ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরে পোশাক পরিবর্তন করবেন ঠিক এমন সময় আবুল বাশারের মোবাইলটা বেজে ওঠল। দীর্ঘসময় ডিউটি করার পর এখন একটু বিশ্রামের সময়ে ফোন আসাটা বিরক্তির হতে পারতো। কিন্তু তিনি বিরক্ত হলেন না। বরং খুশি হলেন। কারণ তাঁর মেয়ে হালিমা ফোন করেছে। আবুল বাশার রিসিভ করলেন।
‘হ্যাঁ মা, কেমন আছিস?’
‘ভালো আছি আব্বা। তুমি কেমন আছ?’
‘আমি ভালো। তোর জামাই, শ্বশুর-শ্বাশুরি সবাই ভালো আছে তো?’
‘সবাই ভালো আছে। আব্বা একটা কথা ছিল।’
‘তো বল! অনুমতি নিয়ে বলবি নাকি?’
হালিমা প্রায় কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, ‘আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইফতারি দিতে বলছে।’
‘তো কাঁদস ক্যান? ইফতারি তো দিব।’
‘কিন্তু…’
‘কোনো কিন্তু না। সমাজে এখন এটা তো একটা প্রথা হয়ে গেছে। রমজান এলে, কোরবান এলে এবং বিভিন্ন কিছুকে উপলক্ষ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে অনেক কিছু দিতে হয়। আমাকে একটু সময় দে, আমি ইফতারি নিয়ে যাব। তুই চিন্তা করিস না।’ বলে ফোন রাখলেন।
কয়েকমাস আগে বিশিষ্ট শিল্পপতি বাবুল তালুকদারের ছোট ছেলে রবিন তালুকদারের সাথে হালিমার বিয়ে হয়েছিল। হালিমার অসম্ভব সৌন্দর্য দেখে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল রবিন। আবুল বাশার এমন নামকরা একজন শিল্পপতির ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিতে ‘না’ করেননি। চোখ বন্ধ করে প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন এবং মেয়েটাকে তোলে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মেয়েটা সেখানে সুখে থাকবে। কিন্তু আজকে হালিমার কান্না আবুল বাশারের মনে বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়ে দিলো। তিনি ভাবছেন, ‘এমন পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি সেখানে ইফতারির জন্য মেয়েকে কী এমন বলেছে যার জন্য কান্নাও করছে!’ কিন্তু এসব বেশিক্ষণ ভাবতে পারলেন না। পায়ের প্রচন্ডরকম ব্যথা তাকে গরম পানির কথা মনে করিয়ে দিলো। র্দীঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ডিউটি করার পর পায়ের অবস্থা কেমন হয় তা যারা দাঁড়িয়ে ডিউটি করেন তারাই ভালো জানেন। তিনি গরম পানি ঢালতে গেলেন।
পায়ে গরম পানি ঢালার পর পা একটু শান্তি হয়। পা শান্তি হলেও আবুল বাশারের মন শান্তি হয় না। ইফতারি দিতে অনেক টাকা খরচ। তাঁর কাছে জমানো টাকা নেই। একজন ট্রাফিক পুলিশ তিনি। শুধু ট্রাফিক পুলিশ বললে অন্যায় হয়ে যাবে। সৎ ট্রাফিক পুলিশ বলতেই হবে। কারণ অসৎ পথে পা বাড়িয়ে বেতনের কয়েকগুণ টাকা উপার্জন করার সুযোগ থাকলেও তিনি তা করেন না। যা মাইনে পান তা দিয়েই চলেন। মাস শেষে জমার অঙ্কটা শূন্যতে থাকে। কিন্তু ইফতারি দিতেই হবে। তিনি বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকেন। ভাবনার জগতে হারিয়ে যান। কিন্তু কোনো পথই যেন খোলা পাচ্ছেন না। কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত নয় মাস কষ্ট করে টাকা জমিয়ে বউকে উপহার দেওয়া গলার হারটা বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সিদ্ধান্ত নিতেও তাঁর পাঁজরে এসে স্থান করে নিল কতশত কষ্ট। কিন্তু কিছু করার নেই। মেয়ের মুখের একটু হাসির জন্য বাবারা পারেন না এমন কিছু নেই। সকালে ওঠে বাজারে গিয়ে হারটা সোনাদানার দোকানে বিক্রি করে যা পাবেন তা দিয়ে হালিমার শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি নিয়ে যাবেন। এসব কতকিছু ভাবতে ভাবতে চোখের কোণায় জল রেখে কোনো এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন আবুল বাশার।
