“একটি মেয়ের গল্প”
লেখা: আসিফ হোসাইন
গ্রামে আর কত! ঘরে ঘরে এখন টেইলার্সের কাম পারে মাইনষ্যে। বড় চাচায় কইছে শহরে আইলে গার্মেন্টসে কাম লইয়া দিবো। এজন্যই ঢাকা যাইতাছি। – হাসি হাসি মুখে কথাগুলো বলছিলেন লাইলি আক্তার। বয়স ২৫ এর কাছাকাছি হবে। বাসে চড়ে স্বপ্নের ঢাকায় পাড়ি দিচ্ছেন একটি চাকরির আশায়৷ লাইলির পাশের সীটে বসে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে কথাগুলো শুনছিলেন, পঞ্চাশোর্ধ রমজান মিয়া৷
বৃদ্ধ রমজান মিয়া পিচিক করে একদলা পানের পিক বাসের জানালা দিয়ে ফেলতে গিয়ে পিছনের সীটে বসা এক তরুণের হাতে লাগিয়ে দিলেন। পান খাওয়া লালচে দাঁতগুলো বের করে হেসে দিয়ে তরুণ ছেলেটিকে বললো,
- বাজান জানলাটা লাগায় দিয়া বসো। আর এই নাও টিস্যু। হাতটা মুইছা ফেলাও।
ছেলেটির রাগে শরীর কাঁপছে। বৃদ্ধের দেওয়া টিস্যুটি ব্যবহৃত। পানের পিক লেগে রক্তের মতো ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে টিস্যুতে।
রমজান মিয়া ছেলেটির রাগী মুখ উপেক্ষা করে লাইলির সাথে গল্প জমিয়ে দেয়।
- তা মা, তোমার বড় চাচায় থাকে কই?
লাইলি খুব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
- জানি না ঠিক। চাচায় আমার জন্য সায়েদাবাদ অপেক্ষা করবো কইছে।
রমজান মিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে। এই লোকের হাসির রোগ আছে। কথা বলার সময়ও হাসে। কথা শুনেও হাসে।
রমজান মিয়া লাইলিকে ফিরতি প্রশ্ন করে,
- আগে কখনো ঢাকা আইছিলা?
লাইলি মাথা নেড়ে উত্তর দেয়,
- না।
রমজান মিয়া আবার হাসে। লাইলি লক্ষ্য করে দেখলো,
বৃদ্ধ লাইলির দিকে ধীরে ধীরে চেপে বসতে চাচ্ছে। জানালার সীট থেকে কিছুটা চেপে লাইলির উরু, পা এর সাথে নিজের পা মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বারবার। লাইলি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। হাতের ব্যাগটি সীটে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সীটের উপরিভাগ ধরে৷
রমজান মিয়া তার লালচে দাঁত বের করে বললো,
- মা, তোমার কি পা ব্যথা করতাছে?
লাইলি সরল গলায় বললো,
- না চাচা। আপনার জায়গা বেশি লাগে। তাই আপনারে জায়গা কইরা দিলাম।
রমজান মিয়া ভরকে যায়। প্রত্যন্ত গ্রামের একটি সরল মেয়ে এভাবে প্রতিবাদ করে বসবে সেটা রমজান মিয়ার মাথায় ছিলো না৷
পিছনের সীটে বসা তরুণ ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো। লাইলির দিকে তাকিয়ে ইশারায় তার সীটে বসতে বললো।
লাইলি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
- আমার সমস্যা হইতাছে না৷ আপনি বসুন৷
বাস দ্রুত চলতে শুরু করলো। হুটহাট ব্রেক চাপাতে লাইলির দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। সামনে থেকে বাসের হেল্পার ছেলেটি এসে বললো,
- আপা আপনি বসেন না কেন?
লাইলি রমজান মিয়ার দিকে হাত দেখিয়ে বললো,
- এই চাচার জায়গা বেশি লাগে। তাই জায়গা ছাইড়া দিছি।
হেল্পার চোখমুখ শক্ত করে বললো,
- বুঝছি আপা। জানোয়ারগুলা আর মানুষ হইলো না।
পিছনের সীটে বসা এক ভদ্রলোককে অনুরোধ করে রমজান মিয়ার পাশে বসতে বললো হেল্পার ছেলেটি। ভদ্রলোক সাথেসাথেই উঠে রমজান মিয়ার পাশে এসে বসলো। লাইলিকে বসতে বললো খালি সীট’টিতে।
লাইলি স্বস্তি ফিরে পেলো। পাশে বসা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো,
- কিছু মনে কইরেন না। আমি চুপচাপ থাকতে পারি না। আপনি নামবেন কই?
