গ্রানাইটের বড় পাথরটার ওপর বসে আকাশ দেখছিল সায়ান। লালচে কালো রঙের এরকম আকাশ দেখলে যে কারোরই মন খারাপ হবে।কিন্তু সায়ানের বিন্দুমাত্রও মন খারাপ হয় না।কারণ,তার হৃদয়ে মন খারাপ হবার অনুভূতির যে ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট ছিল একসময়,তা গত দশ বছরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এই “এটেন” গ্রহে দশ বছর নিঃসঙ্গ বসবাসকারী সায়ানের নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল বিষণ্নতা।অবশ্য পুরোপুরি নিঃসঙ্গ বলা যায় না তাকে।কারণ সায়ানের দেখাশোনা করার জন্য একটা দ্বিতীয় মাত্রার রোবট “কাইরা” তার সাথে থাকে।কিন্তু সে তো যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়।বিষণ্নতা আর একাকীত্বের সাথে দিন কাটাতে কাটাতে সায়ানও যেন প্রায় যান্ত্রিক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে শুধু যখন মা-বাবার কথা মনে পড়ে,তখন তার বুকের মধ্যে আবির্ভাব ঘটে গভীরতর শুন্যতার,যে শুন্যতা ধীরে ধীরে তার সমস্ত অনুভূতিকেই যেন হৃদয় থেকে মুছে ফেলে দেয়।সায়ান এই গ্রহে কীভাবে এসেছে,কেন এসেছে তার কোনোকিছুই মনে করতে পারে না।সে শুধু জানে,তাকে এখানে এভাবেই একাকীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে মৃত্যু অবধি।
এটেন গ্রহে কখনো দিন হয় না।শুধু ঘণ্টাখানেক সারা আকাশ লাল হয়ে থাকে।সেই সময় চারপাশের সবকিছু রক্তের মতো মনে হয়।আবার রাতও যে সারাক্ষণ থাকে,সেটাও বলা যায় না।তবে অন্ধকার থাকে।সে অন্ধকারও গভীর নয়।হালকা মন খারাপ করা ফ্যাকাশে অন্ধকার।
সায়ান দেখলো,লালচে কালো আকাশটা ক্রমশ গাঢ় বেগুনি রঙ ধারণ করছে।সে উঠে দাঁড়ালো। তারপর হাঁটতে শুরু করলো তার আবাসের দিকে। ঝড় উঠে আসছে।দ্রুত ফিরতে হবে তাকে।
সায়ান তার আবাসে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিল।কাইরা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে।গৃহস্থালি সকল কাজকর্মতে সে ভীষণ দক্ষ।কাইরা আজ বানিয়েছে যবের রুটি,স্ট্রবেরি ফলের রস আর কৃত্রিম মাংসের ফ্রাই।খাওয়ার ব্যাপারটা সায়ানের একদম ভালো লাগে না। তাই দ্রুত খাওয়া শেষ করলো সে।তারপর কাইরার সাথে কথা বলতে শুরু করলো।
“খাবারের জন্য ধন্যবাদ,কাইরা।”
কাইরা নির্বিকার গলায় উত্তর দিলো,”মহামান্য সায়ান,আপনার কথা শুনে খুশি হলাম।”
সায়ান বিরক্তির স্বরে বললো,”তোমার তো খুশি হবার অনুভূতি নেই,কাইরা।এরকম নির্বোধ ধরনের কথা আমার সামনে বলবে না।”
কাইরা বললো,”ঠিক আছে,মহামান্য।তবে আপনিও নিশ্চয়ই জানেন,কোন কথাটা নির্বোধের মতো সেটাও আমার পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব নয়।”
সায়ান বললো,”তুমি অনুভূতি প্রকাশক কোনো কথা আমার সামনে বলবে না।যাই হোক,আমি একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই,কাইরা।”
কাইরা বললো”কোন বিষয় মহামান্য, বলুন।”
সায়ান বললো,”আমি কেন ওই গ্রানাইট পাথরটা পেরিয়ে সামনে যেতে পারি না?আমার মনে হয়, ওখানে কীসের যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়েছে,যেটাতে বাধা পেয়ে আমাকে বারবার ফিরে আসতে হয় ।এটা নিয়ে তুমি কি একটু খোলাসা করে বলতে পারবে?”