‘হালিমার মা, আলমারির চাবিটা দাও তো।’ সকালে ঘুম থেকে ওঠে স্ত্রী মাবিয়ার কাছে আলমারির চাবি চাইলেন আবুল বাশার ।
‘তোমার কাপড় তো আলমারিতে নেই।’ জবাব দিলো মাবিয়া।
‘না না, কাপড়ের জন্য না। হারটা লাগবে। বেচতে হবে।’
হার বেচার কথা শুনে মাবিয়ার বুকটা কেঁপে ওঠল। আবুল বাশার হারটা উপহার দিয়েছেন বেশিদিন হয়নি। মাবিয়া হারটা একবারও পরেনি এখনও। মাবিয়া কেবল চুপ করে রইল।
মাবিয়ার চুপ থাকা দেখে আবুল বাশার বললেন, ‘হালিমার শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দিতে হবে। হারটা বেচতে হবে। তুত্ তুমি আমাকে চাবি দাও।’
মাবিয়া আঁচলে বাঁধা চাবিটা নিয়ে আবুল বাশারের হাতে দিলো। আবুল বাশার আলমারি খুলে হারটা নিয়ে মাবিয়ার কাধে হাত রেখে ‘এই হার আমাদের মেয়ের মুখের হাসির চেয়ে দামি নয়। রাগ করো না। আমি আসি।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পা চালাতে লাগলেন বাজারের দিকে।
হারটা সোনাদানার দোকানে বেচে দিলেন আবুল বাশার। বেশ কিছু টাকা হাতে পেলেন। একমুহূর্তও দেরি না করে নানারকম ইফতারি কিনতে তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়ের শ্বশুরবাড়ির অযোক্তিক দাবি মেনে নিয়ে যদি মেয়েটাকে ভালো রাখা যায! যদি একটু শান্তিতে রাখা যায়! তাই আবুল বাশারের এত তাড়াহুড়ো।
ইফতারি কেনা শেষ করে সবগুলো নিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা দিলেন আবুল বাশার। গাড়ি চলছে। গাড়িতে বসে তাঁর বার বার মাবিয়ার কথা পড়ে পড়ছে। ‘বেচারির কত সখ ছিল! একটাবার পরতেও পারল না। মেয়ের সুখের জন্য বেচে দিতে হলো।’ গাড়ির মধ্যে এমন কতশত কথা ভাবতে ভাবতে একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামে। অনেক উঁচু বাড়ি। নিচ থেকে উপরে তাকাতে হলে মাথাটা ৪৫ ডিগ্রি বাঁকা করতে হবে। এটাই হালিমার শ্বশুরবাড়ি। আবুল বাশার ইফতারি নিয়ে দরজার সামনে গিয়ে কলিংবেলে চাপ দিলেন। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। কলিংবেলে চাপ দেওয়ার সাথে সাথেই একজন শ্যামবর্ণের নারী দরজা খুলে দিলো। সে ঘরের কাজের মেয়ে রহিমা।
‘আপামনি, দেহেন ক্যাডা আইছে।’ দরজা খুলে আবুল বাশারকে দেখে হালিমাকে ডাক দিলো রহিমা।
হালিমা তখন যান্ত্রিক স্বর্গীয় রুমে বসে জাহান্নামের কষ্ট অনুভব করছিল। রহিমার অস্তিরতা মাখা ডাকে হালিমা দ্রুত ড্রইং রুমে এলো। এসেই সে চমকে গেল আর ‘আব্বা তুমি?’ বলে আবুল বাশারকে জড়িয়ে ধরল। বাবাকে দেখে হালিমা বেশ খুশি হয়েছে। মেয়েকে দেখে বাবার মুখেও হাসি থাকার কথা। কিন্তু আবুল বাশারের মুখে হাসি নেই। সে মেয়ের চেহেরা দেখে বুঝল মেয়েটা এখানে মোটেও ভালো নেই। তবুও কোনোভাবে হাসির অভিনয় করে বললেন, ‘হ মা আমি। এইমাত্র এলাম।’
‘তুমি কিছু না বলে, না জানিয়ে চলে এলে যে?’
