চারিদিক নিস্তব্ধ। জীবনের কোলাহল প্রায় থেমে গেছে। মানুষের মধ্যে নেই প্রাণচাঞ্চল্য। চারিদিকে সবারই এক বিষন্ন, করুন আর ভয়ার্ত মুখ। করোনা মানুষকে বেঁধে রেখেছে চার দেয়ালের মাঝে। প্রায় প্রতিদিনই খবর আসে দেশ-বিদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রিয়জনদের মৃত্যুর। এ করুন পরিস্থিতি থেকে কবে মুক্তি কেউই জানেনা।
এই তো কদিন আগে বিনু ভর্তি হয়েছে চারুকলা কলেজে। সদ্য কৈশোর পেরোনো টগবগে এক তরুণী। সহপাঠী সবার সাথে এখনো তেমন পরিচয় আর জানাশোনা হয়ে ওঠেনি। কলেজে নবীন বরণ উৎসবে বিনু গেয়েছিল :
“ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে গানটি।”
সেদিন বিকেলে কলেজের বকুল তলায় বসে এলোমেলো সব ভাবছিলো বিনু। তেমন কারো সাথে এখনো তেমন সখ্যতা গড়ে উঠেনি। দল বেঁধে আড্ডা, কলেজের করিডোরে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি, লাইব্রেরী আর ক্যান্টিনে বসে দলবদ্ধ গল্প গুজব এগুলো কিছুই শুরু হয়নি এখনো। হঠাৎ কাছাকাছি কারো উপস্থিতি টের পায় সে। তাকায় পেছনে। দেখে সদ্য ফোঁটা একটা বড় লাল গোলাপ নিয়ে এক সহপাঠী এগিয়ে আসছে তার দিকে। ছেলেটি কাছে এসেই বলে,
“আমি শিশির, শিশির চৌধুরী। এবারই ভর্তি হলাম প্রথম বর্ষে। আজকে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আপনার গাওয়া গানটি চমৎকার হয়েছে। আপনাকে তাই শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। এই নিন।
শিশির গোলাপটি এগিয়ে দেয় তার দিকে। একেবারেই অপ্রস্তুত বিনু। আচমকা এই অবস্থায় বিনু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে কি করবে। কয়েক সেকেন্ড চলে গেল। ছেলেটি গোলাপ বিনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওর দিক থেকে এখনো কোন সাড়া নেই। কোন কিছু ভাবার আর সময় নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় সে। ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়িয়ে দেয়া লাল গোলাপটি হাতে নেয় বিনু।
গোলাপ হাতে নেয়ার পর দু’জনকেই খুব উৎফুল্ল মনে হল। শিশির এবার বিনুকে অনুরোধ করে বলে,
একটু বসি?
এ অনুরোধের পর বিনু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিশিরের দিকে। এক সিদ্ধান্তহীনতা় পেয়ে বসে তাকে। সময় গড়িয়ে যায় দ্রুত। এখনো নিশ্চুপ সে। বিনুর কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ওর পাশে বসে পড়ে শিশির। বিনু খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে এতে। তার পর ও সে তার আচরণে এ অস্বস্তি ভাব প্রকাশ করেনি শিশিরের সামনে।
দু-তিন মিনিট কেটে যায় এভাবেই। দুজনেই নিশ্চুপ। সীমাহীন নীরবতা পেয়ে বসে দু’জনকেই। কিভাবে শুরু করবে দুজনের কেউই তা বুঝে উঠতে পারেনা। কেটে যায় আরো কিছুটা সময়। আচমকা নীরবতা ভাঙ্গে শিশির। বলে,
