যাহা পাই তাহা চাই না

আমি আর আমার কলেজ লাইফের বন্ধু সুমন একসাথে একই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলাম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া আজকাল মুখের কথা না। 
যেদিন থেকে আমরা এই খুশির খবরটা পেলাম,সেদিন থেকে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশিদের সামনে বেশ খানিকটা ‘ভাব’ নিয়ে চলি। এখন আমার সাথে কথা বলতে আসলে যে কারো মনে হবে সে বোধহয় মহাজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে কথা বলছে!
বন্ধু সুমনও নিউটন কিংবা আর্কিমিডিসের মতো হাবভাব দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

আগামীকাল আমি আর সুমন ভর্তি হতে যাব। বিকেলে এলাকার বড় ভাই সোহান ভাইয়ের সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। আড্ডার মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘Ragging’. 
সোহান ভাইরা যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যায়,সেদিন ওদের ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইরা ওদের পাঁচজন বন্ধুকে দ্রুতগতিতে ‘পক’ এর নামতা বলতে বলেছিল।  

সোহান ভাইয়ের মতে,দ্রুতগতিতে এই উদ্ভট ‘নামতাটা’ বলা নাকি সোজা না। ‘পাখি পাকা পেঁপে খায়’ বলার মতো এলোমেলো হয়ে যায়। সোহান ভাইরা কেউই নাকি ঠিকমতো বলতে পারে নি।
‘পক’ এর নামতা ঠিকমতো বলতে না পারায় সোহান ভাইদের কী শাস্তি হয়েছিল- সেটা আর উনি খোলাসা করেন নি।  

আমার বন্ধু সুমন খুব মনোযোগ দিয়ে ‘পক’ এর নামতা পড়ে যাচ্ছে। পক এক্কে পক,পক দু’গুণে পকপক,তিন পকে পকপকপক,চার পকে পকপক পকপক………
বোকাটা ধরেই নিয়েছে,সিনিয়র ভাইয়ারা ওকে আগামীকাল পকের নামতা ধরবেই ধরবে।

সুমনের মতো আমি পকের নামতা নিয়ে ভাবছি না। আমি ভাবছি সেইসব সিনিয়রদের কথা,যারা ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো ‘Ragging’ টাকে একটা ‘সন্ত্রাস’ এর পর্যায়ে নিয়ে গেছে।  
এদের কাছে Ragging মানে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট, মানসিক কিংবা শারীরিক নির্যাতন। এসব জানোয়ারদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কিছু কিছু শিক্ষার্থী এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হয়। 
আমি মনেপ্রাণে চাই,আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাচ্ছি সে বিশ্ববিদ্যালয়সহ আর কোথাও Ragging এর নামে নির্যাতন করা সিনিয়র নামক কোনও মাথামোটা জানোয়ারের অস্তিত্ব থাকবে না।  

ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে এসে শুনলাম,আমাদের দু’জনেরই ম্যানেজমেন্ট থেকে একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে মাইগ্রেশন হয়েছে। খুশিতে নাচতে নাচতে দু’জন অফিসরুম থেকে ৪/৫ খানা করে সংশ্লিষ্ট ফর্ম নিয়ে একটা ক্লাসে ঢুকে গেলাম।
ক্লাসের মধ্যে কিছু ভাইয়া-আপু ছিল। আমরা খেয়াল করি নি। 

ভাইয়াগুলো আমাদের ইঙ্গিত করে বলল,”এই এদিকে আয়।” 
ভাইয়ারা আমাদের নাম জিজ্ঞেস করল,আমরা নাম বললাম। 
আপুদের দিকে দেখিয়ে বলল,”দুইজন দুই আপুরে প্রপোজ করবি।”
এই Ragging টা বড্ড কমন হয়ে গেছে। এই Rag টা বাংলা সিনেমার গরীবের ছেলে-ধনীর মেয়ের প্রেম কাহিনীর মতো আজকাল বহুল চর্চিত।  

সুমন অতোশতো না ভেবে ‘মোটামোটি’ সুন্দরী একটি আপুর কাছে গিয়ে বলল,”আপু পকের নামতা শুনবেন? পক এক্কে পক,পক দু’গুণে পকপক,তিন পকে পকপকপক…….. 
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পকের নামতা দিয়ে প্রপোজ করার একটি ব্যর্থ চেষ্টা মঞ্চস্থ হল! 

