অপেক্ষা

মেইন সড়কটি পার হয়ে রেললাইন, রেলপথের দু-পাশ ঘিরে গায়গায় বইঘর। লাইব্রেরি-ঘুঁজি অতিক্রম করেই দেখলাম তোরণদ্বারের উপরে বড়ো অক্ষরে লেখা— “সরকারি বিএল কলেজ।” তখনও ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা শুরু হয়নি। গেইটের কাছে আসতেই একজন মেহেদিরাঙা-দাড়িওয়ালা চাচা আমাকে ভালো করে কিছুক্ষণ নিরীক্ষা করল। তারপর সালাম দিয়ে ছোট দরজা আগলে ধরল। আমি প্রতি-সালাম জানিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। দুপাশে ফুলের বাগান। রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আলো-আলো করে ধরেছে। পথের দু-ধার দিয়ে গাদাগাদা হলুদ গাঁদা ফুল। তার নিচে বসা একটা উদাসীন বালক। (বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তাই বালক বললাম। তবে সাবালক এতটুকু নির্ধারণ করা যায়।) একটি পা ছড়ানো, অন্য হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে দুহাতে জড়িয়ে বসে আছে। ময়লা জিন্স-প্যান্ট, মোজাবিহীন কেডস, স্টাইফের দলা-পাকানো জামা পরিহিত লোকটি আমাকে দেখে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। বুক-খোলা জামার ফাঁকে কোঁকড়ানো ঘনকালো লোমশ বুকের ওপর একটি সোনার চেন চিকচিক করছে। একটা লকেট-ও দোদুল্যমান। আমার দিকে একনিমেষ তাকিয়ে মাথা নিচু করে রইল। গালভর্তি দাড়ি-গোঁফ। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। অত্যধিক দীর্ঘ নয়। মাঝেমধ্যে বোধকরি সেখানে চিরুনি এবং কাঁচি চালিত হয়। কিন্তু দাড়ি-গোঁফের অবস্থা একেবারে বিদিখিস্তি। গোঁফগুলো ফেঁপে নাকের ছিদ্র এবং গাল ঢেকে ফেলেছে। সে উঠে দাঁড়াল। টিনটিনে শরীর। চুলের মধ্যে বাম হাতের অঙ্গুলিসমষ্টি ঢুকিয়ে চুলকাতে চুলকাতে এগিয়ে এলো। “সমৃদ্ধি-কে দেখছেন, স্যার? ঐ যে, ঐ বিভাগে পড়ে।” বলে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দিকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দেখালো। লম্বা-হাতার শার্টের হাতা গোটানো। এক-মনে অনাবৃত হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। অস্পষ্ট কিছু লেখা। তারপর বিড়বিড় করে বললো, “আমার সমৃদ্ধি।” তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। একটা উদাসীন শান্ত সুরে বলল, “সমৃদ্ধি আমাকে বসিয়ে রেখে সেই যে গ্যাছে স্যার, এখনো আসছে না কেন!” একটু থেমে বলল, “ও একটু বেখেয়ালি। ঠিক আসবে। সমৃদ্ধি বলছিল, আমি ডিপার্টমেন্টে যাব আর আসব, তুমি এইখানেই থেকো।..” আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় দারোয়ান-চাচা এলো।

“স্যার, ওর কথা শুনে সময় নষ্ট করবেন না। একটা বদ্ধ পাগল। সবাইকেই থামায়ে এই-ভাবেই সময় নষ্ট করে মাইনষের।” দারোয়ান-জির অবজ্ঞাভরা কথায় কিছু গোপনতা প্রকাশ পেল। কিন্তু সে গোপনীয়তা কী জানা গেল না। সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই যা যা, ওইদিক যা, বকুলতলায় গিয়ে বোইসকে যা।” বদ্ধ-পাগলটা বাধ্য ছেলের মতো হেঁটে চলল। দারোয়ান-জি বিনীত ভঙ্গিতে বলল, “আসেন স্যার। প্রন্সিপালের কোয়ার্টার ঐ দিকে। আমি আপনাকে আগায় দি’ , চলেন।” বললাম, “আপনি চিনেন নাকি আমাকে?” “চিনব না, আপনি আমার কলেজের প্রিন্সিপালের জামাই-বাবা ত। স্যার আমাকে আগেই বলে রাখছিলেন। আপনাকে দেইখেই চিনছিলাম।”

