“আমার পোলায় কি মরণের সুম আমার কথা কইসিল?” ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মোমতাজের মায়ের কন্ঠের আকুলতা মফিজুলকে বিহ্বল করে দিল। মাত্র ছয় মাস আগে তিনি মফিজুলের চোখের সামনে শহীদ হয়েছেন। সালাহউদ্দিনের মা তাঁর অন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ব্যরাকে এসেছেন, ছেলের সাথে শেষ যাদের দেখা হয়েছে এমন কারো সাথে কথা বলতে। ছেলেটা জুলাই মাসে লাহোর থেকে পালিয়ে এসেছিল, মুক্তিযুদ্ধে লড়তে। মায়ের সাথে দেখা হয়নি।
মফিজুল বলল,“খালাম্মা, স্যারের পরাণে ভয় ডর আছিল না। মাইকে হুংকার দিতে দিতে, খানেদের দিকে আগাই যাইতেছিলেন। এক্কেরে ফাঁকা আসমানের তলে। তাঁর ধারে কাছে কোন আড় আছিল না”। একটু আগে তিনি ক্যাপ্টেন হাফিজের কাছেও এই কথা শুনেছেন। তারপরও তাঁর শোনার আগ্রহ কমছিল না।
ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের মায়ের আসার খবর শুনে, ইউনিটে উপস্থিত সবাই জড়ো হয়েছিল তাঁকে দেখার জন্যে। সালাহউদ্দিন স্যার তাঁদের প্রিয় কোম্পানি কমাণ্ডার ছিলেন। লাহোরে পোষ্টিং ছিল তাঁর। যুদ্ধে আসার কোন দরকারই ছিলনা। তবুও তিনি এসেছিলেন। শেয়াল কোটের পাহাড়ি নদী মনোয়ারই তাবি ঝাঁপিয়ে ইণ্ডিয়ায় পৌছে ছিলেন। সেখান থেকে তেলঢালা। তাঁর প্রিয় ফার্স্ট বেঙ্গল। বাড়িও যাননি। মা অপেক্ষা করবেন জেনেও।
মা বললেন, “পোলাডিরে আমি শেষ দেখছিলাম, লাহোরে ট্রেনিঙে যাওনের আগে। হ্যার কি মা’র কথা মনে অয় নাই?” পাকিস্তানিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে যাবার পর, মফিজুল তাঁর মাথাটা কোলে নিয়ে মুখে পানি দিতে দিতে বলেছিল, “স্যার কলেমা পড়েন”। তিনি বললেন, “আমার কলেমা আমি পড়ব, যদি টার্গেট দখলের আগে ভাগোস তরেও কিন্তু ছাড়ুম না”। সেই তার শেষ কথা। মফিজুল সালাহউদ্দিনের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল। তিনি অস্ফুটে বললেন, ‘লাহোর থন যুদ্ধে আসছিল, আমারে দ্যাকতে যায়নো। দ্যাশ বোলে তার মা”।
সালাহউদ্দিনের কামালপুরের সহযোদ্ধাদের মধ্যে যারা, ফিরে আসতে পেরেছিলেন তাঁরাও একটি দু’টি কথা যোগ করতে থাকলেন। “স্যার একদিন আগে, পাইয়াগো ক্যাম্পে যাইয়া হ্যাগো মাইরা, অস্ত্র নিয়া আইসা পড়ছিল”, বললেন একজন। আরেকজন বললেন, “আমগো মাথায় যখন আগেই শেল পইড়া গ্যালো গা, আমরা ভয়ে, যহন পলাইয়া যাবো ভাবতাছি, স্যার তো আমগো, ঘাড়ে ধইরা যুইদ্ধে নামাইছে। স্যাররে দেইখা সাহস পাইসি। সেদিন কি যে বিষ্টি খালাম্মা, অন্ধারে কিছু দ্যখা যাইতো না। আমরা খালি একেকবার ঝলকানির মধ্যে স্যারেরে দেখতে পাইতেছিলাম,সারের সাদা জামার জন্যে। কতজন কইলো স্যার সাদা জামা খুইলা ফ্যালেন, পাইয়ারা আপ্নেরে দেইখ্যা ফ্যালব। স্যারে কি কইল জানেন নি? স্যারে কইল, সাদা জামা না থাকলে তোরা তো আমার দেখতে পাবিনা। আমারে দেইখা টার্গেটের দিকে চল। ইয়াহিয়া খান আমার জন্যে গুলি বানাইতে পারে নাই”।
সালাহউদ্দিনের মা বললেন, “পোলাডা কি মরণের সুম কষ্ট পাইসে?”, আবার ডুকরে উঠল মফিজুল। “খালাম্মা স্যারে কষ্ট পান নাই। আমি ওয়াটার বটল খুইলা সারের মুখে পানি দিসি। মনে মনে বলল, সার তো কষ্ট বুঝার সময় টাও পান নাই। একবার ডাইনে মোচড় দিয়ে ফের বামে মুচড়াইয়াই তো পইড়া গেল গা”,। ধরা গলায় মা বললেন, “বাজান যে আতে তুমি পোলাডারে শেষবারের মত পানি খাওয়াইসিলা, সেই আত খান ধরি কিছু সম বই থাহি? ”,মফিজুল নিঃশব্দে হাত দু’টি বাড়িয়ে দিল।
সালাহউদ্দিনের মাকে দেখার জন্যে যারা ভিড় করেছিলেন তাদের ফোপানির জন্যে তাঁর কথা শোনা গেলনা। তিনি মফিজুলের হাত দু’টি ধরে বসে রইলেন।
- সাইদুল ইসলাম(Saidul Islam)





Best wishes Sir.
Thanks
দেশ মা’র জন্য এরকম কত আত্মত্যাগের গল্পই না জমে আছে ইতিহাসের পাতায় অথচ আমরা ঠিক ভাবে সেগুলো জানি না। এরকম গল্প আরও পড়তে চাই।
সাথে থাকুন। গল্প আরও আসবে