ছেলেটি বললো,
- জ্বী, আমি সায়েদাবাদ নামবো।
- আপনি সায়েদাবাদ নামবেন? যাক ভালোই হইলো, আমিও সায়েদাবাদই নামমু। – উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো লাইলি।
তরুণ ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো, - আপনি কি, এই প্রথম ঢাকা যাচ্ছেন?
- হ। চাকরি করুম ঢাকা গিয়া। চাচায় কইছে চাকরি নিয়া দিবো।
- ও আচ্ছা।
- আপনি কই যাইতাছেন?
- আমি একটি কাজে এসেছিলাম নেত্রকোনা। কাজ শেষ হওয়াতে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি।
- ওহ বুঝছি। আপনি শহরের পোলা! আইচ্ছা, আপনার নাম কি?
- জ্বী, আমার নাম ইউসুফ।
নাম শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো লাইলি। ইউসুফ বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- হাসছেন কেন?
লাইলির হাসি থামেই না। হেসে হেসেই বললো,
- আমাগো গ্রামে প্রত্যেকটা চায়ের দোকানে একটা গান বাজায়। সেই গানের কথা মনে পইড়া হাসি পাইলো।
লাইলি মুখ চেপে আবার হাসে। ইউসুফ আবার প্রশ্ন করলো,
- আমার নামের সাথে সেই গানের কি সম্পর্ক?
লাইলি উড়না দিয়ে মুখ চেপে রেখেও হাসি থামাতে পারছে না৷ হাসতে হাসতে চোখের কোণে পানি জমে গেছে। খুব কষ্টে হাসি থামিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করলো,
“তুমি আমার ইউসুফ বন্ধু,
আমি তোমার জুলেখা….
বেঁচে থাকলে তোমার সাথে
হইবে দেখা…..”
গান থামিয়ে লাইলি আবার হাসে। ইউসুফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লাইলির দিকে।
মেয়েটার হাসি এখন আর বিরক্ত লাগছে না। লাইলির চোখ সুন্দর। বিষণ্ণ আর ভাসা ভাসা। কপালে ছোট্ট একটি কালো টিপ। উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে হাসির কারণে কপালের টিপ ব্রু’র কাছে এসে পড়েছে। ইউসুফ সেই দৃশ্য দেখে হেসে দেয়৷ লাইলি এবার হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করলো,
- আপনি হাসেন ক্যান?
ইউসুফ আবার হাসলো। কপালের দিকে তাকিয়ে বললো,
- আপনার কপালের টিপ সরে গেছে কিছুটা। ঠিক করে নেন।
লাইলি ব্যাগ থেকে ছোট্ট আয়না বের করে টিপ ঠিক করতে করতে গলার স্বর খুব নরম করে বললো,
- মেলায় নিয়া এক পাতা টিপ কিনে দিছিলো বাপে। আর এখন আমার বাপটায় বিছনায় পইড়া আছে।
- কি হয়েছে আপনার বাবার?
জিজ্ঞেস করলো ইউসুফ।
লাইলি ভারি গলায় বললো,
- টিবি রোগ ধরা পড়ছে। ওষুধ খাইতাছে। বাকীটা আল্লার ইচ্ছা৷
ইউসুফ সান্তনা দিয়ে বললো,
- আল্লাহ ভরসা, আল্লাহ সুস্থ করে দিবেন।
লাইলি বললো,
- আমার বাপটায় আমারে খুব আদর কইরা পালছে৷ আর এখন আমি চাকরি কইরা আমার বাপেরে পালুম ইনশাআল্লাহ।
ইউসুফ জিজ্ঞেস করলো,
- আপনার বড় চাচা ঢাকায় কি করেন?
লাইলি সহজ গলায় বললো,
- জানি না। তবে বাপে কইছে অনেক বড় ব্যবসায়ী।
- ও আচ্ছা। তাহলে তো ভালোই। যাই হোক, আমার এই কার্ডটি রাখুন। কখনো প্রয়োজন মনে হলে ফোন দিবেন। আমার এয়ারপোর্ট নামতে হবে।
লাইলি কার্ডটি নিয়ে ব্যাগে রেখে দিয়ে বললো,
- পৌছাইতে আর কতক্ষণ লাগবো?