‘ক্যান মা? আমি আমার মেয়ের কাছে না জানিয়ে আসতে পারি না?’
‘তা না আব্বা। তুমি আসবে জানলে অনেক কিছুর আয়োজন করতাম। কত খুশি হতে তুমি!’
‘মা রে, বাপের কাছে মেয়েকে দেখতে পারার মত সুখ আর কিছু নেই। আয়োজনে না, আমি তোরে দেখেলেই খুশি থাকি।’
‘আচ্ছা তুমি বস, আমি আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।’ বলে বাবুল তালুকদারকে ডাকতে ভেতরে গেল হালিমা। বাবুল তালুকদার তখন নিজ শয়নকক্ষে ইজি চেয়ারে বসে ঢুলছিলেন। হালিমা অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে তার বাবা আসার ব্যাপারটা বাবুল তালুকদারকে জানাল। বাবুল তালুকদার অতটা খুশি হলেন না।কোনোরকম ইজি চেয়ার থেকে ওঠে শয়নকক্ষ থেকে বের হয়ে আবুল বাশারের কাছে এলেন। দুই বেহাই করমর্দন করলেন। আবুল বাশার কোলাকুলি করতে চাইলেন। কিন্তু বাবুল তালুকদার ‘আরে এসবের কী দরকার?’ বলে কোলাকুলি করতে অনিহা প্রকাশ করেন এবং একটা লম্বা সোফায় পা তোলে বসে পড়লেন। আবুল বাশারও পাশে গিয়ে বসলেন।
‘আরে এখানে বসছেন কেন বেহাই?’
‘আপনার সাথে কথা বলব, আড্ডা দিব তাই পাশেই বসলাম।’
‘আসলে এই সোফায় আমি ছাড়া কেউ বসে না। শুধু আমিই বসি। অই যে সোফাটায় গিয়ে বসেন। কাছেই তো। কথা বলা যাবে। যান।’
আবুল বাশার সেই সোফা থেকে ওঠে সামনে থাকা সোফাটায় গিয়ে বসলেন। বাবুল তালুকদারের এমন আচরণ তাঁর কাছে মোটেও ভালো লাগল না। বাবুল তালুকদারের সাথে কথা বলার সেই ইচ্ছা তাঁর আর নেই। আবুল বাশার হালিমাকে ডাকলেন। বাবার ডাকে হালিমা রান্নাঘর ধেকে ড্রইং রুমে এলো।
‘মা, আমি চলে যাব।’ হালিমাকে বললেন আবুল বাশার।
‘ক্যান আব্বা? রোজা রেখে কত দূর থেকে মাত্র এলে। চলে যাবা ক্যান?’