দারোয়ান-জি আমাকে পথ দেখিয়ে হাঁটছেন। সোজা পিচঢালা পথ। মাঝেমধ্যে দু-একটি বড়ো বড়ো আম গাছ রাস্তার উপরে ডালপালা ঝাঁপিয়ে ছাউনি তৈরি করেছে। কিছুটা পথ যেতেই বাম পাশে শান বাঁধানো লম্বা দীঘী। একটা ছোট মেয়ে জলে ঢেউ দিয়ে দিয়ে কলসিতে জল ভরছে। ডানপাশে গ্রীলাবৃত মন্দির। সরস্বতীর রং-করা মাটির মুখ দেখা যাচ্ছে। দারোয়ান-জিকে জিজ্ঞেস করলাম, “চাচা কতোদিন চাকরি করছেন আপনি এখানে।”

চাচা অনিশ্চিতভাবে বললেন, “তা বছর কুড়ি ত হবে।”

এই ছেলেটাকে আপনি কতোদিন ধরে দেখছেন?

কে? ওই পাগলটা? তা বছর তিনেক! সারা মানুষকে ওর ওই একই কথা। ওই যে কী-নাম বলে..।

উনি মনে করার চেষ্টা করছিলেন। বললাম, “সমৃদ্ধি।”

হঁ, ওই নামের মেয়েটারে ও তিন বছর ধরে খুঁজতেছে। বোধহয় ছ্যাকা দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করছে মেয়েটা। সেই অবধি পাগল।

ও, আচ্ছা। আমরা বোধহয় পৌঁছে গেছি।

হঁ, ওই ত, আপনের শ্বশুরের কোয়ার্টার।

উনি আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনই আমাকে অভ্যর্থনা করে বাসায় ঢোকালেন। শাশুড়ি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন, বললেন, “বাবা, তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি এখুনি চা রেডি করছি।” শ্বশুরমশয় আমাকে বাথরুম পর্যন্ত এগিয়ে বাইরে থেকে সুইচ টিপে বাতিটাও জ্বেলে গেলেন। তিনজন একসঙ্গে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। শ্বশুরমশাই বললেন, “তোমার আসতে অসুবিধা হয়নি ত?” শাশুড়ি বললেন, “তুমি ত বাবা, খুলনাতে প্রথম এলে এই। তোমাদের বিয়েটা আমাদের গ্রামের বাড়িতেই হয়েছিল। তারপর আর তোমাদের ফুরসতই হলো কই আমাদের বুড়ো-বুড়িকে একপলক দেখতে আসার।” দেখলাম শাশুড়ির মুখে একরাশ অভিযোগের ধারা। উনি বলতে থাকলেন, “তারপর ত দুজনে মিলে সোজা বিদেশ। তিন বছর পর এলে, তাও আমার মেয়েকে ছাড়া।” উনি চোখের কোণের জল মুছে নিলেন। শ্বশুর বললেন, “আহা, থামো ত! বেচারা কতোটা পথ জার্নি করে এসছে। আর মামনি ত কালই আসছে। ওদের ইউনিভার্সিটির ব্যাপার-স্যাপার, চাইলেই ত আর ছুটি পাওয়া যায় না। এ ত আর আমাদের বাংলাদেশ নয়।” শাশুড়ি-মা এবার একটু শান্ত হলেন। আমার পাশে এসে সোফায় বসলেন। বাচ্চাদের মতো করে বললেন, “বাবা, কিছু মনে করোনি ত? জানোই ত, ওই একটাই মেয়ে আমার। যাকে তিনটি বছর দেখার অপেক্ষায় চোখ আমার ছটফট করছে।” উনার চোখের কোণ আবার জলে ভরে উঠল। উনার কাঁধে হাত রেখে বললাম, “আপনার মামনি কালই আসবে।”