“ক্যাম্পাসটা কি ভীষণ সুন্দর। দেখুন গাছগাছালি আর সবুজের কি বিপুল সমারোহ চারিদিকে? মনটা জুড়িয়ে যায় নিমিষেই।”
বিনু পরিষ্কার বুঝতে পারে কোন একটি প্রসঙ্গ দিয়ে শিশির হয়তো বা আলাপ শুরু করতে চায়। কিন্তু মনের দিক থেকে বিনু কোন রকম ইচ্ছা বা আগ্রহ বোধ করছে না।
নীরবতা ভাঙলো শিশিরই। বলতে লাগল জীবনের নানান কথা। সেই ছেলেবেলা, গ্রামে বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা আর এরকম আরো নানান প্রসঙ্গ। বিনু কোন আগ্রহই বোধ করছেনা তার কথা শুনতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে শুধু শুনেই যাচ্ছে একজন বাধ্য শ্রোতার মতো। এরপর ও আলাপে শিশিরের আগ্রহে কোন ভাটা দেখা যায়নি এক মুহূর্তের জন্যে হলে ও। এক পর্যায়ে বিনু বাসায় যাবার সময় হলো বলে উঠে দাঁড়ায়। শিশিরকে গানের প্রশংসা করা আর ফুল দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানায়।
বাই।
কাল দেখা হবে বলে দ্রুত পা বাড়ায় বিনু।
বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে বিনু ফিরে আসে বাসায়। পড়ন্ত বিকেলে আজকের বকুল তলার ঘটনা বার বার তার মনে আসে ঘুরে ফিরে। কেমন যেন এক অজানা ভালো লাগা আচ্ছন্ন করে তাকে। কিছুটা আনমনা হয়ে যায় বিনু। হঠাৎ এক বিষন্নতা আর দুঃখবোধ পেয়ে বসে তাকে। নিজেকে দোষী মনে হয় তার এই ভেবে যে কেন সে আজ শিশিরের সাথে আলাপে নীরব থেকেছিল। মনে মনে সে খুব লজ্জিত বোধ করে। বিনুর মনে প্রশ্ন আসে শিশির কি তার এই ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে? শিশির কি ভেবেছে সে অত্যন্ত অহংকারী একটি মেয়ে? এ রকম আরো নানান রকম ভাবনা। সে ভাবে হয়তো বা এই প্রথম দেখায়ই তাদের মধ্যে একটি ভালো লাগার জন্ম হয়েছে বলেই বিনুর মনে এই অপরাধ বোধ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বিষণ্নতা কিছুতেই কাটতে চায়না বিনুর। এক অপরাধ বোধ কুঁকড়ে কুঁকড়ে খাচ্ছে তাকে। মা এসে চা খাওয়ার জন্য ডাকে ওকে। বিষন্নতা আড়াল করে উঠে দাঁড়ায় বিনু। চা খেয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে আবার। আজ আর কোন কিছুতেই মন বসাতে পারে না। কিছুটা আগে ভাগেই রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় বিনু।
পরদিন যথারীতি কলেজে যায় বিনু। প্রথম ক্লাসের পরই এগিয়ে যায় শিশিরের দিকে। কোন প্রকার সংকোচ না করে একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠে, শিশির গতকাল আমার ব্যবহারের জন্য আমি ভীষণ দুঃখিত ও লজ্জিত। আপনার অনেক কথার পর ও আমি অনেক কথারই কোন জবাব দিইনি। কিছু মনে করবেন না।
প্লিজ।
শিশিরের সপ্রতিভ উত্তর। না আমি কিছুই মনে করিনি তাতে।
তুমি কেমন আছো বিনু?