‘যেতে হবে মা। আজকে অফিসে ইফতার হবে। সবাই থাকবে। আমাকেও থাকতে হবে। না থাকলে সমস্যা হবে। আমি আসি।’ বলে বাবুল তালুকদারকে সালাম দিয়ে বুকভরা কষ্ট নিয়ে আবুল বাশার বেরিয়ে গেলেন। হালিমা আর কিছুই বলল না। বাপের দিকে চেয়ে চেয়ে কেবল অশ্রুপাত করল। তার কিছু বলারও নেই।
ক্লান্তিতে আবুল বাশারের শরীর কাঁপছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা যেন প্রচন্ড বেগে ঘুরছে। তাড়াতাড়ি একটা টিকিট কেটে বাসে ওঠে গেলেন। সাথে এক বোতল পানিও নিলেন।
বাস এগোচ্ছে। কিন্তু আবুল বাশারের জন্য সময় এগোচ্ছে না। বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলেন। বাবুল তালুকদারের আচরণে বেশ কষ্ট পেয়েছেন তিনি। বাবুল তালুকদার ডজনখানেক ফ্যাক্টরির মালিক আর তিনি একজন ট্রাফিক পুলিশ বলে তাঁর সাথে কোলাকুলি করলেন না। পাশে বসতে দিলেন না। সেসব মনে পড়লে আবুল বাশারের ভেতরের জ্বালাটা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তখন তিনি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেন, ‘সব শিল্পপতি, কোটিপতি-ই কি এমন?’ এসব অনেক কিছুই ভাবতে ভাবতে চারিদিক থেকে আজানের ধ্বনি তাঁর কানে এসে জানান দিলো ইফতারের সময় হয়েছে। আবুল বাশার বোতলের ঢাকনাটা খুলে “আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ও‘য়ালা-রিজক্বিকা আফতারতু” দোয়াটি পড়ে কয়েক ঢোক পানি গিলে নিলেন। পাশের সিট থেকে ষোল কি সতেরো বছরের একটা মেয়ে আবুল বাশারের দিকে তাকিয়ে আছে। আবুল বাশারকে শুধু পানি দিয়ে ইফতার করতে দেখে তাঁর দিকে একটা বন এগিয়ে দিয়ে বেশ মিষ্টি গলায় বলল, ‘আংকেল, নেন। এটা খান।’
আবুল বাশার বনটা হাতে নিয়ে দুই কামড়ে খেয়ে নিলেন। এটাই যেন তাঁর জীবনের সেরা ইফতার। টিকিটে এবং টিকিট কাউন্টারে লেখা থাকে, ‘গাড়িতে অপরিচিত কেউ কিছু দিলে খাবেন না।’ কিন্তু আবুল বাশার খেয়ে নিলেন। তিনি মনে করেন, ‘মানুষকে যে ইফতার করায় তাঁর কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।’
এদিকে হালিমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন হালিমাকে নানান কথা শোনাতে থাকে। ইফতারি যা দিয়েছে তা অনেক কম হয়েছে বলে দাবি করে। বাবুল তালুকদারও মুখ খুললেন। তিনি হালিমাকে ডেকে বললেন, ‘কিরে বউমা, তোমার বাপ ফকিরকে ভিক্ষা দিচ্ছে মতো এইটুকু ইফতারি দিয়ে চলে গেল কেন? এর চেয়ে বেশি আমি রাস্তার ফকির গুলোকে দিই। আর কাপড় কই? এইটুকু ইফতারি নিয়ে নাচতে নাচতে চলে এলো। ইদের জন্য যে কাপড় দিতে হয় সেটা জানে না? আমাদের সবার জন্য এবং সব আত্মীয় স্বজনের জন্য কাপড় পাঠাতে বলবে।’
‘আব্বা তো একজন সাধারণ ট্রাাফিক পুলিশ। অল্প মাইনে পায়। যতটুকু পেরেছে দিয়েছে। আবার এখন এতজনের জন্য কাপড় কীভাবে দিবে?’
‘কীভাবে দিবে মানে? আমরা দিই না? আমাদের মায়েকেও বিয়ে দিয়েছি তো। তাদের শ্বশুরবাড়িতে কী কী দিয়েছি জানো না?’
‘আপনাদের তো কোনোকিছুর অভাব নেই। এভাবে প্রতিদিন দিলেও ফুরোবে না। কিন্তু আমার আব্বার তো সেই সামর্থ্য নেই।’
‘সামর্থ্য? এরা কী করে আমি জানি না? কতটাকা ঘুস খায় সবকিছুই জানি তো।’
‘আমার আব্বা এমন না। আব্বা ঘুস খায় না। আমি জানি আমার আব্বা কত কষ্ট করে।’
‘মুখে লাগাম দাও। মুরুব্বির মুখে মুখে কথা বলো কেন? কাপড় দিতে বলবে। ইদের আগেই দিতে বলবে।’
হালিমা আর বাক্যব্যয় করল না। বাবুল তালুকদারের সামনে থেকে নিজ শয়নকক্ষে চলে গেল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আবুল বাশারকে ফোন দিলো।
‘কিরে মা, কাঁদছিস কেন?’ হালিমার কান্নার আওয়াজ শোনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আবুল বাশার।
‘আমাকে কোথায় বিয়ে দিলে আব্বা? কত বিলাসবহুল বাড়িতে আছি, মাটিতে পা পর্যন্ত রাখতে হয় না। খাবারের অভাব নেই। তবুও আমার ভেতরে একটুও শান্তি নেই। কোথায় বিয়ে দিলে আমাকে?’
