মুখোশের আবডালে

প্রথম দিন…
-চোখ মেলে নিজেকে নিশি হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলো মরুভূমির মত খোলা একটা জায়গায়।
একে তো প্রায় এক বছর পর আলোর মুখ দেখছে সে, তার উপর চোখ ঝলসানো রোদ। যতদূর চোখ যাচ্ছে, আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই। মুক্তির স্বাদ পেয়ে পাগলের মত দৌড়াচ্ছে নিশি। কিন্তু ওই লোকটা কেন আটকে রেখেছিল এতদিন, আবার কেন ছেড়েও দিল, কোন হিসাব মিলাতে পারছেনা নিশি। যাক, আপাতত ওসব ভাবার সময় নেই। এখান থেকে বের হয়ে দ্রুত নিজের বাড়ি পৌঁছাতে হবে তাকে। কিন্তু এই জায়গাটা দেশের কোন এলাকায়, তার বাড়ি এখান থেকে কত দূর, কিছুই জানে সে। আপাতত দৌড়াতে থাকলো দিকবেদিক হয়ে।
দীর্ঘ দুই ঘন্টা ধরে তপ্ত মাটিতে খালি পায়ে ছুটছে নিশি, কিন্তু এখনো খুব একটা আগাতে পারেনি। একে তো গতকাল সারাদিন তাকে কিছু খেতে দেয়নি, তার উপর তপ্ত রোদ, মাথার উপরের সূর্যটা যেন শরীরের সব শক্তি শুষে নিচ্ছে। আর এগোতে পারছেনা সে। ভীষণ পানির পিপাসা পেয়েছে, গলা ফেটে চৌচির হবার অবস্থা।
কেউ একজন পানির বোতল নিয়ে সামনে এগিয়ে এলো, তবে গামছা দিয়ে লোকটার মুখ ঢাকা।
নিশি খপ করে পানির বোতলটা ধরতে যাবে, ওমনি লোকটা সমস্ত পানি মাটিতে ফেলে দিল। ক্ষুধার্ত মাটিও তা এক সেকেন্ডে শুষে নিলো। নিশি কিছু বলতে যাবে, ওই মূহুর্তেই একটা বোতল থেকে নিশির মুখ বরাবর স্প্রে করতেই সে জ্ঞান হারায়।

দ্বিতীয় দিন.….
মুখের উপর পানির ছিটা পড়তেই জ্ঞান ফেরে নিশির। আজ চোখ মেলে নিশি নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা ভাঙা ঘরে। মাথার উপর ছাউনি বলতে কিছুই নেই। এদিকে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। সারা গায়ে কাদা মেখে একাকার। ঘরের দরজা খুলে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে নিজেকে আবিষ্কার করলো এক গহীন জঙ্গলে। ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজও পালাবার পথ নেই। মাথার উপর ছাদ না থাকলেও দরজা তো আছে। এই জঙ্গলে রাতের আঁধারে পালাতে গেলে হয়তো কোন বন্য পশুর খাদ্য হতে হবে। সারারাত এক নাগাড়ে বৃষ্টি হলো। এমন বৃষ্টি দেখে নিশি মনে মনে ভাবছে, নির্ঘাত শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি।
সেই কবে থেকে এই অজানা মানুষটার কাছে বন্দী। দিন-মাসে-সময়ের কোন হিসাব নেই। কবে মুক্তি দিবে নাকি আদৌ দিবেনা, তারও কোন ঠিক নেই। ভাবতে ভাবতে আবার চোখ দুটো আবছা হয়ে আসছে। কাঁপুনি দিয়ে প্রচন্ড জ্বর এসেছে সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে। নিজেকে আর সামলাতে পারলো না নিশি, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়৷