বিনুর এবার অবাক হবার পালা। মাত্র সপ্তাহ খানেক ক্লাসের বয়স। এখনো অনেকেই আপনি থেকে তুমিতে আসতে পারেনি। হয়তো কয়েকটা দিন পরই সবাই তুমিতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। গতকালের খানিকটা আলাপের সময় ও শিশির বিনুকে আপনি বলেই সম্বোধন করেছে। একদিনেই এ পরিবর্তনে অনেকটা অবাকই হয় বিনু। তবে এতে মোটেও খারাপ বোধ করেনা সে। ভাবে সতীর্থরা অন্য সহপাঠীদের তো তুমি বলেই সম্বোধন করবে। আর সেটাই তো হবার কথা। কিন্তু বেশ কয়েক বার ইচ্ছে করলে ও বিনু শিশিরকে তুমি বলে সম্বোধন করতে পারেনি। কেমন যেন এক ধরনের জড়তা পেয়ে বসে তাকে। খানিকক্ষণ বাদে তার সব জড়তা কেটে যায়। শিশিরকে ও সে তুমি বলেই ডাকতে শুরু করে।
দিনগুলো ভালোই কেটে যায় দুজনের। আলাপচারিতা ও বেশ জমে ওঠে দুজনের। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চটপটি, ফুসকা, ঝালমুড়ি খাওয়া, কলেজ চত্বরে ঘুরাফেরা, করিডোরে মিনি আড্ডা আর মাঝে মাঝে বকুল তলায় বসে খানিকক্ষণ একান্তে আলাপ। কয়েক দিনের মধ্যেই দুজনের ঘনিষ্ঠতার পরিধি বাড়তে থাকে। কেমন জানি এক অজানা আকর্ষণ ছুঁয়ে যায় বিনুর হদয়। কিন্তু সাথে সাথে একটি নতুন ভাবনা ও আচ্ছন্ন করে বিনুকে। বিনু নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে আর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে তাদের এই সম্পর্ক কি নিরেট বন্ধুত্ব নাকি ভালোবাসা? বারবার এ প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসতে থাকে ওর মনে। এর কোন উত্তরই খুঁজে পায়না বিনু।
ইতিমধ্যেই প্রায় মাস খানেক পেরিয়ে গেছে। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক জানাশোনা আর মুগ্ধতার পরিধি ও বেড়েছে অনেক। পরস্পরকে ভালো লাগতে ও শুরু করেছে এরই মাঝে।
এরই মধ্যে মহামারী করোনার বিস্তার ঘটেছে বাংলাদেশে ও। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত চারুকলা কলেজ ও বন্ধ ঘোষিত হয়েছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য। ঘোষিত হয়েছে কোয়ারেনটাইন।
কলেজ বন্ধ। কার্যত সবাই ঘরবন্দী। সময় যেন আর কিছুতেই ফুরোতে চায় না। এই অল্প কয়েক দিনের কলেজের স্মৃতিগুলো বার বার মনে উঁকি দেয় বিনুর। বকুল তলায় শিশিরের দেয়া প্রস্ফুটিত লাল গোলাপ আর মাঝে মাঝে একান্তে আলাপের বিষয় গুলো মনে পড়ে যায় বিনুর। প্রায় প্রতিদিনই ফোনে কথা হয় শিশিরের সাথে। কথা যেন ফুরোতেই চায় না। ঘরবন্দী থেকেও একঘেয়েমি কেটে যায় শিশিরের সাথে আলাপে। বিনু স্পষ্টতই বুঝতে পারে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা ভালোবাসার ভিত গড়ে উঠছে।
সময় যেতে থাকে়। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বন্দী জীবনের সময় কাল ও। কলেজ খোলার দিনক্ষণ ও পেছাতে থাকে বার বার। কেউ জানেনা আবার কবে খুলবে কলেজ। কখন আবার দুজনে একান্তে বসবে বকুল তলায়।