আপুটি ভ্রু কুঁচকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,”এই ছেলে,থামো।” 
পাশের গোলগাল একটি আপু ভাইয়াগুলোকে বলল,”ক’দিন ধরে কী যন্ত্রণা শুরু করেছিস তোরা? আজকের পর থেকে আর একজনকেও যদি আমাদের কাছে পাঠাস,তোদের খবর আছে। লুনার বয়ফ্রেন্ড কিন্তু পুলিশের এসআই হিসেবে জয়েন করেছে। তোদের সবক’টাকে গারদে ঢোকাবো।” 

এরপর একটি আপু আমাদের বললেন,”এক্ষুনি এ ক্লাস থেকে বের হও। হুটহাট কোনও ক্লাসে ঢুকে পড়বে না। গাধা ছেলেপেলে কোথাকার।” 
সেদিনের মতো ‘গাধা’ ডাক শুনে খুশি আমি জীবনেও হই নি। 

ভর্তির ফর্ম জমা দিয়ে বেরিয়ে আসছি,এমন সময় আমি ‘তাহাকে’ দেখলাম।
দীঘল কালো চুল,হালকা কাজল ছোঁয়ানো অপূর্ব চোখ,টিকোলো নাক,স্ট্রবেরির মতো ঠোঁট,দুধে আলতা গায়ের রঙের মেয়েটিকে আমি দেখলাম।
ঠিক ঐ মুহূর্তে আমার পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে গেল। 

মেয়েটা ওর মা আর ছোট বোনের সাথে এসেছে ভর্তি হতে। তার মানে ও আমার ক্লাসমেট হতে যাচ্ছে!

বন্ধু সুমনও মেয়েটাকে দেখে ক্রাশ খেয়ে গেছে। ও বলল,”দোস্ত,মেয়েটা কী সুন্দর দেখেছিস? ওকে পকের নামতা শোনানোর চেষ্টা করব নাকি?”
আমি রাগী গলায় ওকে বললাম,”ক্যাম্পাসে তোর পকের নামতা শোনানোর জন্য হাজারটা মেয়ে আছে! এই মেয়েটাকে তুই অবশ্যই ভাবী ডাকবি। কারণ,ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।” 

আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন,গত ক’দিন ধরে ফেসবুকে প্রচুর মেয়ে আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছে। ওদের বেশিরভাগই নবম-দশম কিংবা একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। 
অনেকে মেসেজও দেয়,”ভাইয়া কেমন আছেন? বাসার সবাই কেমন আছে? ডিনার করেছেন?” 
এদের মেসেজ নিয়ে ভাবার সময় আমার নেই। আমার ভাবনা-চিন্তার সবটুকু জুড়ে তো শুধু একজনই আছে। 

আমার যে ক্লাসমেটকে দেখে আমার প্রথম দর্শনে প্রেম হয়ে গেছে তার নাম তন্বী। একদিন সাহস করে ওকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দিলাম। ও-ও অ্যাকসেপ্ট করে নিল। মেয়েটার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেয়া ‘সিঙ্গেল’। আমার খুশি দেখে কে! 

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেও ফেসবুকে ওকে ‘নক’ করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। একদিন ও-ই আমাকে নক করল। এরপর আমার ক্রাশ, আমার ভালোবাসার সাথে ইনিয়ে-বিনিয়ে চ্যাটিং চলতে লাগল। 
মাঝে মাঝে তন্বী মেসেজের রিপ্লাই দিতে দেরী করতো। আমি অপেক্ষা করতাম। ওর জন্য অপেক্ষা না করলে কার জন্য করব? 

তন্বী আমার প্রিয় রঙ,প্রিয় খাবার,বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসি কি না, চাঁদ দেখতে পছন্দ করি কি না-এসব জেনে নিয়েছে। 
একজন বুদ্ধিমতী ‘প্রেমিকা’র মতো ও আমার পরিবারের সদস্যসংখ্যা,আমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস- সব জেনে নিয়েছে। একদিন তো ভিডিও কলে ওকে আমাদের বাসার সবগুলো রুম দেখাতে হল। 

এরপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তন্বী একদিন বিকেলে আমায় একটি ফুডকোর্টে দেখা করতে বলল। ও নাকি কী গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে।
গুরুত্বপূর্ণ কথা কী বলবে তা তো আমি জানিই। ভার্সিটিতে না বলে ফুডকোর্টে কথা বলতে চাওয়ার অর্থই হল,তন্বী আমাকে প্রপোজ করতে যাচ্ছে।  

সেদিন আমি লাল রঙের একটা শার্ট গায়ে চড়িয়ে, একগাদা বডি স্প্রে মেখে তন্বীর সাথে ঐ ফুডকোর্টে দেখা করতে গেলাম। তন্বী আজ হালকা সবুজ রঙের সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে। ওকে অপ্সরার মতো লাগছে। 
ও দু’টো ‘হার্ট শেপড’ কেকের অর্ডার দিল। মুখে আর বলার কী দরকার? হার্ট শেপড কেকের অর্ডার দিয়েই তো ও যা বলার বলে দিল।  

ফুড কোর্টে তন্বীর সাথে মুখোমুখি বসে আছি। দু’জনের সামনে দু’টো হার্ট শেপড কেক। তন্বী বলল,”তুমি কিছু মনে কোরো না। তোমাকে আস্ক না করেই কেকের অর্ডার দিলাম। একচুয়ালি ওদের এই কেকটা আমার ফেভারিট। এখানে এসে এটা না খেতে পারলে আমার দিনটাই মাটি হয়ে যায়। 
শোনো,তুমি আমার ছোট বোন তিতলিকে দেখেছো মে বি ভর্তির দিন।” 

আমি মনে মনে বললাম,”তিতলি কিংবা চায়ের কেতলি তোমার ছোট বোন হলে সে হবে আমার শালী। আগে বউ,পরে শালী।”
মুখে বললাম,”হ্যাঁ।”

তন্বী বলে যেতে লাগল,”আসলে তুমি কথাটা কীভাবে নেবে……..ভর্তির দিন তোমাকে দেখেই ও তোমার উপর ক্রাশ খেয়ে যায়। ও তোমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। তুমি অ্যাকসেপ্ট করেছো। কিন্তু তুমি নাকি ওর মেসেজের রিপ্লাই দাও নি। 
আমার বোনের ফেসবুক আইডি ‘সুরাইয়া হোসেন তিতলি।’ শী লাভস ইউ মাচ। ওর জন্যেই আমি তোমার পছন্দ- অপছন্দ,তোমার পরিবার সম্পর্কে জেনেছি। হাজার হোক,নিজের বোনকে তো আর যার তার সাথে ‘প্রেম’ করার পারমিশন দিতে পারি না।”  

তন্বীর কথা শুনে আমি হতভম্ব। মনে হচ্ছে যেন আমার হৃদয়টা কাঁচের গ্লাসের মতো ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। 
আমার কানে বাজছে রবি ঠাকুরের কবিতা, 
‘যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর
রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।’     

হঠাৎ ছ’ফুট লম্বা এক সুদর্শন তরুণ আমাদের টেবিলে এসে দাঁড়ালো। তন্বী বলল,”ওহ মুনিফ, পরিচয় করিয়ে দেই,এটা আমার বয়ফ্রেন্ড আশিক।” 
‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ বাক্যটির অর্থ আমি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। 

আশিক বলল,”ও,এটাই মুনিফ? সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ইউ আর গোয়িং টু বি মাই ভায়রা।” 
তন্বী বলল,”কী ব্যাপার মুনিফ? তুমি কেক খাচ্ছো না কেন? এই কেক তোমার পছন্দ নয়?”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,”খেতে ইচ্ছে করছে না। চলি।”
তন্বী বলল,”Ok. আমার বোন সুরাইয়া হোসেন তিতলিকে মেসেজ দিও কিন্তু।” 

আমি উঠে চলে আসলাম। সুমনের বাসায় যাব। ওর বাসায় গেলে হয়তো দু’জন মিলে জলছাদের উপর বসে পা ঝুলিয়ে পকের নামতা পড়তে হবে। 

তা-ও ভালো। অন্তত ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে তন্বী আর ওর বয়ফ্রেন্ডের সামনে বসে ‘বিস্বাদ’ হার্ট শেপড কেক খাওয়ার চেয়ে পকের নামতা পড়া অনেক ভালো।

Munif Muhtasim.

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
4
6
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Munif Muhtasim
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!