একফোঁটা বাতাস

করোনার এই ক্রান্তিলগ্নেও প্রতিদিন মানুষ পীপিলিকার মতো ঘর ছেড়ে শপিং করতে বের হয়েছে, বাড়িতে ঈদ করতে দৌড়েছে..।
তারা দৌড়েছে সামনের দিকে, হয়তো মৃত্যু দৌড়েছে তাদের পেছন পেছন..!

আমার মায়ের খুব বড় ধরনের একটা অপারেশন হয়েছিলো।
কোলন ক্যান্সার হওয়ায় পেটের কিছু অর্গান কাঁটাছেড়া করে বাইপাস সার্জারি করতে হয়েছিলো।
কোরবানি ঈদের পরদিন হওয়ায় প্রাইভেট হাসপাতালে সার্জারীর ভালো ডাক্তার পাওয়া গেলো না।
একটা সরকারি হাসপাতালের একজন ভালো সার্জন, চার ঘন্টা লাগিয়ে মা’য়ের অপারেশন করেন।
কেবিন খালি নেই, পোষ্ট অপারেটিভে রাখার পরদিন ওয়ার্ডে রাখা হলো।
দুই রুগীর বেডের মাঝখানে একটু খালি জায়গায়, একটা চাদর বিছিয়ে মা’য়ের পাশে সারারাত শুয়ে বসে থাকি।
আমার ভাইয়া বাইরে বারান্দার নোংরা বেঞ্চিতে শুয়ে বসে রাত কাটায়।
একদিন রাতে একটু চোখ লেগে গেলো, সকালে উঠে দেখি হাসপাতালের রোগীদের খাবার খেয়ে মোটাতাজা একটা বেড়াল, চাদর সহ আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে..! সরকারি হাসপাতালে সেদিন গোসল করার মতো কোন ওয়াশরুমও খালি পাইনি।
হাসপাতালের অনেক অনিয়মের মাঝেও, মা’কে বাঁচানোর লড়াইয়ে নিজেকে ভুলে গেছি।
অপারেশন হওয়া মা’কে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে থাকার দিনগুলোর কথা মনে পড়লে অজান্তেই আজও শিউরে উঠি..!

দিন গেলে মনে হতো, মা যেন আস্তে আস্তে সুস্থ হচ্ছেন, মা’কে নিয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় আছি।
অপারেশনের পঞ্চম দিনে হঠাৎ কাপুনি দিয়ে মা’য়ের প্রচন্ড জ্বর আসে।
মা হয়তো বয়সের জন্য শরীরের বড় ধরনের অর্গানের কাটাছেঁড়ার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
ডাক্তার এসে দেখলেন মা’য়ের ‘পালস’ ‘বিপি’ দ্রুত ডাউন হচ্ছে।
ডাক্তার জানালেন যতদ্রুত সম্ভব ‘আইসিইউ’তে শিফট করতে হবে।
তখন ঐ হাসপাতালে ‘আইসিইউ’ খালি নেই, অন্য হাসপাতালে নিতে হবে।
কোন কারণে হাসপাতালের এম্বুলেন্সও পাচ্ছিনা।
এক শুভাকাঙ্ক্ষী ‘আঞ্জুমান মফিদুল’ এর এম্বুলেন্স কল করে এনে দিলেন। এম্বুলেন্সে পর্যাপ্ত পরিমানে অক্সিজেন না থাকায়, মা’কে অক্সিজেন দেয়া গেলো না..!
এম্বুলেন্সের ভিতরে মায়ের পাশে অসহায় আমি বসে কাঁদছি।
টের পাচ্ছি আমার মা’য়ের ‘এয়ার হাংগার’ শুরু হয়ে গেছে, পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগের বাতাসের ক্ষুধা..!
আহারে আহারে, পৃথিবীতে এতো বাতাস, আর আমার মা তার ফুসফুসে বাতাস টেনে নিতে পারছে না।
একফোঁটা বাতাসের জন্য আমার মা’য়ের হাহাকার, বসে বসে দেখা ছড়া আর কিছুই করার ছিলো না।
মনে পড়ে শক্ত হাতে মায়ের হাত ধরে রেখেছিলাম, যেন আমাকে ছেড়ে চলে না যায়..!

ভাইয়া ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, এই তো আমরা পৌঁছে গেছি।
কিন্তু না পৌঁছাতে অনেক দেরি, ঈদ করে ঘরে ফেরা মানুষের ঢল নেমে রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম।
ড্রাইভার তার হ্যান্ডমাইকে বলছে, “দয়া করে মৃত্যু পথযাত্রীর জন্য রাস্তা ছেড়ে দিন..!”
আহারে, লোকটাকে সেদিন একটু ধন্যবাদও দিতে পারলাম না, আমার মায়ের জন্য কি মমতাটাই না দেখালো..!
কয়েকঘন্টার ব্যবধানে তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত..!
আইসিইউ, লাইফ সাপোর্ট, লাশবাহী গাড়ি, আমার বাড়ির আঙ্গিনায় খাটিয়া..!
পায়ে হেটে হাসপাতালে যাওয়া মানুষটা, পাঁচদিন পর লাশবাহী গাড়িতে চাদরে প্যাঁচানো আমার প্রিয় মা..!

বাবার মৃত্যুর সময় খুব বড় ছিলাম না বলে, বাবার মৃত্যুর কথা তেমন মনে নেই।
তবে এতটুকু মনে আছে, বাবাও পায়ে হেটে ট্রেনে করে ঢাকা গেলেন চিকিৎসা করাতে।
আর বাড়ি ফিরলেন কফিনে করে..!
এই ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় দুইজন মানুষকে, আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় দেয়ার স্মৃতি।

আল্লাহকে বলি, “আর কোন প্রিয়জনকে বিদায় দেয়ার শক্তি আমার নাই, আর কাউকে বিদায় দিতে হলে তার আগে যেন আমিই চলে যাই..!
যাদের করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রিয়জনকে হারানোর ভয় নেই, তারা যেন আমার এই লেখাটা পড়েন।
এবং প্রিয়জনকে হারানো বেদনাটা যেনো একটু উপলব্ধি করেন।
আহারে, প্রিয়জন হারানোর বেদনা কতোটা কষ্টের, কতোটা কষ্টের..!
এম্বুলেন্সএ একফোঁটা বাতাসের জন্য হাহাকার করা, আমার মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখার অনুভূতি যেনো আজও টের পাই…

– Anjum Ruhi

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
0
0
0
1
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!