, শেষ নিঃশ্বাসের সময় যে হাতদুটো আমার হাত ধরে রাখবে, সেগুলো আপনার হোক। এ অন্যায় লোভের জন্য আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন” আমি সবার কাছে এটা লুকিয়ে গেছি। কারণ আমার খালি মনে হচ্ছিল, একটা কিডনিই তো, উনাকে দিলে যদি উনি সুস্থ হয়ে যান, তাহলে ক্ষতি কী? আর কত সামান্য একটা লোভ! শেষ মুহূর্তে আমার হাতদুটো ধরে থাকার লোভ।
আমার ঘুম ভীষণ পাতলা। পাশ থেকে আনাস যত নিঃশব্দেই উঠে ওয়াশরুমে যাক না কেন, আমি টের পেয়ে যাই। আজও তাই হয়েছে। তাই বেডসাইড টেবিলে থাকা ফোনের ভাইব্রেশনও বুঝতে পারলাম। ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেল। ছোট ভাই নিরবের ফোন। এত রাতে? কোন বিপদ আপদ হয়নি তো। বুকের ভেতর ড্রাম আজকেও বাজছিল। তবে উত্তেজনায় নয়, আশঙ্কায়।
“হ্যালো” কণ্ঠে উৎকণ্ঠা চাপিয়ে রাখতে পারলাম না।
“আপু, তামীম ভাইয়া……. নেই। এই একটু আগে খবর পেলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল রে আপু। এত রাতে আর কাউকে বলতে পারছিলাম না, তাই তোকে ফোন দিলাম” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলছিল নিরব। আমার মতো ওরও তামীমকে খুব ভালো লেগেছিল। তাই বিয়ে ভেঙে গেলেও সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যোগাযোগ রেখে দিয়েছিল।
এই এক বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। অন্যত্র আমার বিয়ে হয়েছে, আনাসকে আমি ভীষণ ভালোওবাসি। আর একই সাথে আমি অনেক কিছু শিখেও গিয়েছি। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় ইন্না-লিল্লাহ পাঠ করে ভাইকে সান্ত্বনা দিলাম।
কিন্তু ফোনটা কেটে দেয়ার পর বুঝতে পারলাম, বুকের অনেক গভীরে, যেখানকার নাগাল পৃথিবীর অন্য কারও পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে কিছু একটা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। কারণ এই মুহূর্তে আমার গোটা দুনিয়া থমকে গেছে। সেই সেদিনের মতো অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ। সবকিছু ছাপিয়ে বর্ষাতে চাইছে প্রাণপণে। ছিটকিনির শব্দ হতেই শুয়ে পড়লাম। কিন্তু আনাস এসে পাশে শুতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কোনভাবেই সেই কান্না থামছিল না। এত কান্না আমি সেই সেদিন কেঁদেছিলাম।
আনাস ভাবল আমি কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছি। পরম মমতায় পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। খানিকক্ষণ বাদে কান্নার ভাঁজে একটা কথাই শুধু বলতে পারলাম, “আমাকে ফেলে কোনদিন চলে যেওনা প্লিজ, আমি মরে যাব”
এতদিন আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করতাম, উনি তো শুধু আমাকে বলেছিলেন, আমি সবার কাছে লুকিয়ে গেলাম না কেন? আজ বুঝলাম, আমি প্রচণ্ড ভীতু প্রকৃতির মেয়ে। ওইদিন না একাকী অতবড় সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস আমার ছিল, আর না ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখার। কে জানে, শেষ মুহূর্তে কেউ উনার হাত দুটো ধরে রেখেছিল কি-না।
(সমাপ্ত)







হুট করে এই যে ভালো লেগে যাওয়া আর এক ঝলকেই কাউকে ভালোবেসে ফেলে এটা অনেকের কাছেই বেশ অবাকদায়ক ঘটনা। তবে যার জিবনে এমনটা ঘটেছে সেই জানে আসলে এরকম ভালোবাসা কতটা সত্য হয়। আর সে মানুষটিকে না পাওয়ার শুন্যতা যে কতটা ভয়ানক হয় সেটা বুঝবার ক্ষমতাও বোধ হয় কারোর নেই। লেখক ধন্যবাদ এত সুন্দর করে পুরো গল্পটিতে সেই অনুভূতিটা ফুটিয়ে তোলার জন্য। <3
অসংখ্য ধন্যবাদ ❤️