ঔপন্যাসিক

জানুয়ারি মাসের শেষের দিক। রাত ১০টা- সাড়ে ১০টার মতো বাজে। এ শহরের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক জনাব নাঈমুর রহমান রিকশায় করে বাড়ি ফিরছেন।
শীতের রাত। এ বছর ভালোই শীত পড়েছে। রাত দশটা বাজতে না বাজতেই ব্যস্ত নগরীর রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। ফাঁকা রাস্তায় রিকশার প্যাডেল মারার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ বড্ড বেশি কানে লাগছে। 

শীত নাঈমুর রহমানের প্রিয় ঋতু। কবি-সাহিত্যিকরা বর্ষা কিংবা বসন্তকে নিয়ে যে সংখ্যক কাব্য আর সাহিত্য রচনা করেছেন, শীতকে নিয়ে সেরকম লেখা লিখেছেন কি?
কুয়াশাভেজা শীতের সকালের মিষ্টি রোদ, গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরকণা কিংবা হাড়কাঁপানো শীতের রাতে হাতদু’টো উষ্ণ রাখার চেষ্টায় পকেটে রাখা, তারপর পকেট থেকে হাত বের করে ধোঁয়াওঠা গরম চায়ে চুমুক- এ সবকিছুই নাঈমুরকে সেই ছোটবেলা থেকেই আকৃষ্ট করে।

পছন্দের ঋতু শীত নাঈমুরের জীবনের সাথেও জড়িয়ে আছে। মা’র কাছে শুনেছে, নাঈমুরের জন্ম হয়েছিল শীতকালে। দীপার সাথে ওর বিয়েও হয়েছিল এক কনকনে শীতের রাতে। ওর একমাত্র সন্তান আবীরেরও জন্ম হয়েছে শীতে। 
নাঈমুরের মৃত্যুও কি হবে শীতে? নাঈমুর মুচকি হাসলো। হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারের চেম্বার থেকে আসার পর সব মানুষের মনেই কি ওর মতো মৃত্যুচিন্তা উঁকি দেয়?

নাঈমুরের পিঠের ব্যথাটা ক’দিন ধরে বেড়েছে। ও ওর বন্ধু মানুষ ইব্রাহীমের চেম্বারে গিয়েছিল। ইব্রাহীম খুব দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে বলেছে। ঔষধের পাশাপাশি কিছু এক্সারসাইজ করতে হবে। চিকিৎসাটা একটু সময়সাপেক্ষ এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন। 

অমর একুশে গ্রন্থমেলা দরজায় কড়া নাড়ছে। এবারের বইমেলায় নাঈমুরের একটা উপন্যাস বের হবে। মেলা শেষ হোক। তারপর শুরু হবে চিকিৎসা। ততোদিন পিঠের ব্যথাটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যেতে হবে। 

রাত একটার বেশি বাজে। নাঈমুর উপন্যাস লিখছে। উপন্যাসটা মূলত ওর সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের জন্য লেখা হচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ, মাদক সমস্যা, বিয়ে নিয়ে মেয়েদের চাপ, প্রেমের নামে মেয়েদের ফাঁদে ফেলা- এই সব নিয়েই লেখা হচ্ছে উপন্যাসটা। উপন্যাসটা লিখতে গিয়ে নাঈমুর দিন-রাত এক করে ফেলছে। 

নাঈমুর ওর পিঠে হাতের স্পর্শ পেল। ওর স্ত্রী দীপা ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। দীপা বলল, “অনেক লিখেছো। এবার ঘুমিয়ে পড়ো।” 
নাঈমুর দীপার দিকে তাকালো। দীপার চোখের নীচে কালি পড়েছে।
নাঈমুরের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি দীপার মতো একজন জীবনসঙ্গিনী পাওয়া। 

ওদের বিয়ের আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বেকার নাঈমুরের জন্য কী কষ্টটাই না দীপা করেছিল। ওর পুরো পরিবার, আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে’ অংশ নিয়েছিল ও। 
পরিস্থিতি সবচেয়ে কঠিন হয়ে গিয়েছিল যখন দীপার খালাতো বোন সুহানা এক আমেরিকা প্রবাসীকে বিয়ে করেছিল। এখন অবশ্য সুহানা সুখে নেই। কারও স্বামী যদি একাধিক নারীতে আসক্ত হয়,তবে সেই স্ত্রী কি সুখে থাকতে পারে?  