হঠাৎ বিনুর বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেয় শহরে এ বন্দী দশায় আটকে না থেকে কিছুদিন না হয় গ্রামে ঘুরে আসা যাক। বিনুকে জানাতে সে সানন্দেই রাজি হয়ে যায়। শুরু হলো প্রস্তুতি। সবকিছুর সাথে বিনু প্রচুর পরিমাণে আঁকা আঁকির সামগ্রী ও সাথে নিলো। উদ্দেশ্য এ সময়টাতে গ্রামের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য ছবিতে বন্দী করা।
বিকেল নাগাদ বাড়ি পৌঁছে যায় বিনুরা। গাড়িতে থেকে বাক্স-পেটরা নামিয়ে নিয়ে সবাই নেমে পরে। ভাড়া পরিশোধ করে দিলে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে যায়। বাড়িতে এসে বিনু তার ব্যাগের জামা কাপড় আর অন্যান্য সামগ্রী গোছানো শুরু করে তার নির্ধারিত কক্ষে। কিছুক্ষণ পর সে শিশিরকে বাড়িতে পৌঁছার খবর দেয়ার জন্য ফোন খুঁজতে গিয়ে আর ফোনের কোন হদিস পায়না। গাড়িতে বাবা-মায়ের সামনে শিশিরের সাথে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করায় যতটুকু মনে পড়ে ফোনটি সে ব্যাগের কোন এক সাইড পকেটে রেখে দিয়েছিল। সমস্ত বাক্স-পেটরা বারবার তন্ন তন্ন করে খুঁজে বিনু। কিন্তু কোথাও সে তা খুঁজে পায় না। ছুটে যায় বাবা-মা আর অন্যদের কাছে। সবাই যার যার মালপত্রে আবার নতুন করে খুঁজতে থাকে যদি ফোনটি পাওয়া যায়। এক পর্যায়ে খোঁজা খুঁজির পর্ব শেষ হয়। কিন্তু ফোনটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বিনু স্পষ্টত বুঝতে পারে ফোনটি রাস্তায় বা গাড়িতে কোন এক সময় হয়তো বা হারিয়ে গেছে। বিষন্নতায় ভরে উঠে ওর মন। শিশিরের সাথে যোগাযোগের আর কোন উপায়ই থাকলো না ওর। ফোনে সেভ করা ছিল শিশিরের নাম্বারটি।
বিষণ্ণতা গ্রাস করে বিনুকে। গ্রামে বেড়াতে আসার আনন্দটা মুহূর্তেই মাটি হয়ে যায় ওর। মনটা ভারী হয়ে আসে। চোখের কোনে তার অশ্রু। বিষন্নতা পিছু ছাড়েনা বিনুর কিছুতেই। কেউ জানেনা কবে নাগাদ সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে। কবে আবার খুলবে কলেজ। কবে আবার দেখা হবে, শিশিরের সাথে। কথা হবে বকুল তলায়। বিনু ভাবে শিশির তার ফোনের অপেক্ষায় থেকে থেকে আর ফোন করে ওকে না পেয়ে না জানি কি বিষন্ন দিন কাটাচ্ছে। ভাবতেই পারেনা বিনু। অস্থিরতা ভর করে তাকে।
বিনুর মন খারাপ আর বিষণ্নতা দেখে বাবা তার জন্য আর একটি ফোনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সে তো আর কোন সমাধান নয়। বাবা মা তো আর জানেনা বিনুর মনের অবস্থাটা কি। বিনু বাবাকে বলে দেয় গ্রামে থাকার সময় তার আর কোন নতুন ফোনের দরকার নেই।
কষ্ট আর মনে প্রচন্ড এক দুঃখ নিয়ে কেটে যায় বিনুর প্রতিটি দিন। কয়েকদিন পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে সে। বাবা মা সহ বাড়ির অন্য কাউকে সে বুঝতে দেয় না তার কষ্টের উৎসটা কোথায়। প্রচন্ড কষ্ট করে হলে ও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বিনু।
