হায় হায়, চুল নাই?

টাকের তুকতাক

মার চুল কখনও চুল তার কবে কার টাইপ ছিলো না। তাই বলে সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার ধরণের হয়ে যাব এ কথা আমি কস্মিন কালেও ভাবিনি। আশঙ্কা শুরু হলো ১৯৮৮ সালে। আমি তখন পাহাড়ে। দিন রাত পেট্রোলিং করি হেলমেটে মাথা ঢেকে। রুমে যখন ফিরি, হ্যারিকেনের আলোয় আয়না দেখা হয়না। একদিন সকালে কোন কাজ ছিলো না। রুপ চর্চা করতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। কপাল বড় হয়ে গেছে। নাপিত চুল কাটতে এসে বললো। পেছন দিকে চুল পাতলা হয়ে উঠেছে। চুল একটু বড়ই থাক মাথা দেখা যাবে না। কয়েকদিনের মধ্যেই চারিদিকে রটে গেল আমার টাক পড়ছে। আমাদের ডাক্তার ছিলেন মইন স্যার, প্রায় মসৃণ মাথার অধিকারী। তিরিশের আশে পাশে বয়স। ব্রিগেডিয়ার ইব্রাহিম ক্যাম্প ভিজিটে এসে বললেন, ‘বয়স কী চল্লিশ ছয়েছে মইন?’ তাঁর এই নিরীহ প্রশ্নটি মইন স্যারের চেয়ে আমাকে বিচলিত করলো বেশি। আমি হন্যে হয়ে চুল গজানোর বুদ্ধি বের করতে থাকলাম। খবর পেলাম চীনারা একটা তেল বের করেছে মাথায় মাখলে চুল নিশ্চিত। সম্পূর্ণ টাক হয়ে ডলে ডলে মাথায় ঘষতে হবে দিনে অন্ততঃ দুই বার। গোসল করা যাবে মাথা না ভিজিয়ে। প্রায় এক মাসের বেতন (২৭০০ টাকা) দিয়ে কিনে ফেললাম এক শিশি অব্যর্থ দাওয়াই। মাথা কামিয়ে রুটিন করে মাথায় মাখি আর কিছুক্ষণ পর পর আয়না দেখি। পেট্রোলিঙ্গে যাবার সময়ও হ্যাভারস্যাকে আয়না থাকে। আমার সাঙ্গোপাঙ্গরা মুখ লুকিয়ে হাসে। আমি গায়ে মাখি না। কোন সমালোচনা ছাড়া কবে কোন মহত কর্ম সম্পাদন হয়েছে। আমার আরও ২৭০০ টাকা গেল সাতাশ টা চুলও নতুন করে গজালো না।

নেকদিন পর ছুটিতে বাড়ি এলাম। মা বললেন চাকরি টা ছেড়ে দে, এমনিতে ম্যালেরিয়া, সাপ খোপের ভয়, আবার মাথাটাও খালি হয়ে যাচ্ছে জলে জঙ্গলে! ভাগ্য ভালো কয়েক দিন পর ঢাকায় বদলী হয়ে এলাম।

মার বন্ধুরা তখন বিয়ে করা শুরু করেছে। কেউ প্রেম করে কেউ পাত্রী দেখে আর আমি চুলের ডাক্তার খুঁজি। একজন বললেন তোমার মাথায় খুশকি বেশি। গ্রাইসোভিন  ট্যাবলেট খাও। বললাম চুল গজাবে? উনি বললেন আগে তো খুশকির হাত থেকে বাঁচো। গ্রাইসোভিন বাদ দিয়ে এক হোমিও প্যাথের কাছে গেলাম। তিনি বললেন চুল গজাতে মিনোক্সিডিল ব্যাবহার করে দেখতে পারেন। কিছু তেল পাওয়া যায় মিনোক্সিডিল সহ। দিকে দিকে খবর পাঠালাম। চুল ছাড়া মাথা আবার মাথা নাকি? এর মধ্যে আমার এক বন্ধু আমাকে এক বাসায় নিয়ে গেলো আমার একটি গতি করার জন্যে। সেই বাসার সুন্দরী মেয়েটি পছন্দ করলো ঘটককে। আমি তখন বিয়ের আসা প্রায় চেড়েই দিলাম। একদিন বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি আমার পাঁচ বছরের ভাগ্নি শাউলি তার কয়েক জন পুচকে বন্ধু বান্ধবী নিয়ে হাজির হলো। তারা নাকি এর আগে বিশুদ্ধ টাক মানুষ দেখেনি। আমার ভাইজি আমাকে ডাকে টাকু চাচা। ততদিনে আমি সর্বংসহা। আমার মা কষ্ট পান। তাঁর সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ে চাকরির পরে। ‘বড় ভাইদের মাথায় ঘণ চুল, বাপের চুল পড়েনি এখনও। আর তোর মাথাখালি’।

মি ততদিনে চুল, বিয়ে সব কিছুর আসা ছেড়ে দিয়েছি। নিন্দুকদের বলি, যার বিচ্ছেদে কোন রক্ত পাত নেই। ব্যাথা নেই তা থাকলো আর গেলো তাতে কার কী আসে যায়! আর তাছাড়া আল্লাহ সুন্দর মাথাই বা ক’টি বানান! চুলের কারণে তো অন্যদের মাথা দেখারও সুযোগ নেই।

তার পরও আমার বিয়ে হলো সুন্দর একটি মেয়ের সাথে। আমার বড় মেয়ের যখন বছর চারেক বয়স, সন্ধ্যায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছি হাটতে। ডিসেম্বরের শীত সেদিন জেঁকে বসেছে। আমার স্ত্রী মেয়ের মাথায় টুপি দিয়ে দিয়েছে যেন ঠাণ্ডা না লাগে। বাসা থেকে বেরিয়েই মেয়ে বললো বাবা মুখটা নিচু করো। ভাবলাম বেড়াতে আনার জন্যে বাবাকে আদর করবে মেয়ে। আমি নিচু হতেই সে টুপিটা খুলে আমার মাথায় পরিয়ে দিলো। আমি বললাম এটা কী হলো। মেয়ের ছোট্ট উত্তর আমার লজ্জা লাগছে। সেদিন থেকে আবার চুল গজানোর প্রচেষ্টা শুরু হলো। সে গল্প অন্য কোন দিন।

  • সাইদুল ইসলাম ( Saidul Islam)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
2
1
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
সাইদুল ইসলাম
4.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Mamun Rashid
Member
4 years ago

দারূন লিখেছেন স্যার।

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!