জীবনে প্রথম তখন বাবা মাকে ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছি।
বাবা নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিলেন।
সব ঠিক করে কোনটা কিভাবে করতে হবে দেখিয়ে দিয়ে একেবারে সেট করে দিয়ে এসেছিলেন। হলে সিট পেতে সময় লেগেছিলো। তার আগে একটা বোর্ডিং এ উঠেছিলাম। মেসে সবার সবার সাথে খাওয়া দাওয়া করতাম। মাকে ছাড়া খাওয়া, বাবার বকুনি নেই। সেই প্রথম নিজের আলাদা জীবন শুরু।
প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে সয়ে গিয়েছিলো সব। স্বাধীনতার আলাদা একটা মাদকতা আছে। কয়েকদিন ক্লাস করেই ডিপার্টমেন্টে ভালো পরিচয় হয়ে গেলো। খুব চমৎকার কাটতে লাগলো সময়। এর মধ্যেই হলে সিট পেয়ে গেলাম।
উঠতে দেরি করিনি। তখনও একটা জিনিস টের পাইনি। কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলাম।
আমাকে পেয়ে বসলো র্যাগিং আতংক।
হলে সিনিয়ররা জুনিয়রদের র্যাগিং করেই। বাংলাদেশের সব পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে এই পরম্পরা বজায় আছে। তবে আমাকেও যে এটা ফেস করতে হবে এটা আমার মাথায় তখনো আসে নি। আমার সিনিয়র বন্ধুবান্ধব ছিলো, আমি ভেবেছিলাম পার পেয়ে যাবো। হলে এসে বুঝলাম পার পাওয়ার কোন উপায় নাই।
র্যাগিং যে সবক্ষেত্রেই খুব খারাপ কিছু হবে এমনটা না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা সিনিয়র আর জুনিয়রদের মধ্যে দূরত্বের দেয়ালটা ভেঙে দেয়ার কাজটা করে। র্যাগিং মজারও হয়, যেমন শুধু গান গাওয়া বা নেচে দেখানো। আমি সবই জানতাম। সাথে এটাও জানতাম যে র্যাগিং এর শিকার হয়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
সুতরাং আমার এটা নিয়ে অস্বস্তি খুব স্বাভাবিক ছিলো।
আমি পালিয়ে পালিয়ে থাকা শুরু করলাম।র্যাগিং এর দিনগুলোতে হলে থাকতাম না।
সাথে শুরু করলাম ইনফরমেশন কালেকশন। সিনিয়র বন্ধু থাকায় খবর পেয়ে যেতাম আগেই। নির্দিষ্ট এক একটা দিন সিরিয়াল র্যাগিং হতো। অবশ্যই গভীর রাতে, রুম থেকে ডেকে নিয়ে। ঘুমিয়ে আছে না পড়ালেখা করছে তাতে কিছুই যায় আসে না। সিনেমায় যেভাবে দেখায় সব জুনিয়রদের একসাথে মাঠে বা কমনরুমে র্যাগিং করে সেভাবে সাধারণত হয় না। হয় ওয়ান বাই ওয়ান। একজন জুনিয়রকে রুমে নিয়ে টর্চার সেলের মতো করা হয়। চোখের সামনে জ্বালানো হয় পাওয়ারফুল লাইট। চোখ ধাঁধিয়ে যায় সেই আলোতে। আর চারপাশে ঘিরে বসে সিনিয়ররা। তারপর শুরু হয় র্যাগিং।
বেশি দিন পালিয়ে থাকা গেলো না। খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে গেলো, আমি ছাড়া আমার সাথের আর সবার র্যাগিং শেষ। ক্যাম্পাসে সিনিয়রদের দৃষ্টি আমাকে তাদের উপস্থিতি জানান দিতে লাগলো।
সহপাঠীদের র্যাগিং অভিজ্ঞতা শুনে ভরসা পাচ্ছিলাম না। ছেড়েই দিবো কি না হল ভাবছিলাম। এর মধ্যেই একদিন ঘটে গেলো ঘটনা।
গভীর রাতে রুমের দরজায় ধুমধুম করে নক। আমার রুমমেট দরজা খুলে দিলো। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। চার-পাঁচজন ঢুকে পড়লো রুমে। খাট থেকে আমাকে দাঁড় করিয়ে নিয়েই হাঁটানো শুরু করলো।
রুম থেকে বের করে সেই লম্বা করিডোর ধরে হাঁটা।
আমাকে চশমা নেয়ারও সুযোগ দেয়া হয় নি। কিছু বলারও সুযোগ দেয়া হয় নি। আমি সবসময় চশমা পড়ে থাকি। দুপাশে দুজন দুহাত ধরে আছে, একজন পেছন থেকে ধরেছে ঘাড়ে। আরেকজন পেছনে হেঁটে আসছে। অনেকটা যেন সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় গুলি করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাসা থেকে কোন হতভাগ্য কে।