বেশ কিছুদিন পর আজ কেন জানি শিশিরের কথা তার মনে পড়ছে বারবার। কিছুতেই ঘুম আসছে না। রাত অনেক হয়েছে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। জানালার ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে। বিষন্ন মন নিয়ে বিছানা থেকে উঠে যায় বিনু। মাথার পাশের জানালা খুলে দেয়। বাইরে জ্যোৎস্না স্নাত রাত। আনমনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে বাইরে। মনটা উদাস হয়ে যায় বিনুর। পাশে রাখা তার বড় স্যুটকেসটা খুলে সে। সেখানে রাখা তার আঁকা আঁকির সব উপাদান। বড় একটি ড্রয়িং শিট আর রং তুলি বের করে আনে বিনু। ফিরে আসে আবার জানালার পাশে। কল্পনায় ভেসে উঠে শিশিরের মুখ। পরম যত্ন আর মমতায় রং তুলির আঁচড় বসায় বিনু ড্রইং শীটে। যতটুকু সম্ভব হাতড়ে হাতড়ে মানস পটে ভেসে ওঠা স্মৃতি থেকে আঁকতে থাকে শিশিরের প্রতিচ্ছবি। কদিনের আর পরিচয় আর কতটুকুই বা জানা শোনা শিশিরের সাথে। প্রতিদিন রাত জেগে জেগে একটু একটু করে একসময় বিনু আঁকা শেষ করে শিশিরের একটি বড়সড় একটি পোট্রেট। ওর ইচ্ছে কলেজ খোলার দিন প্রথম দেখাতেই এই পোট্রেট উপহার দিয়ে চমকে দেবে শিশিরকে। বিনু ভাবে এটাই হবে শিশিরকে দেয়া একটি চমৎকার উপহার যার পরতে পরতে লেগে আছে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ।
মাস খানেক পর এলো সেই খুশির খবর। ঘোষণা এলো কলেজ খোলার। বিনু প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো শহরে ফিরে যাওয়ার। ব্যস্ত হয়ে পরলো কলেজে ফিরে যাবার আয়োজনে।
মাস তিন পর কলেজ আবার খুললো। চারিদিকে কোলাহল আর প্রাণচাঞ্চল্য। বহুদিন পর আবার কলেজ চত্বর, বকুলতলা হয়ে উঠলো মিলন মেলার এক মহাসমুদ্রে। বিনু ও যথাসময়ে আসে কলেজে। সাথে তার পরম মমতা আর ভালোবাসায় আঁকা শিশিরের সেই পোট্রেট। সারা চত্বর জুড়ে সে খুঁজে বেড়ায় শিশিরকে। কিন্তু খুঁজে পায়না তাকে কোথাও।
ক্লাসের সময় হয়ে যায় এরই মধ্যে। বিনু ভাবে ক্লাসেই হয়তো দেখা হয়ে যাবে শিশিরের সাথে। কিন্তু ক্লাসে ও নেই শিশির। বিনু নিশ্চিতই ধরে নেয় হয়তো সে দীর্ঘ বন্ধে ঢাকার বাইরে চলে গেছে। এখনো হয়তো ফিরে আসেনি। অপেক্ষা দীর্ঘ হয় বিনুর। দেখা না হলে ও আগের মত আর বিমর্ষ নয় সে। কলেজ খোলা। তাই যে কোনদিনই দেখা হয়ে যাবে ওর সাথে। আবার দুজনে বসবে বকুল তলায়। আলাপে আলাপে কেটে যাবে দীর্ঘ সময়। এতদিনের জমানো কথা তো আর এত অল্পতেই শেষ হয়ে যাবে না।
প্রায় সারাদিন ক্লাসের ব্যস্ততায় সময় চলে যায় বিনুর। সময় তখন বিকেল তিনটা। বিনুরা তখন ক্লাসে। কলেজের মাইকে একটি ঘোষণা এল। শ্রেণীকক্ষে থাকা স্পীকারে শোনা গেল সে ঘোষণা। বলা হলো আজ বিকাল চারটায় কলেজের একজন ছাত্রের করুণ মৃত্যু উপলক্ষে বকুলতলায় এক শোকসভা। সবাইকে যথাসময়ে বকুল তলায় উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেয়া হলো।
ঠিক সময়ে কলেজের সবাই উপস্থিত বকুল তলায়। অধীর আগ্রহে সবার অপেক্ষা। খানিকক্ষণ বাদেই কলেজের অধ্যক্ষ উপস্থিত হলেন শোক সভার মঞ্চে। এই বলে শুরু করলেন আমরা অত্যন্ত দুঃখ আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘোষণা করছি যে আমাদের প্রথম বর্ষের প্রিয় ছাত্র শিশির চৌধুরী আজ দুপুর ১ টা ৫০ মিনিটে নিজ শহর কুড়িগ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অধ্যক্ষ আরো কিছু বলার আগেই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে কান্নার আওয়াজ আসতে থাকে। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা একে অপরকে জড়িয়ে উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে। বিনু একেবারেই নির্বাক। তার হাতে শিশিরের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসা সেই পোট্রেট। মুহূর্তেই যেন তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকায় এদিক-ওদিক। যেন খুঁজে ফিরে কাউকে। কাঁদতে চেয়ে ও কাঁদতে পারেনা সে। অধিক শোকে সে এখন পাথর। অধ্যক্ষের বক্তব্যের পর শিশিরের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। এবারের সে আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারেনা। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। কেউ তো জানেনা তার মনের ভিতর তখন কি এক প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেউ তো এও জানেনা যে তার দুঃখের গভীরতা বাকীদের চাইতে অনেক অনেক বেশী।
একসময় শোক সভা শেষ হয়। বিষন্ন মন নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ছেড়ে যায় বকুল তলা। বিনুর চলে যেতে মন চায় না। তার জীবনের প্রথম ভালো লাগার জন্মতো এই বকুল তলা থেকেই। অল্প কদিনেই জায়গাটা হয়ে উঠেছিলো দুজনের খুব প্রিয়। কোন দিন বাদ যায়নি যেদিন দিনের কোনো না কোনো এক সময়ে দুজন একসাথে আর একান্তে সময় কাটায়নি এ বকুল তলায়।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বকুল তলা খালি হয়ে যায়। শুধু রয়ে যায় বিনু। এক বিশাল শূন্যতা ভর করে তার মনে। এ নির্জনতায় এবার আর তার কান্না থামতে চায় না। অবোধ শিশুর মতোই কাঁদতে থাকে বিনু। বকুল তলা থেকে সে কুড়িয়ে নেয় কিছু ফুল। এরপর গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়ে সে। চোখের জলে বুনে একটি বকুলের মালা।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দিগন্তে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে অপরাহ্ণের আলো। বিনু তখনো বসে আছে বকুল তলায়। এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন তার মন। কলেজ চত্বরে এখন তেমন কেউ আর নেই। চারিদিক প্রায় নির্জন। কলেজের এদিকটায় তেমন আলো নেই। কিছুটা আলো-আঁধারী।
উঠে দাঁড়ায় বিনু। ধীরে ধীরে খুলতে থাকে পরম যত্নে আর ভালোবাসায় আঁকা শিশিরের পোর্ট্রেটটি। লাগিয়ে দেয় তা বকুল গাছে। এরপর সদ্য গাঁথা বকুল ফুলের মালা টাঙ্গিয়ে দেয় শিশিরের সারা পোট্রেট জুড়ে।
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে শিশিরের ছবির সামনে। চোখে তখন বিনুর বাঁধ ভাংগা অশ্রু। ভাঙা হৃদয় নিয়ে এবার ধীরলয়ে পা বাড়ায় সে। পেছনে পড়ে থাকে স্মৃতির এক বিশাল সমুদ্র যে সমুদ্রে আজ আর নেই কোন উত্তাল তরঙ্গ।
মোঃ আওরঙ্গজেব চৌধুরী।
Md. Aowrangazeb Chowdhury
২৫ মে ২০২০।








অনেকদিন পর বেশ চমৎকার একটা লেখা পড়লাম। আশা করছি আরো লেখা পাবো আপনার কাছ থেকে ।
অসাধারন
গল্পটা বর্তমান পরিস্থিতির সাথে পুরোপুরি মিলে যায়!! এমন কত জন যে তার প্রিয় মানুষকে হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত!!
অসম্ভব সুন্দর লেখা। মন ছুঁয়ে গেছে।
Very nice story.