কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাজিসট্রেট মুরাদ সাহেব। মন মেজাজ কিঞ্চিত গরম। তার কারণ অসহনীয় রোদ নয়। ঢাকা শহরের এই কোলাহল। বিন্দুমাত্র সহ্য হয় না। তিনি আগাগোড়া গ্রামের মানুষ। পাট ক্ষেত, মুলার ক্ষেত দেখে বড় হয়েছেন। শহরের গাড়ি-ঘোড়া তাই বড্ড অসহ্যকর লাগে। কিন্তু কপাল! ম্যাজিসট্রেট হবার পরপরই পোস্টিং হয়েছে ঢাকা শহরে।
এই মুহূর্তে তার ডিউটি পড়েছে ফার্মগেটে। ফুটওভার ব্রিজের একটু আগে ফাঁকা রাস্তায় কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ি চেক করছেন। সারাদেশে লকডাউন চলছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে, মুভমেন্ট পাস ছাড়া যারা বাইরে বেরিয়েছে, তাদের গুষ্টির ষষ্টিপূজো করছেন। কিন্তু কাজে মন নেই মুরাদ সাহেবের। অনেকদিন ধরেই বদলি হবার চেষ্টা করছেন। সবচাইতে ভালো হয় যদি শহর ছেড়ে দূরে কোথাও পোস্টিং পাওয়া যায়। বান্দরবান, রাঙামাটি, পাহাড় পর্বত হলেও অসুবিধা নাই। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা যায় এমন জায়গা হলেই বরং ভালো। অথচ হাজার চেষ্টা করেও বদলি হতে পারছেন না।
এই ভেবে হা-পিত্যেশ করতে করতেই হুট করে মুরাদ সাহেবের মাথায় একটা আইডিয়া চলে আসলো। তিনি আমেরিকা আমেরিকা বলে কয়েকবার চিৎকার দিয়ে উঠলেন। পরক্ষণে মনে পড়লো, শব্দটা আমেরিকা না। হবে ইউরেকা। অবশ্য এটা নিয়ে অতটা মাথাব্যথা নেই। তিনি গভীর ভাবনায় নিজের থুতনিতে হাত রাখলেন। ভাবলেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে। তাতেও যদি ঘি না ওঠে, কোন ব্যাপার না। তার এমনিতেও ঘি দরকার নাই। দরকার হলো বদলি। তিনি ফন্দি আঁটলেন। ক্ষমতাশালী কোন ব্যক্তির গাড়ি আটকাতে পারলে, তার বদলি কেউ আটকাতে পারবে না। এই ভেবে মনে মনেই একচোট হাসলেন মুরাদ সাহেব। আজ খেলা হবে!
কিন্তু খেলতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়লেন মুরাদ সাহেব। রাস্তাঘাট অলমোস্ট ফাঁকা। তেমন গাড়ি-ঘোড়া নেই। মানুষজন নেই। কী একটা বাজে অবস্থা। যাদের পাচ্ছেন, তাদের চিপলেও এক ফোট রস বেরুবে কিনা সন্দেহ। ক্ষমতা তো বহু দূরের কথা। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। প্রচন্ড গরমে, ঘামে কয়েকবার গোসল হয়ে গেছে মুরাদ সাহেবের। একটা পর্যায়ে ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলো যেন। স্টিকার ভর্তি একটি গাড়ি পাওয়া গেছে। মানে গাড়িতে লাগানো কাগজপত্র দেখে আন্দাজ করা যায় ভিআইপি কেউ হবে। মুরাদ সাহেব নাচতে নাচতে গাড়ির কাছে গেলেন। কাঁচে টোকা দিতেই গাড়ির প্যাসেনজার সিটের উইন্ডো কাঁচ নামিয়ে দিলেন এক ভদ্র মহিলা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাই?’
‘আমার শুধু তোমাকে চাই!’
‘কী যা-তা বলছেন!’
‘সরি। যা-তা আর না বলি। কাজের কথা বলি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেরিয়েছেন তো?’
