নজরুল সংগীতের পথিকার ফিরোজা বেগম

ফিরোজা বেগম হলেন বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান ও বরেণ্য নজরুল সংগীত শিল্পী। নজরুল সংগীতের জন্য বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও অন্যান্য আধুনিক গানও করেছেন তিনি। দেশি-বিদেশি বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং পেয়েছেন বিদ্রোহী কবি নজরুলের দুর্লভ সান্নিধ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁকে বাংলা সংগীতের প্রতীকিরূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ফিরোজা বেগম ১৯৩০ সালের ২৮শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তাঁর বাবা খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম কৌঁসুলি। মা বেগম কওকাবুন্নেসা ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিণী। এই দম্পতির তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে ফিরোজা বেগম ছিলেন তৃতীয়া।

শ্রাবণ মাসের মুখর বাদল দিনের এক শুভক্ষণে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁকে অনেকে শ্রাবণী বলে ডাকতেন। আবার তিনি ছোটবেলায় ফর্সা টুকটুকে থাকার কারণে কেউ কেউ তাঁকে টুকটুকি বলেও ডাকতেন। আর কাজের লোকেদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় ‘সেজবু’। কিন্তু সব নাম-অভিধা উপেক্ষা করে বাবা মায়ের দেওয়া ফিরোজা নামটি ওতপ্রোতভাবে মিশে যায় তাঁর জীবনের সাথে। ফিরোজা হচ্ছে এক ধরণের বহু মূল্যবান নীল রত্ন। বাবা মায়ের কাছে হয়ত নীল রত্নের মত মূল্যবান ছিলেন বলেই তাঁরা তাঁর এই নামটি রাখেন। তবে এই নামটি রাখার সময় কেউ হয়তো কল্পনা করেনি যে, সেদিনের সেই ছোট্ট নীল রত্ন একদিন সঙ্গীতাঙ্গনেও উজ্জ্বল রত্ন হয়ে থাকবেন।

সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁর নক্ষত্র হয়ে থাকার অনুমান কারোর আগে থেকে না করারই কথা। কেননা, তাঁর শৈশব শুরু হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের ত্রিশ দশক থেকে। ইংরেজদের রাজত্ব ছিল তখন রমরমা। ব্রিটিশদের করকবল থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের আভাস তখনও পাওয়া যায়নি। বাবা ব্রিটিশ সরকারের কৌঁসুলি থাকার সুবাদে তাঁদের বাড়িতে ছিল ব্রিটিশ অফিসার কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের নিত্য দিনের আনাগোনা। গল্পগুজব, শলাপরামর্শে পার হয়ে যেত সময়। ভেতর থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় আসত চা-জলখাবার। সবকিছুই হত কিন্তু বালিকা মেয়েদের কেবল স্বাচ্ছন্দ্য মত বিচরণ করতে দেওয়া হত না। সে সময় ছেলেদের সংগীত চর্চার অনুমোদন দেওয়া হলেও, মেয়েদের করা হত বঞ্চিত। নারীদের থাকতে হত অবরোধবাসিনী হয়ে। কেননা সে সময় মুসলিম সমজ ছিল অনেকটাই গোঁড়া ও রক্ষণশীল।
ঠিক এজন্য ফিরোজা বেগম শৈশবে সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হলেও, তাঁকেও থাকতে হয়েছে অবরোধবাসিনী হয়ে। সংগীতের উপর প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সুযোগ করে দেওয়া হয়নি ওস্তাদের নিকট থেকে তালিম নেওয়ার। তাই তিনি কলের গানে গান শুনতেন আর লোকচক্ষুর আড়ালে এসে মনের মাধুরী মিশিয়ে গান গাইতেন। অভিজাত এই পরিবারের দৃশ্য ছিল এমনই।

সাল ১৯৪০। এই বছরের কোন এক গ্রীষ্মের ছুটিতে ছোট মামা আর কাকাতো ভাইদের সঙ্গে কলকাতায় মামাবাড়িতে যান তিনি। মামাবাড়িতে এসে সুরের মূর্ছনায় সবাইকে মুগ্ধ করে দেন সেদিনের ছোট্ট ফিরোজা। তাঁর এমন গানের প্রতিভা দেখে মামা তাঁকে নিয়ে যান এক গানের মজলিশে। সেখানে দেখেন সকলের মধ্যমণি হয়ে যিনি বসে আছেন, তাঁর গায়ে ঘিয়ে রংয়ের পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি, লম্বা চুল এবং চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। লোকটিকে দেখে তখনও তিনি চিনতে পারেননি।
পরে বাড়ি ফিরে মামা তাঁকে বলেন, ‘জানিস তুই কাকে গান শুনিয়েছিস আজ?’
ছোট্ট ফিরোজা বলেন, ‘আমি কী করে জানব? আমি কি ওদের চিনি, দেখেছি নাকি কখনো?’
মামা বললেন, ‘ওই যে টুপি পরা, বড় চুল, আসরের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন, তোকে আদর করে পাশে বসালেন, উনি বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’