বিয়ের পরদিনই আমাদের চলে যেতে হয়েছিল। কারণ আমি তখন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার কাজ করছিলাম। মূলত বিয়ের জন্যই দেশে আসা ছিল। বিয়ের পর দেশে দুদিন থাকার আর অবকাশ পাইনি। এর পর জাপানে দুবছর কাটানোর পর বউও ইংল্যান্ডে ফিজিক্সে পিএইচডির সুযোগ পেয়ে যায়। একে ত পরিবার ছেড়ে বিদেশে আমরা দুজনই একসঙ্গে একা, তারউপর দু-বছর পর হলাম দুজনই একা। নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে আবার নিঃসঙ্গ। আমি ক’দিন আগেই দেশে চলে এলাম ইউনির্ভাসিটির ছুটিতে। ভেবেছিলাম বউ এলে একসঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাব। কিন্তু শাশুড়ি-মার আহাজুরিতে না এসে থাকা গেল না। বউ কাল আসবে। শাশুড়ির ছটফট চক্ষুজোড়াও দীর্ঘ দিবস-রজনী পর মেয়েকে পেয়ে দুদণ্ড স্বস্তি ফিরে পাবে। কেঁদে কেঁদে চোখের নিচ কালো করে ফেলেছে সে। শ্বশুরমশাই যদিও যথেষ্ট শক্তপোক্ত আছেন। তবে বিয়ের পরদিন সকালে শ্বশুরের কান্না আমাকেও আন্দোলিত করে ফেলেছিল, যখন তিনি আমার দুহাত মুষ্টি করে উনার মুখে তুলে ঠেকিয়েছিলেন। উনার চোখের জলে আমার মুঠি ভিজে উঠেছিল। উনি কিছুই বলতে পারেননি। কিন্তু তারও বেশি তিনি বলেছিলেন। উনাকে জড়িয়ে ধরে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিলাম, “আপনার মতো করে হয়ত আগলে রাখতে পারব না। তবু ভালোবাসব।” উনি নিজেকে ছাড়িয়ে অন্দরে চলে গিয়েছিলেন। সেই মেয়ে আজ তিনটি বৎসর আমার শ্বশুরের চোখের বাহিরে। উনার আবেগটা আমি বুঝতে চেষ্টা করছি।

বিকালে আর কোথাও বের হইনি। শাশুড়ি পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনি। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে বিকালটা কাটিয়েছি। রাতে সকলে একসাথে খেয়ে কিছুসময় গল্পগুজব করে তারপর শুতে এলাম। এর মধ্যে একবারও বউয়ের সাথে কথা হয়নি। সে বলেছে, প্লেনে উঠে নাকি মোবাইল চালানো নিষেধ আছে। আর একটা দিন আর রাত্রিই ত কেবল! তারপর ত সচক্ষে তাকে দেখতে পাব। আমিও আর জোরাজুরি করিনি।

ভোরে শাশুড়ির ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম। উনি আমাকে নিয়ে দীঘিতে এলেন। দীঘির জলে হালকা কুয়াশার আবরণ পড়েছে। অপর পাড়ে অবস্থিত চারতলা-ভবনটি আবছা বোঝা যাচ্ছে। কুয়াশার মধ্য দিয়ে লাল সাদা শাপলা-ফুল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শাশুড়ি বাগান থেকে ডালিতে ফুল ভরে মন্দিরে ঢুকলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে। তাকিয়ে দেখলাম গতদিনকার সেই পাগল-ছেলেটা আজও বসে আছে। এই ছেলে কোথায় থাকে, কী খায়, কে জানে! চোখ দুটো তার খুব মায়ায় ভরা। ভালোবাসা কী-না পারে! এইভাবে রোজ পথে পথে, খেয়ে-না-খেয়ে, মানুষের অবজ্ঞা অবহেলা সয়ে, দিশাহারা হয়ে অপেক্ষা করে যাচ্ছে শুধু ভালোবাসার-মানুষের কথা রাখতে। ভাবতেই শুদ্ধতম ভালোবাসার একটা প্রতিকৃতি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে আমাদের দিকে একটিবার তাকালো না। আনমনে বসে আছে। আজ গায়ে একটা আলোয়ান জড়ানো। পুজো শেষ করে আমরা চলে এলাম।