‘অবশ্যই।’ বেশ জোর গলায় জবাব দিলেন ভদ্র মহিলা।
মুরাদ সাহেব গাড়ির ভেতরে নজর ঘুরালেন। ভদ্র মহিলা ও ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। তারা দুজনেই মাস্ক পড়ে আছে। এমনকি হাতেও হ্যান্ডগ্লোভস পড়া। অথচ মুরাদ সাহেব নিজেই মাস্ক পড়েননি। এই গরমে মাস্ক অসহ্য লাগে তার। বেশিক্ষণ পড়ে থাকতে পারেন না। তিনি গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাইলেন। ড্রাইভার কাগজপত্র দেখালো। সব ঠিকঠাক।
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’ ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন মুরাদ সাহেব।
‘হাসপাতালে যাচ্ছি। আমি একজন ডাক্তার।’
‘তাই নাকি! প্রমাণ কী?’
ভদ্র মহিলা তার পরনে থাকা অ্যাপ্রোন দেখালেন। তাতে নাম লেখা আছে। মিস জুলেখা আক্তার। গাড়ির সামনে লাগানো কাগজ দেখতে বললেন, সেখানে হাসপাতালের তথ্য দেওয়া। মেডিকেল এসোসিয়েশনের ইমার্জেন্সি লেটারও দেখালেন। ব্যাগ থেকে আইডি কার্ড এবং ভিজিটিং কার্ডও বের করে দেখালেন। এত এত কাগজপত্র দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় মুরাদ সাহেবের। তিনি জুলেখা আক্তারকে উদ্দেশ্য করে ভেংচি কাটলেন।
‘এইসব এডিট করা যায়!’
‘মানে?’
‘মানে এইসব কাগজপত্র বানানো যায়। নীলক্ষেতে আমার এক বন্ধু আছে। ওরে বললে আধা ঘণ্টার মধ্যে এসব কাগজপত্র হুবহু বানিয়ে আনতে পারবে।’
‘আমার কাগজপত্র সব অরিজিনাল।’
‘তবুও বিশ্বাস হয় না আপনি ডাক্তার।’
‘কেন?’
‘ডাক্তারদের কাছে স্টেথোস্কোপ থাকে। আপনার নাই।’
এই শুনে মিস জুলেখা ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপ বের করে নিজের গলায় ঝুলালেন। সেটা দেখে আরেক দফা মন মেজাজ খারাপ হলো মুরাদ সাহেবের। তিনি মিস জুলেখাকে গাড়ির বাইরে বেরুতে বললেন। জানালেন, গাড়ি তল্লাশি করবেন। মুরাদ সাহেব শিওর, এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন মিস জুলেখা। রেগে যাবেন। বাইরে তো বেরুবেনই না, উল্টো মন্ত্রী মিনিষ্টারকে কল দিবেন। খবর করে ছাড়বেন মুরাদ সাহেবের। বদলি করিয়ে দেবেন।
কিন্তু এমনটা হলো না। মুরাদ সাহেবকে হতাশ করে সানন্দে গাড়ির বাইরে বেরুলেন মিস জুলেখা। কাতরকণ্ঠে সহকর্মীদের গাড়ি সার্চের অর্ডার দিলেন মুরাদ সাহেব। গাড়ি সার্চ করা হলো। তিন প্যাকেট ওরস্যালাইন ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। এমনিতেই ঠাডাপড়া গরমে পানি শূণ্যতা পেয়েছিল। মুরাদ সাহেব স্যালাইন তিনটা গুলানোর নির্দেশ দিয়ে মিস জুলেখার দিকে ফিরলেন।
‘আপনি জানেন, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা।’
‘আমি জানবো কী করে!’
‘মাত্রই তো বললাম।’
‘আচ্ছা।’
‘আপনার বাবা কি মুক্তিযোদ্ধা?’
‘না।’
‘তাহলেই বুঝেন অবস্থা! আমার বাবা যদি মুক্তিযুদ্ধ না করতো, তাহলে আপনার বাবা এই স্বাধীন দেশ পেতো না। স্বাধীন দেশ পেয়েছে বিধায় তিনি শান্তিতে বাঁচতে পারছেন। এমনকি শান্তিতে বিয়ে করতে পেরেছেন। তারপর আপনার জন্ম হয়েছে। স্বাধীন দেশে পড়ালেখা করে আজ ডাক্তার হতে পেরেছেন। সব আমার বাবার কল্যাণে।’
‘জি বুঝতে পেরেছি।’
মিস জুলেখার ঠান্ডা জবাব শুনে মাথা চুলকান মুরাদ সাহেব। কী বলবেন খুঁজে পান না। ভেবেছিলেন এই গালগল্প শুনে অন্তত বেঁকে বসবেন মহিলা। কিন্তু এমনটা হলো না। বেশ শান্ত রয়েছেন তিনি। তাকে রাগানোর আর কোন কলাকৌশল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
‘দেখেন, আপনার গাড়ি আমি ছাড়তে পারবো না।’
‘কিন্তু কেন?’
