সুহৃদ
“বৌমা, এদিকে একটু আসবে। এটা একটু দেখিয়ে দিয়ে যাও।”
“আসছি মা।”
কিছুদিন হলো শাশুড়িমাকে ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছি। তিন দিন আগে ওয়াশরুমে পড়ে মায়ের পা ফ্রেকচার হয়ে যায়। পায়ে এখন ব্যান্ডেজ। হাঁটাচলা বন্ধ। বিছানায় বসে বসে সিরিয়াল আর কত দেখা যায়! ওনার মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল। তাই ভাবলাম ওনার একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিই। ফেসবুক দেখে অন্তত উনি বসে বসে কিছুটা বিনোদন পাবেন। ফেসবুকের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিতে আমার কম ঘাম ঝরেনি। শাশুড়িমা এখন মোটামুটি ফেসবুক চালানো শিখে গেছেন।
“বৌমা, দেখোতো এই মেয়েটা কী জামা-কাপড়ের দোকানে কাজ করে?”
“না, মা। ও নিজের পেজ থেকে লাইভ ভিডিও দিচ্ছে। বলতে পারেন এটা তার নিজের অনলাইন বিজনেস। অনলাইনে এসব কাপড় কাস্টমারকে দেখানো হয় আর ক্রেতার পছন্দ হলে সে কিনে নেয়। কুড়িয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ক্রেতা তার জিনিস পেয়ে যায়। আর বিক্রেতা টাকা বিকাশ বা অন্য কোনো পন্থায় নেয়। এখন অনেকে অনলাইনে কেনাকাটা করে।”
“বাঃ ভালো তো। ঘরে বসেই ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে। বৌমা, তুমিও এমন কাজ করতে পারো।”
” কী যে বলেন মা! অত সহজ নয়। অনেক ঝক্কি আছে। কাপড়ের নতুন নতুন কালেকশান মার্কেট ঘুরে ঘুরে নিয়ে আসতে হবে। লাইভে জামা-কাপড় দেখাতে হবে। আর আপনার ছেলে মনে হয় না রাজি হবে।”
“আরে বাবুকে আমি বুঝিয়ে বলব। তুমি কত চেষ্টা করলে একটা চাকরির। আজকালকার দিনে মামা-চাচা না থাকলে চাকরি হয় না বুঝছ। তুমি নেমে পড়ো তো, আমি আছি তোমার সাথে।”
“আচ্ছা দেখি মা একটু চিন্তা করে। আপনার ছেলের সাথেও কথা বলে দেখি।”
জাহিদ প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। তার মতে এসব নিম্নমানের কাজ। অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা করলে তার বন্ধু এবং পরিচিত মহলে নাকি তার মান সম্মান কমে যাবে।
বিয়ের পর মাস্টার্স কমপ্লিট করি। তারপর কত জায়গায় সিভি দিলাম। দুই জায়গায় ইন্টার্ভিউ দিয়েও কাজ হলো না। আর কতদিন অপেক্ষায় থাকব! নিজের মতো করে কিছু খরচ করতে পারি না। জাহিদের কাছে চাইলে সে না করে না। তবুও বারবার চাইতে অসস্থি লাগে। সাধারণ একজোড়া কানেরদুল কিনতেও জাহিদের কাছে হাত পাততে হয়। আমার ছোট ভাইটা মাঝেমধ্যে আবদার করে। সেটা পূরণেও আমি ব্যর্থ। না, এভাবে ঘরে বসে দিন কাটাতে আমারো ভালো লাগে না। শাশুড়িমায়ের কথা সারারাত চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
শাশুড়িমা আর আমি দুজনে মিলে জাহিদকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করালাম। সাথে আমার দুই ননদও আমাদের সাথে একমত ছিল। বড় ননদ বিবাহিত। সে তার শ্বশুরালয়ে থাকে। ‘সুহৃদ’ নামে একটা ফেসবুক পেজ খুললাম। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সেখানে আমন্ত্রণ জানালাম। পেজ এ প্রথমদিকে শুধু শাড়ি আর থ্রীপিসের কাপড়ের ছবি আপলোড করি। তেমনভাবে কেউ কেনার আগ্রহ দেখায় না, শুধু দাম জিজ্ঞেস করে। শাশুড়িমা বলেছিলেন, আগে পরিচিতি বাড়াতে হবে। আর সেজন্য কিছুদিন আমরা কোনো লভ্যাংশ নেব না। মায়ের কথামতো কাজ করলাম। প্রথম প্রথম পরিচিতরাই ক্রেতা হিসেবে কিনছিল। এরপরেও হাল ছাড়িনি। শাশুড়িমা আর আমি কোমর বেঁধে নেমেছি। পিছু হাঁটার প্রশ্নই আসে না।
প্রায় দশবছর হতে চলেছে আমাদের ‘সুহৃদের’। অনেকটা পরিশ্রমের ফলে আমাদের শাশুড়ি-বৌমার অনলাইন ব্যবসা সফলতার মুখ দেখেছে। এরমধ্যে ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্স শেষ করি। শহরের ব্যস্ত সড়কের পাশেই দুই বছর আগে আমাদের একটা বুটিক খুলেছি। আমি, শাশুড়িমা আর আমার বড় ননদ মিলে বুটিক আর অনলাইনের সমস্ত কাজ সামলিয়ে আসছিলাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবকিছুতেই পরিবর্তন চলে এল। ‘করোনা’ এসে সব ওলটপালট করে দিল। দেশে করোনার বিস্তার শুরু হওয়ার মাস সাতেক পর জাহিদের এনজিওর চাকরিটা চলে গেল। ছোট ননদ বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে । আজ যদি ‘সুহৃদ’ না থাকত ভাবছি আমাদের পরিবারের কী হতো। সেদিন শাশুড়ি মায়ের নির্দেশ মেনেছিলাম বলে আমি আজ সাবলম্বি হতে পেরেছি।
জাহিদ নতুন চাকরির চেষ্টা করছে। যতদিন নতুন চাকরি হচ্ছে না সে সুহৃদের কাজে আমাদের সাহায্য করছে। করোনার কারণে এখন অনেকেই অনলাইন কেনাকাটায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। আমাদের পেজ বা বুটিকে সব বয়সের ব্যক্তিদের কাপড়ের পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসও রাখা হয়। জাহিদ এখন প্রায়ই আমাকে বলে, “শম্পা, আমাকে তোমার সুহৃদের পার্টনার করে নাও।” জাহিদ তার আগের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত। সে বুঝতে পেরেছে কোনো কাজই ছোট নয়। কাজ যদি সততার সাথে নিষ্ঠা নিয়ে করা যায় তবে যেকোনো কাজেই সফলতা আসতে বাধ্য। আজ সুহৃদের জন্যই পৃথিবীর এই কঠিন পরিস্থিতিতে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি। সুহৃদের নৌকায় চড়ে সাথে মানুষের ভালোবাসার বৈঠা চালিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
নিজের একটা পরিচয় থাকা বড্ড প্রয়োজন। আমি তো বলব সম্ভব হলে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অসমম্ভব কিছু নয়। কখন কোন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আমরা কেউ জানি না। এই যেমন ‘করোনা’ মহামারী এসে অনেককে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল।
পপি ধর (Popy Dhar)
২১.০৫.২০২১
গল্প