শুধু বিয়ের আগে কেন? সংসারটাকে তো দীপাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নাঈমুর তো টাকা আয় করেই খালাস। 

নাঈমুরের ইচ্ছে করছে, টেবিল ছেড়ে উঠে দীপাকে জড়িয়ে ধরে ওর গালের সাথে গাল ঘষতে। দীপার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,”আমি কি তোমাকে সুখী করতে পেরেছি দীপা? তুমি কি সুখী?”

নাঈমুরের ইচ্ছেটা ত্যাগ করতে হল। উপন্যাসটা শেষ করতে হবে। ও মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে দীপাকে বলল,”তুমি শুয়ে পড়ো। আমি একটু পরে আসছি।”

দীপা শুয়ে পড়ল। প্রত্যেকটা ভালোবাসার সম্পর্কে প্রতিটা মানুষের নিজস্ব কিছু দায়িত্ব থাকে। নাঈমুর-দীপার সম্পর্কে দীপার দায়িত্ব হল অপেক্ষা করা। এ অপেক্ষা শেষে প্রাপ্তি যেমন আছে,অপ্রাপ্তিও কম নেই।
দীপার অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। নাঈমুর নামের সৎ এবং চমৎকার মানুষটার জন্য অপেক্ষা না করে দীপা থাকতে পারবে না। 

অমর একুশে গ্রন্থমেলার বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেছে। নাঈমুর প্রায় প্রতিদিনই বিকেলের দিকে বইমেলায় চলে আসে। ওর উপন্যাসটা যে প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে,সে প্রকাশনীর স্টলে ও বসে থাকে।
ওর উপন্যাসের বিক্রি সন্তোষজনক। বেশিরভাগ ক্রেতাই অবশ্য ওর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা। 
ও তো উপন্যাসটা মূলত লিখেছেই এই বয়সীদের জন্য। অবশ্য অন্য ডিপার্টমেন্ট কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বইটা কিনলে ওর ভালো লাগা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যেত।

কিছু কিছু ব্যাপার অবশ্য নাঈমুরের বিরক্ত লাগে। ওর শিক্ষার্থীরা বই কিনতে না কিনতেই বই হাতে নাঈমুরের সাথে ছবি তোলার জন্য পাগল হয়ে যায়। গত পরশু পাঁচজনের একটা দল এসেছিল। একটা বই কিনে পাঁচজন পাঁচবার ঐ একটা বই নিয়েই নাঈমুরের সাথে ছবি তুলেছে! 
নাঈমুরকেও পাঁচবারই হাসিমুখে ছবি তুলতে হয়েছে। ঔপন্যাসিকদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। 

কেউ কেউ আবার নিজেদের ব্যাচ আর আইডি নাম্বার জানাতে চায়। বইমেলাতে ওদের ব্যাচ আর আইডি নাম্বার জেনে নাঈমুর কী করবে,ঠিক বুঝতে পারে না। 

নাঈমুরের বইয়ের প্রকাশক অবশ্য খুশি। উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,এখন থেকে শুধু রাজনৈতিক নেতা আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেখা বই বেশি বেশি প্রকাশ করবেন। এতে নাকি ব্যবসা করতে গিয়ে নিরাপদ থাকা যায়।
নাঈমুর ব্যবসা কম বোঝে। তাই প্রকাশকের কথাটা ও ঠিক ধরতে পারে নি।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নাঈমুর প্রায় তিন ঘন্টা ধরে স্টলে বসে আছে। পিঠের ব্যথাটা বড্ড বেড়েছে। বইমেলার শেষ পর্যন্ত ও এভাবে প্রতিদিন আসতে পারবে কি না,কে জানে।
নাঈমুর বইমেলা থেকে বের হয়ে এল। আজ ও এখনই বাড়ি চলে যাবে। 