আবুল বাশার অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর মেয়ে শান্তিতে নেই। শুধু বিলাসবহুল বাড়িতে থাকা, বিলাসবহুল গাড়িতে চড়া, প্রতিদিন পোলাও কোরমা খাওয়াকে শান্তি বলে না, যদি মনের শান্তিটা পাওয়া না যায়। আবুল বাশারের মেয়ে হালিমার অবস্থাও তেমন। মানসিক ভাবে মোটেও শান্তিতে নেই সে।
আবুল বাশার কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যান? কী হয়েছে?’
‘আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইফতারি নিয়ে মোটেও খুশি না। কিন্তু আমি জানি এবং বুঝি তুমি কত কষ্ট করে ইফতারি দিয়েছ। শুনেছি মা’র হার পর্যন্ত বেচতে হয়েছে। আর সেদিন কেন চলে গেছিলে সেটাও বুঝেছি। এসব কেউ বুঝে না আব্বা। এখানের সবাই এখন কাপড় চাইছে। আত্মীয় স্বজনদের জন্যও। ইদের আগেই দিতে বলতেছে।’
এই কথা শোনে আবুল বাশার চুপ হয়ে গেলেন। তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ‘আচ্ছা দেখি’ বলে ফোনটা রাখলেন।
আবুল বাশার এখন ভাবছেন সে একজন সাধারণ ট্রাফিক পুলিশ হয়ে এত উচ্চ পর্যায়ের মানুষের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়াটা যেন তাঁর জীবনে করা ভুল গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুল। এই অবস্থায় এতগুলো মানুষের জন্য কাপড় দেওয়ার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই। হার ছিল শেষ সম্বল। সেটা বেচে ইফতারি দিয়েছে। তবুও বলছে কম হয়েছে। কিছু মানুষকে আজীবন দিতে থাকলেও শুকরিয়া আদায় করে না তারা। আবুল বাশার বেশি ভাবলেন না। এবার তিনি সততা বিসর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেন।
ঘুস নেওয়াসহ বিভিন্ন অপকর্ম শুরু করলেন আবুল বাশার। মেয়ের সুখ নিশ্চিতের জন্য একজন বাবার এই কাজ। কারণ ‘শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটি একটু সুখে থাকুক’ এটা প্রতিটা বাবার অন্তরের নিবেদন। সেই সুখ নিশ্চিতের জন্য একজন বাবা সবকিছু করতে পারেন। কিন্তু সততা বিসর্জন দিয়েও এই অল্পদিনে বেশি কিছু করতে পারলেন না। অবশেষে মেয়ের জামাই এবং শ্বশুরের জন্য দুইটা পাঞ্জাবি কিনে পাঠিয়ে দিলেন। আর কিছু করতে পারলেন না। আবুল বাশারের এই না পারাটা হালিমার কপালের ‘দুঃখ’ নামক লেখাটা আরও গাঢ় করে দেয়। হালিমাকে আবারও কথা শোনাতে থাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শুধু তাকে কথা শোনায় তা নয়, তার বাপকেও গালগাল দেয় সবাই। হালিমা সব সহ্য করলেও তার স্বর্গতুল্য বাপকে এভাবে গালাগাল দেওয়াটা সহ্য করতে পারল না। কারও কথার কোনো জবাবও দিলো না। কেবল শোনে গেল।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। নতুন সকালের জন্য সবাই অপেক্ষা করে। নতুন সকাল আসে। সবাই সকালে ঘুম থেকে ওঠে। কিন্তু হালিমা?
হালিমা ঝুলছে, এমন কত হালিমা ঝুলে
তবুও যায় না সমাজের কিছু মানুষের নোংরা অহংকার,
সমাজটা আজ নোংরা প্রথায় হলো অন্ধকার।
-মশিউর রহমান আবির (Moshiur Rahman Abir)
Send private message to author







অনেক হালিমার গল্প 😶
সুন্দর লিখনী ভাইয়া 🙂