একটি হাতের স্পর্শ

এই প্রথম কেউ নিশীথের হাত ধরল। কী শীতল এই ছোঁয়া। কত আপন, কত পরম, কত শান্ত হাতের তালু। ঠিক যেন মায়ের মতো।

নিশীথ যখন খুব ছোট, কতোই-বা বয়স—পাঁচ-ছয় হবে, তখন একদিন ভোরবেলা কী-একটা বাজে স্বপ্ন দেখে নিশীথের ঘুম ভেঙে যায়। কত যে বাজে- ভয়ানক ছিল সেই স্বপ্ন নিশীথ মনে করতে চায় না। মনে করলেই মনে পড়ে একটা স্নিগ্ধময় স্নেহনিবিড় হাতের স্পর্শ। যা আর কোনোদিন সে পায়নি।

সেই স্নেহশূন্য হাতে আজ কার স্পর্শ ও টের পেল! ও ভাবতে চায় না। যাঁর হোক, যেমনই হোক, কেমন মায়া আছে যেন! যেন সেই পনের বছর আগের মায়া। যাক, ছুঁয়ে যাক!
আজ নিজের হাতকে নিশীথ এই উন্মুক্ত-স্নেহের দান গ্রহনে উৎসাহ দিতে লাগল। নিজের হাতটাকে কেন জানে-না আজ বেশি নিজের মনে হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে আজ সে একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। আজই তার মনে হলো, এই হাত যেন এতোদিন বুভুক্ষু ভিক্ষুকের মতো এ-দোর ও-দোর করে ঘুরে বেড়িয়েছে শুধু এরকম একটা আশ্রয় পাওয়ার আশায়। অথচ কোনোদিন সে এই অভাবের অনুভব ইস্তক করেনি। আজ পেয়েই তার মনে হচ্ছে, সে এতোদিন একটা অভাবের মধ্যেই কাটিয়েছে।

কিন্তু নিশীথের ত সব আছে। দোতলা একটা পাকা বাড়ি আছে। ব্যাংকে বিশ লক্ষ টাকা আছে। ধানি জমি আছে। সবই ত তার। সমাজের লোকজনও ওকে বেশ সমাদর করে। অবশ্য সমাদর করার কারণও আছে—নিশীথের বাবা পৃথিবী ছেড়েছেন প্রায় পাঁচ বছর হলো। যাওয়ার আগে তিনি গ্রাম পঞ্চায়েতের কল্যাণ তহবিলে দু-লাখ টাকার একটা ট্রাস্টি করে গেছেন। এ পৃথিবী না-পেলে কিছু দেয় না। দেয়া নেয়ার নিয়মে আবদ্ধ এ-পৃথিবী।

এই কঠিন সত্যও নিশীথ খুব ছোটবেলাতেই বুঝে ফেলেছিল। উহ্, আবার সেই স্মৃতি!
পনের বছর আগের কথা নিশীথের আবার মনে পড়ে যাচ্ছে। স্মৃতিগুলো এতো যাচ্ছেতাই রকমের নাছোড়বান্দা হয় কেন, নিশীথ চিন্তা করতে চায়। কিন্তু পারে না। একটা চিন্তা দিয়ে নিশীথ স্মৃতি ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু পারে না। সেই ছোট্টবেলার সেই আস্তাকুঁড় স্বপ্ন আবার মাথার ভিতর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

নিশীথ আর কিছু ভাবতে পারে না। এই মুহূর্তে এই পরম হাতের তালুর স্নিগ্ধ স্পর্শটুকুই সে আস্বাদন করে নিতে চায়।

“আচ্ছা, এখানেও কি কোনো দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক আছে? এই যে আমি পরম ছোঁয়া উপভোগ করছি, এর বিনিময়ে আমাকেও কি কিছু দিতে হবে?” নিশীথ মনে মনে জিজ্ঞেস করে। “সব সম্পর্কই কেন দেয়া-নেয়ার, হে পৃথিবী? তুমি কি কিছুই না-পেয়ে ত্যাগ করতে পার না? এতো নিষ্ঠুরতা কেন তোমার হৃদয়ে? না, না, আর ভাবব না। যদি কিছু দিতেই হয় দিব। তবু আর এই স্পর্শ আমাকে ছেড়ে চলে যাক আমি চাই না।”