কাইরা বললো,”জি,মহামান্য,পারবো।আপনাকে আমি সত্যটা সম্পর্কেই অবগত করব।ইতোপূর্বে ৩,৮৯,২৫৪ বার আমি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি।”
সায়ান বললো,”নির্বোধের মতো কথা বোলো না।এই গ্রহে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।কতজন আর কারা তোমাকে এই বিষয়ে এতবার জিজ্ঞেস করেছে,কাইরা?”
কাইরা বললো,”আপনিই করেছেন,মহামান্য!”
সায়ান চোখ কপালে তুলে বললো,”আমি?!”
কাইরা বললো,”জি,মহামান্য,আপনি।”
সায়ান অবিশ্বাসের গলায় বললো,”তাহলে আমার মনে নেই কেন?মিথ্যে বলছো না তো?”
কাইরা স্বাভবিক গলায় বললো,”না,মহামান্য।আপনি খুব ভালো করেই জানেন দ্বিতীয় মাত্রার রোবটদের মিথ্যে বলার ক্ষমতা দেওয়া হয় নি।”
সায়ান বললো,”সেটাও অবশ্য ঠিক।কিন্তু তোমার কথা এই মুহূর্তে বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।আর তুমি আমার প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে কেন?উত্তর দাও।”
কাইরা বললো,”আপনার মনে নেই কারণ,ওরা আপনার সমস্ত স্মৃতি মুছে দিয়েছে।”
সায়ান ঠাণ্ডা গলায় বললো,”কারা?”
কাইরা বললো,”এ বিষয়ে আমার তথ্য ভাণ্ডারে কোনো তথ্য নেই।আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।”
হঠাৎই কোনো একটা বিচিত্র কারণে মা-বাবার মুখটা ভেসে উঠলো সায়ানের চোখে। মা-বাবার স্মৃতিগুলো ওরা মুছে দেয় নি কেন? সায়ান ব্যাকুল হয়ে বলল,”আমি আমার মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে চাই,কাইরা।দশ বছর কাটিয়েছি এখানে। আর না।”
কাইরা বললো,”মহামান্য সায়ান,আমি অত্যন্ত দুঃখিত।আপনার মা বাবা কেউ নেই।আপনি এতিমখানায় বড় হয়েছেন।আপনাকে যারা এখানে পাঠিয়েছে,তারাই আপনার মস্তিষ্কে তাদের মনমতো কিছু স্মৃতি তৈরি করে দিয়েছে।আপনার ধারণা যে,আপনি এটেন গ্রহে দশ বছর ধরে বসবাস করছেন।কিন্তু এই তথ্যটি সঠিক নয়।আপনি অনন্তকাল ধরে এখানে রয়েছেন।সেই হিসাবটা আপনাকে জানিয়ে নতুন করে কষ্ট দিতে চাই না আমি।”
সায়ান গলা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললো,”আমি জানতে চাই হিসাবটা, কাইরা।আমার স্মৃতি তো সব মুছে ফেলা হবে,তাই না?কাজেই,কষ্ট পাই বা না পাই সেটাতে কিছু যায় আসে না।”
কাইরা বললো,”ঠিক আছে মহামান্য,আমি বলছি।আপনি এখানে পনেরো হাজার বছর দুই মাস,তের দিন,দশ ঘণ্টা,বায়ান্ন মিনিট,তিন সেকেন্ড ধরে আছেন।”
সায়ানের সমস্ত শরীর যেন অসার হয়ে গেল।সে কাঁপা গলায় বললো,”আমি এতদিন বেঁচে আছি কীভাবে?মারা যাই নি কেন?”
কাইরা বললো,” মহামান্য,আপনি কখনো মরবেন না।ওরা আপনার মৃত্যুকে থামিয়ে দিয়েছে।মৃত্যু ওদের কাছে খুবই তুচ্ছ একটি বিষয়!”