আলো-আঁধারির মধ্যে একটা টং দোকান দেখে নাঈমুরের চা তেষ্টা পেয়ে গেল। অনেকদিন এমন দোকান থেকে চা খাওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন নাঈমুর প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বন্ধুদের সাথে কাটিয়ে দিতো এমন টং দোকানে। 

টং এর পাশে ফুটপাথে চারজন ছেলে-মেয়ে বসে আছে। নাঈমুর ওদের দেখতে পাচ্ছে। ওরা দোকানের ছাউনির নীচে বসে থাকা নাঈমুরসহ কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না।
ছেলে-মেয়েগুলো নাঈমুরের ডিপার্টমেন্টে পড়ে। একটু আগে ওরা প্রত্যেকে নাঈমুরের উপন্যাসটা এক কপি করে কিনে,তাতে নাঈমুরের অটোগ্রাফ নিয়ে,নাঈমুরের সাথে ছবি তুলে,খানিকক্ষণ কথা-টথা বলে এখন এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। 

ওদের মধ্যে একজন নাঈমুরের বইটা হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলল,”সজীব,’নাই স্যার’ (নাঈমুরের বিকৃত উচ্চারণ) আমাদের আইডি মনে রাখবে তো? ইনকোর্সে ভালো মার্কস দিবে তো? যদি না দেয়,তাইলে এই ২৫০ টাকাই জলে।’ 
ওদের মধ্যে একটা ছেলে,নাম সম্ভবত সজীব, বলল,”দিবে দিবে। না দিলে আমি বেশি বিপদে পড়বো। গত বছর ফেল মারছি। এইবার ফেল মারলে আব্বায় পড়া বন্ধ কইরা দিব।” 

একটা মেয়ে নাঈমুরের বই রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে বলল,”কাম শেষ। এখন আর এই বাল কাঁনধে কইরা বাসায় নেয়ার কোনও মানে হয় না।” 
ওর দেখাদেখি একটি ছেলেও তার হাতের বইটা রাস্তায় ফেলে দিল। ও বলল,”আমিও বাসায় নিমু না এইডা। আম্মায় দেখলে বাইন্ধা পিডাইবো।” 
অপর ছেলেটি বলল,”আমি বাসায় নিয়া ফালায় রাখমু পড়ার টেবিলের এক চিপায়।”

ওদের মধ্যে একটি মেয়ে বলল,”আমি আমার ফুফাতো ভাইরে এটা দিয়া দিমু। আমার ভাইটা মেয়েলি টাইপ। এ বয়সের ছেলেপেলে রাস্তায় বাইক নিয়া ভ্রুম ভ্রুম ঘুইরা বেড়াইবো। তা না বাসায় বইসা এসব গল্প-উপন্যাস পড়ে। তোরা জানোস,ও মোবাইলে ‘ফ্রি ফায়ার’ না খেইল্যা পিডিএফ নামাইয়া গল্প পড়ে।”

একটি ছেলে বলল,”ধুর,কে পড়ে এসব বই? আমাদের ক্লাসের কথাই ধর। তিয়াত্তর জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫ জন এসব আউট বই পড়ে।”
ওর কথার সূত্র ধরে একটি মেয়ে হাসতে হাসতে বলল,”পুরো ডিপার্টমেন্টেই তো এইসব বই পড়ার মতো ২০-২৫ জনের বেশি ছেলে-মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

একটি মেয়ে বলল,”৩-৪ দিন আগে লামিয়াদের যে গ্রুপটা স্যারের বই কিনতে আসছিলো। ওরা তো সবাই ভাঙ্গারির দোকানে বেঁইচা দিছে বইগুলা।” 
একটি ছেলে বলল,”কালকে কাইল্যা কামালরা সব আসতাছে। ওদেরও ধান্ধা বই কিনার ছুতায় স্যারের সাথে ছবি তোলা আর ইনকোর্সের নাম্বার বাড়ানো।”   

