অনু বৃত্তে

বিচ্ছেদের এতোদিন পর অনুকে দেখে খানিকটা দমেই গেলাম। আমার পক্ষে সঠিক হিসেব করা মুশকিল, কারণ দিন মাস কিংবা বছরের হিসেব আমি খুব একটা রাখতে পারি না। তবুও অনুর সাথে শেষ বার কথা হয়েছিলো আন্দাজ বছর তিনেক আগে, ওর বিয়ের দিন। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকেই এসেছিলো কলটা। কলটা রিসিভ করে বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করার পরও যখন ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছিলাম না তখন কলটা কেটে দিবো ভাবতেই ফোনের ওপাশ থেকে একটা চাপা কান্নার আওয়াজে একটু দমেই গিয়েছিলাম। যদিও সেদিন চিনতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি তবুও প্রশ্ন করেছিলাম,

  • কে?
    প্রশ্নটা শুনে কান্নার রোলটা বেশ খানিকটাই যেন বেড়ে গিয়েছিলো। তারপর ওপাশ থেকে চাপা কান্না কোনো মতে আটকানো কণ্ঠে ভেসে এসেছিলো,
  • আমি।
    সত্যি বলতে কী, বুকটা একবার ধক করে উঠেছিলো। মনে হচ্ছিলো কেউ যেন এক অদৃশ্য আঘাতে বুকের ঠিক বাম পাশটা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। আবার প্রশ্ন করেছিলাম,
  • আমি কে?
    ততক্ষণে চাপা কান্নাটা থেমেছে, তার পরিবর্তে ভেসে আসছে গলা ছেড়ে কান্নার আওয়াজ। তার সাথে সাথে একটা লাইন,
  • নীল, আমাকে তুমি ক্ষমা করবে তো? কখনো কোনো অভিযোগ পুষে রাখবে না তো?
    বুঝলাম অনেকটা অনুশোচনাতেই কল করেছে অনু। একটা দীর্ঘশ্বাস্ বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন। বলেছিলাম,
  • সম্পর্কটা তো অভিযোগের ছিলো না। তাই তার প্রশ্নও আসে না।
  • আমি জানি নীল, আমি চলে গেলে তুমি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বে তোমার পৃথিবী। কিন্তু আমি কিইবা করতে পারি বলো?
  • অনু, হয়তো আমি একা হয়ে পড়বো, কিন্তু বেঁচে তো থাকবো। এই বা কম কিসে বলো?
    অনু সেদিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি, একেবারে হাউমাউ করেই কেঁদেছিলো। হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু কেউ একজন পাশ থেকে বলে উঠেছিলো,
  • কী রে অনু, তোর হলো? সবাই যে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
    বুঝলাম ওর মা। কলটা কেটে গেলো। কলটা কেটে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ ফোনটা কানের কাছে ধরে রেখেছিলাম। মনে হচ্ছিলো, হয়তো এখনি আবার কথা ভেসে আসবে ওপাশ থেকে। আসেনি। সে রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। শুধু সে রাতেই নয়, বরং আরও বেশ কয়েকটা রাত।
    .
    তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিলাম। বনানীর মেসটা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম খাগড়াছড়ি, এই ভেবে যে পাছে পথে কখনো দেখা না হয়ে যায় মেয়েটার সাথে। অনু ঠিকই বলেছিলো, ও চলে যাওয়ার পর নিজেকে এতটা একা লাগছিলো যেনো এই শহরে এত মানুষের ভীড়েও আমি একা, সম্পূর্ণ একা। নিজেকে এতটা একা আর লাগেনি কখনো।
    .
    জন্মের আগেই বাবা মারা গেছে। ৫ বছর বয়সে মা। তারপর থেকে পথে পথে মানুষ আমি। একটা এতিমখানায় থেকে অনেক কষ্টে লেখাপড়াটা শিখেছি। কষ্টটা বৃথা যায়নি, ছোটো খাটো একটা চাকুরিও পেয়ে গেলাম। তারপরই আমার একলা জীবনে এসে ধরা দিলো অনু। আমার সবটা জেনেও যে কেউ আমাকে এতটা আপন করে নিবে, ভালোবাসবে সেটা ভাবতে পারিনি আমার জীবনে অনু আসার আগ পর্যন্ত। ভালোবাসা যে এমনও হয় তা আমার জানা ছিলো না ওকে দেখার আগে।
    .
    ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি সত্যিকারের ভালোবাসাগুলোর কোনোই ভবিষ্যৎ হয় না। মজনু লাইলীকে এতটা ভালোবাসার পরও তাদের মিলন হয়নি, শিরি- ফরহাদের ক্ষেত্রেও একই দৃশ্যপট। কিন্তু অনু চেয়েছিলো আমাদের ভালোবাসাটা পূর্ণতা পাক। স্বপ্ন দেখেছিলো আমাকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখেছিলো আমাদের একটা ছোট সংসার হবে। যেখানে আর যা কিছুরই অভাব থাকুক না কেনো ভালোবাসার কোনো অভাব থাকবে না। আমাদের ঘর আলো করে আসবে ছোট্ট একজন অতিথি। নামও ঠিক করে রেখেছিলো, মেয়ের নাম হবে বিন্দু। আমি একটু হেসেই প্রশ্ন করেছিলাম,
  • আচ্ছা তুমি কেমন করে জানলে যে আমাদের মেয়েই হবে? ছেলে কেনো নয়?
    অনু আমার বুকে একটা আদুরে ঘুষি মেরে বলেছিলো,
  • ইশ, তুমি খুব জানো তাই না? আমি বলে দিচ্ছি আমাদের মেয়েই হবে। দেখে নিও।
    দেখা হয়নি আমাদের, ভালোবাসার এতটুকু খাদ না থাকার পরও পূর্ণতা পায়নি। সত্যিই কী সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো এমন করে হারিয়ে যায়? উত্তরটা আজও আমার অজানা।
    .
    অনু চলে যাওয়ার পর , বিয়ে তো দুর আর কাউকে ভালোবাসতেই পারিনি। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয়। আমি জানি অনু সুখে আছে। হয়তো এতদিনে একটা ফুটফুটে মেয়েও এসেছে ওর কোল আলো করে। তবে মাঝে মাঝে ভাবি, মেয়েটার নাম কী বিন্দু রেখেছে? এ উত্তরও খুঁজে পাই না। বুঝে গেছি, সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। কিছু উত্তর অজানায় থেকে যায়। অজানা থাকে কেবল ভাবিয়ে রাখতে, স্মৃতিগুলো মনে রাখতে। ওর প্রতি কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি মনে অনুযোগও নয়। যা এসেছে তা হলো ওর ভালোবাসার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর সম্মান। আমি জানি মেয়েটার কোনো দোষ ছিলো না। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়েকে নিচু শ্রেণীর কোনো চাকুরি জীবির ঘরে সমাজ মেনে নিবে না। অনুর বাবাও মেনে নেয়নি আমাকে। এটা তার দোষ নয়, বরং সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা।
    .
    এতোদিনে জেনে গেছি ওকে ভুলে যাওয়া কেবল মুশকিলই নয় বরং অসম্ভব। জেগে থাকুক স্মৃতির পাতায়। কাউকে ভালোবাসলে হাসতে যেমন ভালো লাগে, তার জন্য কাঁদতেও তেমনই ভালো লাগে। যদিও চোখের পানি খুব একটা আসে না, তবে মন খারাপ হয়। সেই মন খারাপটা ঘিরে থাকে ওর স্মৃতি। শত চেষ্টা করেও ওর দেওয়া ঘড়িটা ফেলে দিতে পারি নি। ওটা আমার হাতেই শোভা পায় আজও। ঘড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় ওর কথাগুলো,
    -শোনো, অনেক বাহানা শুনেছি। এই যে আজ এই ঘড়িটা দিলাম তোমায়। এবার থেকে আমাকে যদি আর এক মিনিটও অপেক্ষা করিয়ে রেখেছো, তাহলে জেনে নেও আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।
    .
