সেই সন্ধ্যার পর থেকে জরি এই রুমে বসে
আছে ,অপরিচিত কতগুলো মেয়ে এসে তাকে এ রুমে বসিয়ে রেখে চলে গেছে। বাংলায় এখন মাঘ মাসের মাঝামাঝি, বেশ ভালো ঠান্ডা এই অঞ্চলে । উত্তর দিকের জানলাটা বন্ধ কিন্তু কিছুটা ফাঁকা রয়েছে, সেই ফাঁকা জায়গাটা থেকে হু হু করে বাতাস আসছে । জরি পরনের শাড়িটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল। আজ তার বাসর রাত। এই রাত নিয়ে প্রতিটা মেয়ের বুঝি অনেক ভাবনা থাকে ,কিন্তু কই সে তো অসাড় হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বসে আছে । হয়তো মানুষটা এখনি চলে আসবে।
মানুষটার সাথে এর আগে মিনিট পাঁচেকের জন্য একবার দেখা হয়েছিল, বড় ভাবি হাত ধরে ছাদে নিয়ে গিয়েছিল, ছাদে তুলসী গাছটার পাশে লম্বা করে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিল ,আশে পাশের বাড়ির আলোয় তার মুখটা বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছিল। জরি চোখ তুলে তার দিকে তাকাল।
এই ভদ্রলোকটির সাথে তাহলে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে , আশ্চর্য লোকটিও তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। বড় ভাবি হড়বড় করে বলল,” তোমরা কিছুক্ষণ আলাপ করো আমি চললাম।” তারা কেউ কোন কথা বলল না, কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক বলল,” তোমাদের এই অঞ্চলে শিয়াল আছে নাকি ; শিয়ালের ডাক শুনতে পাচ্ছি।” জরি কিছু বলল না । আরও কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,” রায়হান আমার খুব ভাল বন্ধু, তার কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি।” জরি চট করে বলে উঠল কি শুনেছেন; উনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “রায়হান বলেছিল তুমি খুব ভালো ছবি আঁকো,খুব ঘুরে বেড়াতে পছন্দ কর, এইসব।” জরি মৃদু স্বরে বলল, ও আচ্ছা। রায়হান জরির মামাতো ভাই সেই এই বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। ভদ্রলোক বললেন, “ছাদে বেশ হাওয়া দিচ্ছে,তোমার কি ঠান্ডা লাগছে?” জরি বলল, আপনার সম্ভবত ঠান্ডা লাগছে, চলুন নিচে যাই। তাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে ভাবী ছুটে এসে বললেন “ওমা কথা শেষ।” তারা কেউ কোন কথা বললো না। সিড়ি দিযে নেমে গেল দুজনেই। তার কিছুক্ষণ পর জরি যখন তার রুমে, ভাবী এসে বললন “ও জরি তোকে তো আনিসের খুব পছন্দ হয়েছে, আগামী শুক্রবার বিয়ে।”
জরি ওইদিনই নিলয়কে জানিয়েছিল এই ঘটনা। নিলয়ের বুকে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলেছিল , তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।
নিলয়ের সাথে জরির পরিচয় হয়েছিল কলেজ গেটের বাইরে । সাব সিডিয়ারি ক্লাস করে যখন বের হচ্ছিল
হঠাৎ করে ভীষণ রোগা আর ফর্সা একটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,” আমি রুনুর মামাতো ভাই , রুনু আজ কলেজে আসেনি তাই আপনার কাছ থেকে নোট গুলো নিতে বলেছে। ” হড়বড় করে কথাগুলো বলে সে দাড়িয়ে রইল। জরি ওকে বলেছিল আপনি লাইব্রেরীতে আসুন ,ওখানে আপনাকে নোটগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছি । এভাবেই নিলয়ের সাথে জরির পরিচয়।
তারপর মফস্বলে ফাঁকা অলিতে-গলিতে তাদের হেঁটে বেড়ানো, কলেজের পিছনের পুকুর পাড়টায় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দুজন দুজনার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেওয়া , রুনুর বিয়ের দিন বিয়ে বাড়ির ছাদে নিলয় তাকে নিয়ে গিয়েছিল খুব জরুরী কথা বলবে বলে। ছাদের উঠেই এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ করে সিড়ি ঘরের পাশে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিল জরির। আহ!!! এমন কি সত্যি হয়েছিল; এসব শুধু এখন অবাস্তব মনে হয় জরির।
আরেক দিন নিখিল স্যারের প্রাইভেট ক্লাস করে যখন দুপুরের পর বাড়ি ফিরছিল জরি মাঝিপাড়ার রাস্তার ধরে হঠাৎ কোথা থেকে নিলয়ের সাইকেল সামনে এসে পড়ল, নিলয় বলল,”জরি ঘুরতে যাবে?”