- এইতো আর এক ঘন্টার মতো লাগবে।
লাইলি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
- তাইলে তো আইসাই পড়ছি প্রায়।
ইউসুফ সীট ছেড়ে উঠে দাড়ালো। লাইলির দিকে তাকিয়ে বললো,
- সামনেই নামতে হবে। ভালো থাকবেন। আর আপনার প্রতিবাদ করার ব্যাপারটি ভালো লেগেছে৷ একজন নারীর সবথেকে বড় শক্তি হলো, প্রতিবাদ করার সাহস।
লাইলি মৃদু হেসে বললো,
- আমাগো গ্রাম হইলে বুইড়ারে জুতার মালা পড়াইতাম। হিহিহি…
ইউসুফ এয়ারপোর্ট নেমে পড়লো। বড় ফুপি দেখা করে যেতে বলেছেন বলেই বাস থেকে নামতে হলো।
পরদিন সকালে ইউসুফের মোবাইলে একটি কল আসে আননোন নাম্বার থেকে। ইউসুফ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে খুব ভীতু কণ্ঠে বললো,
- আমি লাইলি কইতাছি। আমার অনেক বিপদ ভাই। চাচায় আমারে একটা আবাসিক হোটেলে বেঁইচা গেছে গা। সকাল থেকা আমার রুমের দরজা লাগায় রাখছি। বাইরে থেকা অনেক ধাক্কাধাক্কি আর গালাগালি করতাছে। আমারে বাঁচান দয়া কইরা।
লাইলি হাউমাউ করে কান্না করছে। ইউসুফ জিজ্ঞেস করলো,
- আচ্ছা আপনি আবাসিক হোটেলটির নাম বলতে পারবেন? প্লীজ দ্রুত বলুন।
লাইলি কান্না করতে করতেই হোটেলটির নাম বললো।
ইউসুফ ফোন কেটে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে আবাসিক হোটেলটির নিকটবর্তী থানায় পৌছালো। সব বিস্তারিত জানানোর পর থানা থেকে ডিউটি অফিসার জিজ্ঞেস করলো,
- আপনি মেয়েটির কি হোন?
- কিছুই না৷ বাসে পরিচয় হয়েছিলো গতকাল।
- অপরিচিত একটি মেয়ের জন্য আপনি থানায় এসেছেন?
- আরে ভাই অপরিচিত কোথায়? বললাম তো গতকাল পরিচয় হয়েছে। আপনি প্লীজ একটি ফোর্স পাঠান আমার সাথে। মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে।
- ভাই বললেই তো আর হলো না। আপনি এক কাজ করুন। আপনি একটি জিডি করুন।
ইউসুফের রাগে শরীর হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে৷ ডিউটি অফিসারের রুম থেকে বের হয়ে সরাসরি অফিসার ইনচার্জের রুমে প্রবেশ করলো। সব বিস্তারিত বলার পর সাথে সাথেই কাজ হলো। অফিসার ইনচার্জের অনুমতি সাপেক্ষে একদল পুলিশ নিয়ে রওনা হলো ইউসুফ।
হোটেলটিতে পৌছানোর পরপরই চিৎকার চেচামেচির শব্দ পাওয়া গেলো। সিড়ি বেয়ে দ্রুত তিনতলায় উঠার পর সবাই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো৷
ইউসুফের সাথে থাকা পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলো,
- গতকাল কোন মেয়েকে দিয়ে গেছে তোদের কাছে?
- জ্বী স্যার। এজন্য ৫০ হাজার টাকাও দিছি। কিন্তু মাইয়াডায় তো আর নাই।
ইউসুফ জিজ্ঞেস করলো,
- কোথায় গেছে বলতে পারেন?
- স্যার সকাল থেকা দরজা বন্ধ কইরা রাখছিলো। এক পর্যায় আমরা দরজা ভাইঙ্গা দেখি, মাইয়ায় ফ্যানের লগে ফাসিতে ঝুইলা রইছে।
ইউসুফ বাকরুদ্ধ হয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়লো সেখানেই। কানে শুধু একটি কথাই ভাসতে লাগলো,
” আমারে বাঁচান দয়া কইরা!প্লীজ আমারে বাঁচান”
পুলিশ হোটেলের সবাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর হোটেলটি সিলগালা করে দেয়। লাইলির মোবাইল থেকে ভাইব্রেশনের শব্দ ভেসে আসে। পুলিশ ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে হাতে নেয়। “Abba” নামে সেভ করা একটি নাম্বার থেকে কল বেজে চলেছে বিরামহীন ভাবে……..
★★★
“সমাপ্ত”