    ভেবেছিলাম হয়তো আর কখনো দেখা হব না ওর সাথে। কিন্তু পৃথিবীটা গোল। এতো দিন পর ওর সাথে এমন ভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। প্রথমে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েও পারিনি। ওর চোখে ধরা ঠিকই পড়তে হলো।
  • কেমন আছে নীল? চুল দাড়ি গুলো কাটো না কেনো? অফিসের বস কিছু বলে না? আমি যদি তোমার অফিসের বস হতাম তাহলে দিতাম আচ্ছা করে বকা।
    .
    কথাগুলো বেশ হেসে হেসেই বললো অনু। যদিও আমি জানি এই হাসি মৃত, এতে প্রাণের ছিটে ফোঁটাও নেই বিন্দু মাত্র। আমিও মুখে একটা কৃত্রিম হাসি এনে বললাম,
  • বকবে কে? সেই রগচটা বসটা যদি আমিই হই?
    অনু প্রথমে আমার কথাটা শুনে বেশ অবাকই হলো। তারপর মৃদু কৃত্রিম হাসিটাকে অট্টহাসিতে রূপ দিয়ে বললো,
  • সত্যিই বলছো? নীল তুমি এটা সত্যি বলছো?
    মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে মাথাটা দোলালাম। অনু আমার দিকে অবাক আর বিস্ময় চাহনিতে তাকিয়ে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ।
    .
    বনানীর মেসটা ছেড়ে আমি যখন খাগড়াছড়িতে আসলাম তখন এখানে একটা ভালো কোম্পানি বেশ ভালোই একটা পোষ্টে চাকুরিটা পেলাম। পরিশ্রম আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করাতে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে বেশিদিন লাগেনি। নিজেই একটা ভ্রাম্যমান ব্যবসা শুরু করলাম। সোজা কথায় যদি বলি তাহলে এক কোম্পানি থেকে মাল কিনে অন্য কোম্পানিতে বিক্রি করা। আবার কখনো কখনো এই কোম্পানির মাল অর্ডার নিয়ে সেল করি অন্য কোম্পানিতে। এতে যা মুনাফা আসে তার থেকে কিছুটা আমি পাই। যদিও প্রথম প্রথম অর্থের একটা সংকট ছিলো বটে। কিন্তু আমার অফিসের বসকে বলাতে তিনি বেশ খানিকটা সাহায্য করেছিলো। এখনও করে। তারপর আস্তে আস্তে প্রসার ঘটলো। আর আজ এখানে দাঁড়িয়ে।
    .
  • তুমি সত্যিই ভালো আছো নীল?
    আমার চোখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলো অনু। সানগ্লাসটা আর চোখে দেওয়া হলো না, তার আগেই অনু বললো,
  • খবরদার নীল, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করো না। আমি জানি তুমি তা পারবে না কোনোদিনও, তবুও…. তবুও কেনো এমনটা করতে চাও বলো তো?
    .
    মুখে একটা হাসি এনে মাথা নিচু করে পকেটে রেখে দিলাম সানগ্লাসটা। তারপর নিচু মাথাতেই বললাম,
  • বলেছিলাম বেঁচে থাকবো। আছি তো।
  • আমায় তুমি ক্ষমা করেছো তো নীল? কোনো প্রকার অভিযোগ নেই তো?
    .
    এই প্রশ্নটার জবাব অবশ্য দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
  • অনু, তুমি এখানে কী করছো? কতক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজছি বলো তো……এইদিকে
    .
    শেষের প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে গেলো লোকটা। তার নজর এখন আমার দিকে। আমাকে দেখেই অনুর দিকে জিজ্ঞাসু চাহনিতে একবার তাকালো লোকটা। অনু একটু আমতা আমতা করেই বললো,
  • নীল…..
    উত্তর শুনে লোকটা আবারও আমার দিকে তাকালো। চোখে মুখে একটা হাসির ঝিলিক। এ হাসি মিথ্যে নয়। লোকটা আরও হাসি হাসি মুখে আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
  • তাহলে আপনিই নীল? অনুর মুখে আপনার কথা শুনেছি অনেক। দেখুন, আপনি হয়তো আমার উপর রাগ করে আছেন। কিন্তু সত্যি বলছি, আমি এর কিছুই জানতাম না। যদি জানতাম তাহলে আমি কখনোই অনুকে বিয়ে করতাম না। অনুও তো আমাকে কিছু বলেনি। বললো অনেক পরে। আমার উপর কোনো রাগ নেই তো আপনার?