গত এক বছরে খুব কম সময়েই সজ্ঞানে ছিল নিশি। বদ্ধ একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। কে রেখেছে, কেন রেখেছে, কিছুই জানেনা। হবু স্বামীর সাথে বিয়ের কেনাকাটা করতে এসেছিল মার্কেটে। পানির বোতল আনতে হবু স্বামী একটা দোকানে ঢুকলো আর সেই ফাঁকেই নিশিকে উঠিয়ে নেয়া হলো মাইক্রোবাসে। সেই থেকে এই রুমটাই তার ঠিকানা।শারীরিক কোন অত্যাচার করেনা ঠিকই, কিন্তু মেয়েটার মনোবল দিনদিন ভেঙে যাচ্ছে এভাবে আটকা থেকে। প্রথম প্রথম খাবার দিলে খেতে চাইতো না নিশি, কিন্তু ক্ষুধার কাছে হার মানতে হয় একসময়ে। আর প্রতিবারই খাবার খাওয়ার পর কি এক অদ্ভুত নেশা কাজ করে, খুব লম্বা একটা ঘুম হয় তার। এই এক বছরে শেষ দুই দিন তাকে বাইরে নেয়া হয়েছে, এর পেছনেও যে লোকটার কোন উদ্দেশ্য আছে, ঠিক বুঝতে পারছে নিশি।

তৃতীয় দিন…
আজ নিশি নিজেকে আবিষ্কার করলো মাঝ নদীতে একটা নৌকের উপর। আগে থেকেই ছিদ্র থাকায় নৌকায় পানি উঠতে লাগলো। নিশি সাঁতার খুব একটা ভালো পারেনা, পারলেও এই নদীতে কাজে দিবেনা। যদিও সে মনে মনে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু খুব ভালোই বুঝতে পারছে লোকটা তাকে আর যাই হোক মরতে দিবেনা। নৌকাটি উল্টে যাবার ঠিক আগ মূহুর্তে জ্ঞান হারায় নিশি, হয়তো ভয়েই। হটাৎ একটা স্পিডবোট এসে অজ্ঞান নিশিকে উদ্ধার করে।
স্পিডবোটে উঠা মাত্রই নিশি হাত দিয়ে আচমকা লোকটার মুখের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলে। অজ্ঞান হওয়াটা যে আজ লোকটার পরিচয় জানার জন্য শুধুই নাটক ছিল।
মুখোস উন্মোচিত হবার সাথে সাথেই লোকটা ধাক্কা দিয়ে নিশিকে নদীতে ফেলে দেয়।
পানিতে পড়ার পরে নিশি শুধু একটা চিৎকার করেছিল, “রাসেল!”
লোকটা মুচকি একটা হাসি দিল, যেন নিশির এই নাটকের সাথে সে অনেক আগ থেকেই পরিচিত।

দুই বছর পর…

-রাসেল সাহেব, আপনি থানা থেকে আপনার পাসপোর্ট নিয়ে আসতে পারেন। আপনার বিদেশে যাওয়ায় আর কোন বাঁধা নেই। আপনার এক্স ওয়াইফ হয়তো তার এই প্রেমিককেও ধোঁকা দিয়ে অন্য কারো সাথে পালিয়েছে। মামলা তুলে নিয়েছে তার পরিবার। মাঝখান দিয়ে আপানেকও হয়রানি করে ছাড়লো৷

-ধন্যবাদ স্যার। পাসপোর্ট আনবো ঠিকই, তবে বিদেশ আর যাবো না। কি লাভ এই টাকা দিয়ে বলেন? না মাকে শেষবার দেখতে পেলাম, না সংসার করতে পারলাম।