একটা জিনিস শুধু আমি জানি,কিন্তু অনেকেই জানে না। তারাও জানে না, যারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা হয়তো খেয়ালই করেনি, অথবা উত্তেজনায় ভুলে গেছে।
আমি চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখি না।
মোটামুটি সব ঝাপসা।
অনেকক্ষন হাঁটিয়ে নেয়ার পর আমাকে একটা রুমে ঢোকানো হলো। বুঝলাম অনেক লোক গোল হয়ে বসে আছে। রুমের মাঝে একটা চেয়ার। একদম সামনে একটা লাইট। ঝাপসা ঝাপসা দেখছি, অনুভব করছি, টের পাচ্ছি। পরিষ্কার কিন্তু দেখছি না।
আমাকে বসানো হলো চেয়ারে। চোখে মারা হলো পাওয়ারফুল লাইট। চারপাশে ঘিরে বসে আছে সিনিয়ররা। আবছা বুঝতে পারছি আমার সিনিয়র বন্ধুরাও তাদের মাঝে আছে।
আমি যদি পরিষ্কার দেখতাম তখন, নিশ্চিত তখন খুব ভয় পেয়ে যেতাম। শুধুমাত্র ঝাপসা দেখার কারণে আমার উপর পরিবেশ তখন তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি। জীবনে প্রথম চোখের মাইনাস পাওয়ারের জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হলো।
শুরু হলো চারপাশ থেকে গালি বৃষ্টি। আমি হাসিমুখ ধরে আছি। গালি শেষ হলে শুরু হলো হুমকি। যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে সে পরিস্থিতিতে। আমি আমার ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি লাইটের দিকে, মুখে রেখেছি হাসি। কিন্তু কানের কি হবে? সেটা তো খোলা। হৃদপিন্ড ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। বুঝতে দিচ্ছি না।
তারা অবাক হয়ে দেখলো আমি বিচলিত হচ্ছি না।
তারপর শুরু হলো প্রশ্ন। কোথায় বাড়ি, কয়টা প্রেম করিস, মারলে কি করবি, ফেল করে কবে পালাবি, এসব। যাই প্রশ্ন আসে আমি হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছি। আমি জানি আর যাই হোক গায়ে হাত পড়বে না। প্রশ্নের বেগ কমে আসছে।
হঠাৎ একটু রেগে যাওয়ার অভিনয় করলাম।
মুখ শক্ত করে বললাম,
“শেষ হয়েছে? আমি এখন উঠবো।”
সম্ভবত এ ধরনের কথা কেউ আশা করে নি। নীরব হয়ে গেলো পুরো রুম।
এক ভাই বললেন “আচ্ছা তুই একটা গান গা।”
এটারই অপেক্ষা করছিলাম আমি।
চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে শুরু করলাম,
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
একটা একটা করে সব দাঁড়িয়ে গেলো। জাতীয় সংগীত অগ্রাহ্যের সাহস কার!
শেষ হওয়া মাত্র জ্বলে উঠলো লাইট। চারপাশে করতালি। সিনিয়রদের সাথে হ্যান্ডশেক। চারপাশে প্রশংসা। “না ছেলের সাহস আছে বলতে হবে।”
শেষ হয়ে গেলো র্যাগিং। ফিরে এলাম রুমে।
বুকে হাত দিয়ে দেখলাম, তখনো বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। ভাগ্যিস আমার দৃষ্টি ঝাপসা ছিলো। নয়তো হার্ট অ্যাটাক করাও বিচিত্র ছিলো না।
সে ইউনিভার্সিটি থেকে আমার লেখাপড়া শেষ হয় নি। শেষ হয়েছিলো আরো পরে, অন্য এক ইউনিভার্সিটি থেকে। আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো পরের বছরই কোন এক ব্যাক্তিগত সমস্যাকে সামনে রেখে, সবকিছু ফেলে রেখে।
আমার সেখানে কাটানো সময়টা ছাড়াও এখনো আমার সেই সিনিয়রদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক।
এটা প্রায় পনের বছর আগের কথা।
তবে সেই টর্চার সেলের মতো ঝাপসা রুমটা আজও মনে আছে। সেটা ভোলা যাবে না।
দৃষ্টি ঝাপসা হয়, কিন্তু স্মৃতি হয়তো কখনো ঝাপসা হয় না।
Piash Mahboob Khan
Send private message to author