    .
    লোকটার কথায় আমি বেশ অবাকই হলাম। ভেবেছিলাম হয়তো আমার সাথে নিজের স্ত্রীকে এমন ভাবে দেখে বেশ রাগই করবেন ভদ্রলোক। কিন্তু না তেমনটা মোটেও হলো না। বরং লোকটা নিজেই অনুশোচনা করছে। বুঝলাম অনুর যোগ্য পাত্র বটে। একটু হেসেই বললাম,
  • না কখনোই না।
    আমার এই হাসিতে কোনো মিথ্যে নাটক ছিলো না। মনে মনে বেশ তৃপ্তি পেলাম। সাথে একটা যেনো ভারী পাথরও নেমে গেলো বুক থেকে। ভালোবাসার মানুষটাকে শুধু কাছে পেলেই সুখী হতে হয় না, কখনো কখনো তার ভালো থাকাতেও সুখী হওয়া যায়।
  • দেখুন, আজ একেবারেই সময় নেই, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার। আপনারা চাইলে কথা বলতে পারেন। অনু তুমি এক কাজ করো, আমি রিক্সা করে যাচ্ছি। তুমি বাবুকে নিয়ে গাড়িতে এসো। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।
  • না না, আমারও অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাকেও যেতে হবে।
    এই কথাতে লোকটা আমার দিকে বেশ অবাক হয়েই তাকালো। তারপর বললো,
  • সেকি, এত দিন পর দেখা। আমি আসাতে তো ভালো করে কথায় বলা হলো না। আর এখনি চলে যাবেন?
  • হ্যাঁ, আসলে…..
  • তাহলে এক কাজ করুন, আপনি সময় করে একদিন আমাদের বাসাতে আসুন না। অনুর বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমরা সেখানেই থাকছি। প্লিজ আসবেন কিন্তু, আমরা দুইজনই আপনার অপেক্ষায় থাকবো। অনু তুমি এসো, আমি একটা কল সেরে আসি। জরুরি কল।
    .
    কথাটা বলেই লোকটা চলে গেলো। বুঝলাম তিনিও ছলচাতুরিতে কম যান না। কল আসেনি মোটেও, তবুও……। মনে মনে হাসলাম একটু। দেখলাম অনু আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখটা টলমল করছে। হয়তো আর বেশিক্ষণ নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার যাওয়া উচিত। কিন্ত বাঁধ সাধলো অনু। বললো,
  • উত্তর দিলে না তো।
  • তুমি কোনো দোষ করোনি অনু, তাই ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। সেদিনও বলেছি আজও বলছি।
    .
    এতক্ষণে বাচ্চাটার দিকে ভালো করে তাকালাম। সত্যি বলতে কী মায়ের মত হয়নি মোটেও। এ যেন বাবার মুখের ছবি ফুটে আছে। বললাম,
  • নাম কী রেখেছো?
    প্রশ্নটা শুনে চোখের পানি মুছে নিলো অনু। তারপর বললো,
  • বিন্দু।
  • বাহ্ সুন্দর তো।
  • নীল, আসবে তো তুমি?
  • আমি যাই অনু, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
  • বললে না তো?
  • সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই, এতে প্রশ্নটা হারিয়ে যায়।
    .
    ততক্ষণে সানগ্লাসটা চোখে পরে নিয়েছি। বুঝলাম শুধু অনুরই না, আমার চোখটাও ভিজে উঠছে একটু একটু করে। অনু হয়তো বুঝেছে, ওর চোখ ফাঁকি দিতে আগেও পারতাম না আর আজও….।

_সমাপ্ত।
.
লিখেছেনঃ Sajib Mahmud Neel

Send private message to author
What’s your Reaction?
2
1
0
0
1
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Sajib Mahmud Neel
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!