বেলা দশটা বাজে এখন। আমরা মেইন সড়কে এসে দাঁড়িয়েছি। গাড়ি-মানুষে গিজগিজ করছে শহর। একটু পর বিআরটিসির একটি লাল বাস এসে থামল। কয়েকজন নামার পর নামল বউ। আমাদের দেখে তার চোখমুখ উচ্ছলিত হলো। শাশুড়ি অশ্রুসজল চোখে তাঁর মেয়েকে আদর করলেন। তারপর সে তার বাবাকে প্রণাম করল। দেখি শ্বশুরের চোখেও চশমার আড়ালে অশ্রুফোঁটা গলগল করছে। দু-তিন মিনিট পর আমরা মেইন সড়ক থেকে রেললাইনে আসতেই অদূর থেকে একটি ট্রেনের পোঁ-পোঁ হুইসেল শোনা গেল। পথে লাল-সাদা ডোরা-আঁকা লোহার বেড় নামানো হয়েছে। আমি, বউ, শাশুড়ি ও শ্বশুরমশাই ক্রমে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এ-পারের ও-পারের বইঘরে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আশেপাশের দোকানদারেরা কেউ কেউ আমার বউয়ের দিকে কৌতূহল-দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চক্ষু মেলে। অকস্মাৎ ও-পার থেকে ‘সমৃদ্ধি’ ‘সমৃদ্ধি’ বলে চিৎকার করে ছুটে আসতে দেখলাম সেই পাগল-ছেলেটাকে। আর পরমুহূর্তেই ট্রেনের ঝকঝক ঝকঝক শব্দে সকল চিৎকার চেঁচামেচি চাপা পড়ে গেল। কী হলো এ-পারের কেউ জানে না এখনও। প্রায় পনের-বিশ সেকেন্ড মতো এ-পাশে অবস্থানরত সকল ঔৎসুক্য জনতার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে রইল ও-পারে। তারপর ট্রেন চলে যেতেই সকলে হুড়মুড় করে ছুটল। দোকানীরা দোকান থেকে গলা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। শুধু দেখলাম রক্তের ছড়াছড়ি। রক্তমাখা একটি শরীরকে ঘিরে ধরেছে অসংখ্য জনতা। কেউ একজন দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললেন, “এখানে কেউ সমৃদ্ধি আছেন? ছেলেটা যে এখনও অস্ফুটে ‘সমৃদ্ধি’ বলে চলছে।” লোকটি বলতে বলতে কেঁদে দিল। আমার শ্বশুর এবং শাশুড়ি দুজনই ঘটনাস্থলে উঁকি দিয়ে দেখছেন।

শুধু আমি আর সমৃদ্ধি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তখনও। সমৃদ্ধির স্থির চোখ গলে দুই কপোল ভেসে যাচ্ছে জলে। সমৃদ্ধির হাত শক্ত করে ধরে জনতার ভিড় ঠেলে পাগল-ছেলেটার কাছে যেতেই আকম্পমান শরীরে রক্তমাখা মুখে ছেলেটি আর-একটিবার ‘সমৃদ্ধি’ বলল। সমৃদ্ধি ছেলেটির ডানহাতটি মুখে চেপে ‘রুদ্র’ ‘রুদ্র’ বলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। শরীরের কম্পন ধীরে ধীরে স্তিমিত হলো রুদ্রর। তারপর তার শ্রান্ত চক্ষুজোড়া মুদে এলো।

রুদ্রর দীর্ঘ অপেক্ষা আজ সার্থক হলো। কিন্তু সে-অপেক্ষাটা কার? সমৃদ্ধির, না মৃত্যুর? সে উত্তর কারো জানা নেই। তবু সমৃদ্ধি ‘যাব আর আসব বলে’ যে কথা দিয়েছিল, সে-কথা সে তিনবছর পরে হলেও রক্ষা করল, এই যা!

অপেক্ষা! শুদ্ধতম ভালোবাসার এক অন্য নাম।

–সৌমেন মণ্ডল (Saumen Mondal)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
6
0
0
3
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Saumen Mondal
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Mahi An Nur
Member
Mahi An Nur
4 years ago

অসাধারন

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!