-আপনার জন্য আসলেও অনেক দুঃখ হয় । আসি, ভালো থাকবেন।

আজ রাসেল নিজের মায়ের কবরস্থানের পাশে,

পাঁচ বছর আগে, বিদেশ থেকে ফিরলে মা তার পছন্দের মেয়ের সাথেই বিয়ে দেয় রাসেলকে। চোখে কিছুটা কম দেখতেন মা, তাই তো বিয়ের এক মাস পর বিদেশ যাবার সময় নিশিকে মায়ের আর বাড়ির পুরো দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল রাসেল। মাসে মাসে সব টাকাও নিশির একাউন্টে যেত, এই ভেবে যে বয়স্ক মা এখন শুধু পায়ের উপর পা তুলে আরাম করবে। কিন্তু বিয়ের এক বছরের মাথায় পুকুরে ডুবে মায়ের মৃত্যুর খবর আসে।
রাসেল দেশে আসে, তবে মায়ের দাফন হয়ে যায় আগেই। শেষবার মায়ের মুখটাও দেখা হয়না তার। এই এক বছরে মায়ের সাথে খুব একটা কথা হয়নি রাসেলের। কখনো মা ঘুমিয়ে থাকে, কখনো মা আত্মীয়ের বাড়িতে, কখনো নেটওয়ার্ক সমস্যা। তবে মারা যাবার দুইদিন আগে ঠিকই মায়ের সাথে শেষবার কথা হয় রাসেলের, যা নিশি জানতো না।
কি অমানবিক নির্যাতন! রাসেলের পাঠানো টাকা দিয়েও চিকিৎসা না করানোর ফলে মা তখন চিরতরে অন্ধ। প্রায় সময়েই খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে খাওয়ানো হতো, যেন নিশির প্রেমিক ওই বাড়িতে অবাধ বিচরণ করতে পারে। গ্রীষ্মের তপ্ত গরমেও পুরো একদিন খাবার-পানি বন্ধ ছিল তার, কারণ নিশিকে হুমকি দিয়েছিল ছেলের কাছে বিচার দিবে বলে। কোন এক ঝড় তুফানের রাতে, সারারাত ভাঙা গোয়াল ঘরে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, যেন বৃষ্টির পানিতে ভিজে জ্বরে ভুগে মরে। কিন্তু নিশির ভাষায় বুড়ির কৈ মাছের প্রাণ, ওইবারও প্রাণে বেঁচে যায়।
লুকিয়ে ছেলের কাছে ফোনে করুণ আকুতি জানায় মা। এতদিনে ছেলে বুঝতে পারে, নিশিকে অন্ধবিশ্বাস করে কি ভুলটাই না করেছে সে। তবে সিদ্ধান্ত নেয়, ফোনে কিছু না বলে, সামনাসামনি যত দ্রুত সম্ভব দেশে এসে মা কে উদ্ধার করবে সে। কারণ নিশির মত ধূর্ত মেয়েকে ফোনে কিছু বললে মায়ের ক্ষতি করতে পারে এই ভেবে গোপনে সব ব্যবস্থা করতে থাকে। তবে এরপর দুইদিন ও সময় দেয়না ওই পাপিষ্ঠা মেয়েটা মা কে৷ একে তো অন্ধ, তাই রাতের বেলায় ওজু করতে গিয়ে পা পিছলে পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয়েছে, এই ভেবে সবাই ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। কিন্তু রাসেল শুধু জানে, এই মৃত্যু মোটেও স্বাভাবিক নয়। বাড়িতে এসেও নিশির সাথে এই নিয়ে কোন কথাই বলে না রাসেল। আসলে কারো সাথেই সে কোন কথা বলেনা এই ব্যাপারে। সারাদিন চুপ করে ঘরে বসে থাকে, যেন সময়মত মা কে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ তাকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে৷ তবে কেন জানি নিশিকে আইনের হাতে দিতে ইচ্ছে করেনি তার। কি বা হবে দিলে? কোন প্রমাণ তো নেই, আর প্রমাণ হলেও বড়জোর সাত বছরের জেল। এত সহজ শাস্তি তো দেয়া যাবেনা তাকে, তাই মনে মনে পরিকল্পনা করতে থাকে রাসেল। এদিকে সময়মত বিদেশ না যাওয়ায় তার চাকরিটাও চলে যায়। আর এমন বেকার উন্মাদের কাছ থেকে মেয়েকেও তাই ছাড়িয়ে নিয়ে ডিভোর্স দেয় নিশির লোভী পরিবার৷ আর নিশি তো ভেতরে ভেতরে এতেই খুশি, টাকা-গহনা যা হাতানোর তা তো হয়েই গেছে।
ডিভোর্সের কয়েকমাস পর মেয়ের বিয়ে ঠিক করে নিশির পুরনো প্রেমিকের সাথে, যাকে অতীতে বেকার বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল নিশির পরিবার।
কিন্তু বিয়ের দুইদিন আগেই মার্কেট থেকে নিখোঁজ হয় নিশি।

আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়না নিশিকে। নিখোঁজের দীর্ঘ এক বছর পর, দেশের কোন এক প্রান্তের মাঝ নদীতে নিশির নিথর দেহ হয়তো রাক্ষুসে মাছগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

আর রাসেল অন্যায় করেছে না ন্যায় করেছে তা নাহয় আপাতত ছেড়ে দিলাম পাঠকের হাতে।

-সমাপ্ত।

-মুখোশের আবডালে

-Salmina Mousume

Send private message to author
What’s your Reaction?
2
2
0
1
0
0
1
Share:FacebookX
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শাওন
Guest
শাওন
4 years ago

এগিয়ে যাও বন্ধু

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!