এই কথা শুনে সেদিন ছোট্ট ফিরোজা যে আনন্দ অনুভব করেছিলেন, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে এটই ছিল তাঁর সুস্থ কবি নজরুলের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ।
আসলে, ছোট থেকেই তিনি নজরুলের গান শুনে ও বইয়ের পাতায় নজরুলের কবিতা পড়ে নজরুলের একজন অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু নজরুলের কোনো ছবি তিনি সেইসময় দেখেননি। এজন্য নজরুলকে সামনাসামনি দেখেও তিনি চিনতে পারেননি।

সেদিন তিনি কবি নজরুলকে শুনিয়েছিলেন ‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা’ এই গানটি। গান শুনে কবি নজরুল মুগ্ধ হন। আরও বেশি মুগ্ধ ও খুশি হন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের একজন মেয়ে গান গাইছে, গান গাইতে চাইছে দেখে। কবি নজরুল তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “এত সুন্দর গান তুমি শিখলে কিভাবে?”। ফিরোজা উত্তরে বলেন “কালো কালো রেকর্ড শুনে নিজে নিজেই শিখেছি”। এটা শুনে কেবল কবি নজরুল নন, উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যান।

বলা বাহুল্য, কবি নজরুল খাঁটি হীরে চিনে নিতে ভুল করেননি। ১৯৪০-এর দশকে তিনি কবি নজরুলের পৃষ্ঠপোষকতায় সঙ্গীত ভুবনে পদার্পণ করেন। তিনি কবি নজরুলের নিকট হতে গানের তালিম নেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তিনি গানে কন্ঠ দেন। ১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ৭৮ আরপিএম ডিস্কে নজরুলগীতি নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। কিছুদিন পর প্রখ্যাত সুরকার, গায়ক ও গীতিকার কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হয়। এ রেকর্ডের গান ছিল- ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ আর ‘প্রীত শিখানে আয়া’।

এখান থেকে চোখে চোখ পড়ে যায় কমল দাশগুপ্তের চোখে। তারপর তাঁকে স্থান দেন হৃদয়ে। তাঁর এই হৃদয়ের অনুভূতিকে সার্থক রূপ দেওয়ার জন্য ১৯৫৫ সালে কমল দাশগুপ্তের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও সার্থকভাবে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন তাঁর সাথে।

বিয়ের পর তাঁর গানের খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশ বিদেশ থেকে নানারকম গান ও চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু তাঁর এই আকাশস্পর্শী খ্যাতি কখনো তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সবসময় অনাড়ম্বর জীবন অতিবাহিত করেছেন, কখনো বিত্তের পিছনে ছোটেননি। তাই তো, প্লেব্যাকের মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন সারাজীবন। সারাবিশ্ব তিনি পরিভ্রমণ করেছেন নজরুলের গান নিয়ে। দেশে-বিদেশে একক অনুষ্ঠান করেছেন প্রায় ৩৮০টির অধিক। সারাজীবন নজরুল সংগীতে সাধনা করে গিয়েছেন তিনি।
নজরুল সংগীত এবং ফিরোজা বেগম নানা গানের ভিড়ে নিজেকে আলাদা করে নেয়ার এক তীব্র ইচ্ছা কাজ করত তাঁর মধ্যে। আর তা অন্য কোনগান নয়- নজরুলগীতি।এটা ছিল তাঁর কাছে এক চ্যালেঞ্জের মতো। তখন নজরুল সংগীত বলা হত না, বলা হত আধুনিক গান লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরে সেটা থেকে নজরুল সংগীত হয়। আর ফিরোজা বেগমের চেষ্টাতেই তা নজরুল সংগীত অভিধায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে।।

তিনি নজরু সসংগীতের পাশাপাশি অল্প পরিমাণে আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত-সহ বিভিন্ন ধরণের সংগীতেও তিনি কন্ঠ দিয়েছেন।

এছাড়া, স্বনামধন্য ভারতীয় গায়িকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নজরুল সংগীত ও অতুলপ্রসাদের গান শিখিয়েছেন তিনি।

সংগীত শাস্ত্রে অবদানের জন্য তিনি দেশে বিদেশে পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলে স্বাধীনতা পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, সত্যজিৎ রায় স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার এবং একুশে পদক।

শেষ জীবনে দীর্ঘদিন হৃদযন্ত্র ও কিডনি সক্রান্ত জটিলতায় ভোগেন তিনি। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভর্তি করা হয় রাজধানী ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানেই তিনি দীর্ঘ ৬৫ বছরের সংগীত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন।

Written by Shibli Sayeek (শিবলী সাইক)

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
7
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!