সেদিন বেড়াতে গিয়েছিল তারা রত্নেশ্বরী নদীতে নৌকা নিয়ে । নৌকায় উঠে ছই এর ভিতরে ঢুকে জরির কোলে মাথা রাখল নিলয়, সারাটা বিকেল এমনি করে ঘুরে বেড়াল তারা। মাঝি কি যেন একটা গান ধরলো ওপাশ থেকে, গানের কথা ঠিক বোঝা গেল না কিন্তু তার গলায় খুব মায়া, খুব দরদ ছিল। সেদিন বিদায় নেয়ার পথে নিলয়কে জরি বলেছিল ,”বাড়ি থেকে কিন্তু আমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখছে ” , নিলয় মুখ বাঁকা করে বলেছিল ,” আরে ধূর তার আগেই তোমাকে নিয়ে আমি দূরে কোথাও চলে যাব।”
আচ্ছা এসব কোন জন্মের কথা ভাবছে জরি; এমন কি কোন দিন এসেছিল তার জীবনে।
আশেপাশে কোথাও কামিনী ফুলের গাছ আছে । ফুলের তীব্র ঘ্রাণে ভরে হয়ে গেছে ঘর। জরি ঠায় বসে আছে, যেন এখানে অনন্তকাল বসে থাকার জন্যই সে এসেছে, তার কোনো উত্তেজনা নেই, ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে সে । আচ্ছা এখন সময় কত, ঘরের বাইরে গাঢ় অন্ধকার; দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁপোকা ডাকছে, এই অঞ্চলটা মফস্বল শহর হলেও খুব একটা উন্নত নয়, গ্রামের মতোই চারদিকের পরিবেশ। আসার সময় জরি তা টের পেয়েছিল। অনেক ভেঙে ভেঙে আসতে হয়েছে তাদের । যোহরের পর কাবিনের হয় তাদের , তার পরপরই তারা রওনা হয়েছিল। মাগরিবের এর পর এ বাড়িতে এসে পৌছে তারা।
দরজায় খট করে আওয়াজ হলো, কতগুলো কিশোরী মেয়ে ভদ্রলোকটিকে সাথে নিয়ে রুমের মধ্যে ঢুকলো ,তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কি সব বলছে আর খিলখিল করে হেসে উঠছে। সবার মধ্যে কিছুটা বয়সে বড় একজন মহিলার হাতে সরবতের দুটো গ্লাস, উনি জরির পাশে বসে, একটা গ্লাস জরির হাতে তুলে দিলেন , আর চোখের ইশারায় ভদ্রলোক কে জরির পাশে বসতে বললেন, ভদ্রলোক জড়োসড়ো হয়ে জরির পাশে বসলেন। মহিলাটি উনার হাতে অন্য গ্লাসটি দিয়ে বললেন ,” নাও তোমার বউকে একটু মিষ্টি শরবত খাওয়াও। ” উনি অপ্রস্তুত হয়ে উসখুস করতে লাগলন। মহিলাটি বললেন ,” সম্পর্কে আমি তোমার ননাস হই, দেখি তুমিও তোমার স্বামীর মুখে একটু শরবত দাও , মুখটা আগে মিষ্টি করো। অন্য সব কিছু পরে আরো মিষ্টি লাগবে তাহলে।” এই সামান্য রসিকতায় ঘরের অন্য সব মেয়েরা হেসে উঠলো, ননাস মহিলাটি জরির গ্লাসের হাতটি নিয়ে ভদ্রলোকের মুখের কাছে ধরলো, উনি একটা চুমুক দিয়ে সরিয়ে দিলেন গ্লাস।
এই শরবত খাওয়া পর্ব শেষে অন্য সব মেয়েরা তাদের ঘিরে ধরলো । মহিলাটি বললেন ,”দরজা ভাল করে বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দাও। তাহলে কেউ আর ভির করবে না। আমরা এবার গেলাম, তোমরা থাকো তাহলে।” তারা দুজনে কেউ কিছু বললো না। মেয়েরা বের হয়ে যাবার পর ভদ্রলোক উঠে গিয়ে দরজার খিল লাগিয়ে দিল, জরির দিকে তাকিয়ে বললেন,” তুমি বোধ হয় খুব ক্লান্ত, তুমি চাইলে শুয়ে পড়তে পারো।”
জরি অবাক চোখে তাকিয়ে বলল শুয়ে পড়বো ? উনি বলল “কথা কালও বলা যাবে। অবশ্য তুমি চাইলে আমরা গল্প করতে পারি ।” এই প্রথম তার চোখের দিকে জরি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল , ভদ্রলোক চট করে চোখ সরিয়ে ফেলল।