নিশীথ একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নেয়। নীল আকাশ আজ কিছুটা ঘোলাটে। দু-একটা উড়ে যাওয়া পাখি ছাড়া আর কিছুই তার নজরে পড়ল না।

পাঁচটা স্নিগ্ধভরা আঙুল তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিশীথ কিছুটা পিছনে থেকে সেই হাতের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে।

এ কি সেই হাত? এ কি সেই নিভৃতে সরে যাওয়া স্পর্শ? ওর মনে পড়ে যাচ্ছে পনের বছর আগের একদিন গভীর রাতের কথা। নিশীথ ঘুমিয়ে ছিল ওর মায়ের কোলের মধ্যে গুটিশুটি মেরে। ওর প্রতিদিনের অভ্যাস মা’র ডানহাত নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো। ওর মা স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে নিশীথ।

গভীর রাত। ঘুমের মধ্যে কিছু ফিসফিসানি কথা শুনতে পায় নিশীথ। ভাবে, বুঝি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে ও। নিশীথ ভয়ে ভয়ে মায়ের হাত আরোও জড়িয়ে নেয়। ও দেখতে পায়, ও একটু একটু বুঝতে পারে একটা হাত সরে যাচ্ছে বুকের মধ্যে থেকে। মন চাচ্ছে খিমচে টেনে ধরে হাতটা। শরীরের সমস্ত বল দিয়ে চেষ্টাও করে নিশীথ। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে মানুষের শারীরিক বল যে কাজ করে না! ও হাত দুটো বাড়িয়ে দিতে চায়, কিন্তু কিছুতেই নিজের হাতদুটোকে এগোতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে বুকের মধ্যে থেকে সড়সড় করে সরে যাচ্ছে একটি হাত–ওর মায়ের হাত। নিশীথ বুঝতে পারে এ-হাত আর ও কখনও বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে পারবে না। নিশীথ আর বাঁধা দেয় না।

একসময় ভোর হয়। ঘুম ভাঙে নিশীথের। রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। কী বাজে ছিল স্বপ্নটা! কী ভয়ানক! বুকটা কেমন গ্রীষ্মের দুপুরের ধুলো-উড়া ফাঁকা মাঠের মতো খাখা করে ওঠে ওর। হাতড়াতে থাকে মায়ের হাত। কিন্তু মা কোথায়? শুধু মায়ের পরা শাড়িখানা পড়ে আছে বালিশের ওপর। নিশীথ সেদিন মাতৃহীন শূন্য-আঁচল জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। সেই ছোট্টবয়সে নিশীথ চলে যাওয়ার বেদনায় একবার কেঁদেছিল। তারপর আর শেষ কবে কেঁদেছে ওর মনে পড়ে না।
বাবার মৃত্যুর দিন আশেপাশের কাকিমা-জ্যাঠাইমারা চেষ্টা করেও ওর চোখের জল ঝরাতে পারেনি।

কিন্তু আজ কেন ওর কাঁদতে মন চাচ্ছে? মনে হচ্ছে এই নির্জন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আকাশে মুখ তুলে চিৎকার দিয়ে কাঁদে।

কেউ কিছু বলছে না। শুষ্ক লম্বা চুলের ঝুপড়ি ঝুলে পড়েছে তার পিছনে। পিঠের ওপর ঝাঁকি খাচ্ছে পায়ের তালে তালে। তারা দুজনে ফুটপাথ ধরে হাঁটছে।
এ-হাতও ছেড়ে যাবে না ত? যায় যাক! ছেড়ে যাওয়ার বেদনা নিশীথকে আর কাঁদাতে পারে না।

পৃথিবীটাই এরকম। একদিন সব হাত ছেড়ে যাবেই। একদিন সব স্নেহ ঘুচে যায়। একদিন সব স্পর্শ মুছে যাবেই। যতটুকু সময় ধরে থাকা যায়, যতখানি স্পর্শ ছুঁয়ে নেওয়া যায়, হাতছাড়া না করাই ভালো।

–সৌমেন মণ্ডল (Saumen Mondal)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
3
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Saumen Mondal
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!