সায়ান একদম পাথরের মত বসে রইল কিছুক্ষণ।ও খেয়াল করলো,ঝড় শুরু হয়েছে বাইরে।আর হঠাৎ করেই ভীষণ ঘুম ওর চোখে নেমে আসতে শুরু করেছে যেন।
ঘুমের অতলে তলিয়ে যাবার মুহূর্তে সায়ান শুনতে পেল, কাইরা যান্ত্রিক গলায় বলছে,”ঘুমিয়ে পড়ুন,মহামান্য।ওরা আপনার স্মৃতি মুছে দিতে শুরু করেছে!”
***
চতুর্থ মাত্রার বুদ্ধিমান রোবট “নেলন” আজ প্রথমবার মানব চিড়িয়াখানা পরিদর্শনে এসেছে। দশম মাত্রার অতিবুদ্ধিমান রোবটেরা এটি গড়ে তুলেছে। চিড়িয়াখানাটির বিশেষত্ব হচ্ছে,এর ৫০টা সেক্টর রয়েছে,যেগুলো ৫০টা গ্রহের আদলে তৈরি।সেসব গ্রহে একজন করে মানুষ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।এবং তাদের দেখাশোনা করার জন্য দেওয়া হয়েছে একটি করে দ্বিতীয় মাত্রার বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট।মানুষের নিঃসঙ্গতা এ যুগের বুদ্ধিমান রোবটদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম।শুধু তাই নয়, এই বিষয়টি নিয়ে একটা প্রজেক্ট বানিয়ে জাতীয় রোবট কাউন্সিলে জমা দিলে নেলনকে পঞ্চম মাত্রায় আপডেট করে দেওয়া হবে!
নেলন এই মুহূর্তে চিড়িয়াখানার তিন নম্বর সেক্টরে প্রবেশ করছে।এই সেক্টরটি এটেন নামক একটি গ্রহের আদলে বানানো হয়েছে। নেলন দেখলো,একটা বাদামি চুলের সুদর্শন ছেলে তার আবাসে বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে।বিছানার পাশেই চেয়ারে বসে একটা দ্বিতীয় মাত্রার রোবট নিজেকে চার্জ করছে। গাইড রোবটটি নেলনকে জানালো, ঘুমন্ত ছেলেটির নাম সায়ান!
নেলন ঠিক করলো, একে নিয়েই সে তার প্রজেক্টটা বানাবে!
মানুষের খামখেয়ালিপূর্ণ রাজত্ব অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।রোবটেরা পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছে শান্তি আর শৃঙ্খলা।
____________
Nadim Satej







গল্পটা সুন্দর। কিছুটা ভয়ও পাবার মতন। আসলেই যদি একদিন আমরা রোবটের হাতে বন্দি হয়ে যাই।
তবে একটা ছোট্ট কিন্তু আছে। সেটা হল, রোবটের যদি আবেগ না থাকে, তাহলে তো তাদের “বিনোদন” পাবার ক্ষমতাও থাকার নয়।
ধন্যবাদ ভাইয়া,মন্তব্যের জন্য। আর এত ভালোভাবে পড়বার জন্য❤️
যে ব্যাপারটা আপনার নজরে এসেছে, সেটার উদ্দেশ্যে বলি,
“মানুষের নিঃসঙ্গতা এ যুগের বুদ্ধিমান রোবটদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম।” এই যে এখানে, “এ যুগের বুদ্ধিমান রোবট” দিয়ে উন্নত রোবট প্রজাতি বুঝিয়েছি। একটু উপরে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, দশম মাত্রার অতিবুদ্ধিমান রোবটেরা এই চিড়িয়াখানা বানিয়েছে। কাজেই পরোক্ষভাবে তাদের বোঝানো হচ্ছে। এই যে মাত্রা দেওয়া হচ্ছে,এটা রোবটের দক্ষতা,বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করে। তো যারা দশম মাত্রার রোবট তারা অতিবুদ্ধিমান কারণ তাদের অনুভূতি ক্ষমতা আছে। রোবট সে যত বুদ্ধিমান হোক,তাকে মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান হতে হবে। আর সেটা হবার জন্য তাদের আগে মানুষের সমকক্ষ হতে হবে। সমকক্ষ হতে গেলে, মানুষের মতো অনুভূতিও তাদের আনতে হবে। যেহেতু ছোটগল্প তাই এতকিছু খোলাসা করি নি। আপনার ব্যাপারটায় খটকা লেগেছে দেখে খুশি হলাম❤️