খাটের অন্য মাথায় বসলেন উনি । তারপর খুব মৃদু গলায় বললেন , “জরি আমার জীবনটা কেটেছে খুব কষ্টে, ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি, বাবা আরেকটা বিয়ে করেন , তবে নতুন মা আমাদের ভীষণ ভালবাসতেন । অনেকগুলো ভাই বোন ছিলাম আমরা। নতুন মা আমাদের সবাইকে খুব কাছে টেনে নিয়েছিল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন মার ঘরে আমাদের এক বোন আসল। তার পরপরই মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলেন। অনেক বড় সংসারে বাবা ভীষণ হিমসিম খেয়ে গেলেন। ছাপোষা জীবন আমাদের।”
উনি হঠাৎ সচকিত হয়ে বললেন,” আচ্ছা কি সব কথা বলছি তোমাকে, তুমি বিরক্ত হচ্ছো না তো ?” জরি বলল, আপনি বলুন না, আমার শুনতে বেশ লাগছে। উনি বললেন,” জরি আমার কিছু চাইনা তুমি শুধু এই সংসারটাকে বেঁধে রেখো।”
ওনার চোখ মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। জরির হঠাৎ করে মনে হল ভদ্রলোকের কপালের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় ওনাকে। হঠাৎ ভিতরটা কি রকম ছটফটিয়ে উঠলো। মনে হল একটু ছুঁয়ে না দিতে পারলে নিশ্বাস আটকে যাবে তার।
জরি মনে মনে ভাবল ,সেদিন তুমি না এসে ভালোই করেছো নিলয়। দু দিনের প্রেমের গ্লানি আজন্ম বয়ে বেড়াতে চাওনি । তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষকে স্বীকৃতি দিতে পারোনি, ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলে।
সেদিন রাতে রেলস্টেশনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন নিলয় এলো না তখন চলন্ত ট্রেনের দিকে জরির ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল । তার আগের দিনে তারা সবকিছু ঠিক ঠাক করে রেখেছিল। জরি রাত আটটায় রেল স্টেশনে থাকবে। তারপর দুজনে একসাথে ময়মনসিং শহরে চলে যাব সেখানেই পরেরদিন সকালে তাদের বিয়ে হবে। তিন বছরের প্রেমের পরিনতি হবে। নিলয় শেষ পর্যন্ত আসেনি ,জরি অপেক্ষা করেছিল মধ্যরাত পর্যন্ত ।বাড়িতে বলে এসেছিল ছোট খালার বাসায় যাচ্ছে, রাতে ওখানে থাকবো
আচ্ছা একি করছে জরি, আজ তার বাসর রাত, তার স্বামী তার পাশেই , আর সে কি না পুরনো প্রেমিক কে নিয়ে ভাবছে। জরি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালো, কেমন শিশুদের মত মুখ করে ঘুমিয়ে আছে ,জরির বুকের মধ্যে কোথায় যেন কেমন করে উঠলো, না জরি এই লোকটাকেই ভালবাসবে । জরি আলগোছে তার স্বামীর বুকের উপর মাথাটা এলিয়ে দিল, ভদ্রলোক ধরমড়িয়ে উঠে বসল। বললো,”সারা দিনের ক্লান্তিতে চোখটা লেগে গিয়েছিল জরি।” সে তার শীতল হাতটা দিয়ে জরিকে স্পর্শ করল। ভালোবাসার স্পর্শ। যে স্পর্শের জন্য প্রতিটি মানুষ তৃষ্ণার্ত থাকে। জরিও হাত বাড়িয়ে স্বামীর কপাল স্পর্শ করল। আর মনে মনে বললো, নিলয় তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। কারন আমি বুঝে গেছি আমি খুব সুখী হব।
ঘরের চারদিকে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। আজ জরির বাসর রাত।
– Shancheta sharmeen
Send private message to author




Awesome… Carry on! 🙂