হঠাৎ একটি ছেলে প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলল,”দোস্ত,তামিল হিরো আল্লু অর্জুনের লাস্ট মুভিটা দেখছোস? মুভিটা সে-ই।” 
অপর ছেলেটা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,”আল্লু দেখতে ভালো,অভিনয় ভালো করে মানলাম। কিন্তু এখন তামিল ইন্ডাস্ট্রির টপ হিরো ‘থালাপাথি’ হিসেবে পরিচিত বিজয় চন্দ্রশেখর। ওর মুভি নামলেই পুরা বক্স অফিস কাঁপে।” 

ভারতের তামিল সিনেমার নায়ক বিজয় চন্দ্রশেখর সেরা না আল্লু অর্জুন সেরা- এ নিয়ে কিছুক্ষণ তর্ক-বিতর্ক করার পর চারজনের ছোট দলটা ওখান থেকে চলে গেল। 

নাঈমুরের খুব অসহায় লাগছে। পিঠের ব্যথাটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
ও চায়ের দাম মিটিয়ে আলো-আঁধারি জায়গাটায় গেল যেখানে ওর বহু যত্নে লেখা উপন্যাসের দু’টো কপি বড্ড অযত্নে পড়ে আছে। 

নাঈমুরের ছেলে আবীর গত দু’মাস ধরে আবদার করছে,এ শহরের বড় একটি শপিং মল এর কিডস জোন থেকে ঘুরিয়ে আনার জন্য। আদরের সন্তানের ছোট্ট আবদারটি নাঈমুর পূরণ করে নি এ উপন্যাসের জন্য।
অনেকদিন প্রিয়তমা স্ত্রী দীপাকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে ‘ভালোবাসি’ বলে নি নাঈমুর;এ উপন্যাসের জন্য। 
পিঠের অসহনীয় ব্যথাটা দিনের পর দিন নাঈমুর সহ্য করেছে এ উপন্যাসের জন্য। 

নাঈমুরের পেশা থেকে বেশ ভালো অর্থপ্রাপ্তি ঘটে। অর্থ আয় করা কিংবা ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’ অর্জন করার জন্য তো ও এ উপন্যাস লেখে নি। 
ও চেয়েছিল,ওর সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা উপন্যাসের রস আস্বাদন করুক,প্রবেশ করুক উপন্যাসটির মর্মে। অথচ ওরা………….
নাঈমুরের মনে হচ্ছে,ওর চারপাশটা হঠাৎ ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে,ও রক্তকরবী নাটকের যক্ষপুরে দাঁড়িয়ে আছে। 
ঘন অন্ধকারে ফুলেল সাজে সজ্জিত হয়ে নন্দিনী এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। কোথায় নন্দিনী?এ যে তার জীবনসঙ্গিনী দীপা!  

নারীমূর্তিটি তার একটা হাত নাঈমুরের দিকে বাঁড়িয়ে দিল। নাঈমুর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পিঠের ব্যথাটা যেন সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। 
নাঈমুর অনেক কষ্টে ওর একটা হাত বাঁড়িয়ে দিল। যে করেই হোক, নন্দিনী কিংবা দীপার হাত ওকে ধরতে হবে।

এ দুঃসময়ে নন্দিনী কিংবা দীপার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরা ছাড়া ঔপন্যাসিক নাঈমুরের আর কোনও উপায় নেই।

Munif Muhtasim

Send private message to author
What’s your Reaction?
3
3
0
0
2
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Munif Muhtasim
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Salma Papia
Member
4 years ago

গল্পটা ভাল লেগেছে,কিন্তু কেন জানি মনে হল এটা আর একটু বড় বা ২য় পর্ব হতে পারত।

2
Ishmam Nur
Member
4 years ago

তোর প্রতি গল্পের সাথে সাথে লিখা ভালো হচ্ছে। মানুষের সূক্ষ্ম ইমোশন, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পিছনের গভীরতা খুব সহজেই দেখতে পাই যেন। এতো সুন্দর করে লিখিস কীভাবেরে তুই ?

1
Last edited 4 years ago by Ishmam Nur

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!