‘আপনার সমস্ত কাগজপত্র ঠিকঠাক। এটা বড় সন্দেহের! একটা মানুষের সকল কাগজপত্র কীভাবে ঠিক থাকে! উপর মহলের অনুমতি ছাড়া আমি আপনাকে ছাড়তে পারছি না। চেনাজানা কোন মন্ত্রী মিনিষ্টার নেই?’
‘আছে তো।’
‘প্লিজ তাকে কল দেন। কল দিয়ে বলেন, ম্যাজিসট্রেট মুরাদ শিকদার আপনাকে আটক করেছে। বলেছে আপনাকে ছাড়বে না। আরও বইলেন, আমি আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছি। তুই তোকারি করেছি। সকল কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্বেও হ্যারেস করেছি। প্লিজ তাদের কল দিয়ে বলেন। আমার বিরুদ্ধে যেন অ্যাকশন নেওয়া হয়। বদলি করে দিলে আরও ভালো। বলবেন, আমি কাউরে ডরাই না।’
‘এমনটা করতে পারবো না। আপনি ভুল কিছু করেননি। জাস্ট নিজের ডিউটি পালন করেছেন।’
রাগে দুঃখে হতাশায় চোখে পানি চলে আসে মুরাদ সাহেবের। ফাঁকা রাস্তায়, বিশেষ করে নিজের সহকর্মীদের সামনে হুহু করে কাঁদতেও পারছেন না। খেয়াল করলেন পাশেই কয়েকজন সাংবাদিক, মিডিয়া কর্মী দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের এই ঘটনার উপর কোন আগ্রহই নাই। কেউ ছবি তুলছে না, ভিডিও করছে না, কোনপ্রকার নোট তুলছে না। একজন সাংবাদিক তো বড় বড় হা করে কয়েকটা হাইও তুললো। এমন সিরিয়াস একটা ঘটনাকে তারা পাত্তাই দিচ্ছে না।
‘এক্সকিউজ মি, আপনি ঠিক আছেন?’ মিস জুলেখার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পান মুরাদ সাহেব।
‘জি আমি ঠিক আছি।’
‘আপনার চোখে দেখছি জল। কোন অসুবিধা?’
‘শান্তি নাইরে আপা! এই জীবনে তিল পরিমাণ শান্তি নাই। কেউ আমার কষ্ট বুঝে না। আপনিই কেবল চোখের জলটা দেখতে পাইলেন। খোদা আপনার মঙ্গল করুক।’
মিস জুলেখা কিছু বলতে পারলেন না। মুরাদ সাহেবও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। এভাবেই কেটে গেল কিছুক্ষণ। তারপর মুরাদ সাহেব মিস জুলেখাকে সরি বললেন। গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বললেন। বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসলো তাদের। মিস জুলেখা চলে গেলেন। ম্যাজিসট্রেট মুরাদ সাহেবও সারাদিন তার ডিউটি পালন করে বাসায় চলে গেলেন।
বহু চেষ্টা তদবির করেও বদলি হতে পারলেন না মুরাদ সাহেব। এই কোলাহলময় ঢাকা শহরে আরও দুই মাস পেরিয়ে গেল। কোনকিছুই বদলালো না। তেমন কোন পরিবর্তনও নেই। শুধু একটা পরিবর্তন ঘটেছে। মুরাদ সাহেব বিয়ে করেছেন। মিস জুলেখা এখন তার স্ত্রী। মুরাদ সাহেব সুযোগ পেলেই গম্ভীর বদনে ভাবতে বসেন। আর অস্ফুট স্বরে বলেন, এই জীবন বড় অদ্ভুত!
– জামসেদুর রহমান সজীব ( Zamsedur Rahman Sajib )
Send private message to author






