মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে কিছু ইউরোপ বেসড এন.জি.ও দেশের যুদ্ধবিদ্ধস্ত মানুষদের নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে একটা বড় কাজ ছিলো যুদ্ধশিশুদের নিয়ে। ইউরোপজুড়ে, মূলত স্ক্যানডিনেভিয়ার নিঃসন্তান অনেক পিতামাতার কাছে তারা এই যুদ্ধশিশুদের দত্তক দেয়ার ব্যাবস্থা করে। পরবর্তীতে নিজের সন্তানের মতোই পরম মমতায় সেই শিশুরা বেড়ে ওঠে তাদের নতুন পিতামাতার কাছে।
বাংলাদেশের প্রতি অসম্ভব এক ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠে সেই শিশুরা।
সংগত কারণেই তাদের পরিচয় তখন গোপন রাখে এন.জি.ও গুলো। তবে তাদের পরিচয় তাদের নিজেদের অনেকের কাছেই উন্মোচিত ছিলো। দেশের প্রতি অবর্ণনীয় এক টান নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে বিদেশের বুকে।
একটা সময় আমি বাংলাদেশে কাজ করে এমন একটা বিদেশী এন.জি.ওর সাথে ভলান্টিয়ার হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলাম। বিভিন্ন ইভেন্টে মাঠ পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায়, মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে আমাদের কাজ ছিলো।
আমাদের নরওয়ের একজন ডোনার ছিলেন বাংলাদেশী। তিনি একবার বাংলাদেশে আসেন। তাকে রিসিভ করা এবং প্রজেক্ট ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব পরে আমার টিমের উপর। আমরা চারজন ছিলাম টিমে। তার সাথে আমার এবং আমার টিমের খুব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তিনি যতদিন ছিলেন আমরা তার সাথে সাথে ছিলাম। দেশের প্রতি প্রচন্ড আবেগময় ভালোবাসার সাথে তার একটা অদ্ভুত অস্বস্তি আমরা লক্ষ্য করি। তার সাথে আমাদের সম্পর্ক এতোই বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, তিনি চলে যাওয়ার সময় আমাদের সাথে তার জীবনের কথা শেয়ার করেন।
আর অসম্ভব একটি দায়িত্ব দিয়ে যান।
তিনি একজন যুদ্ধশিশু। বড় হয়েছেন নরওয়েতে। জীবনে সফল হয়েছেন, এবং সফলতার বিরাট একটা অংশ নিয়মিতভাবে এত দূরে থেকেও দেশের সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বিভিন্নভাবে দান করে যাচ্ছেন।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একটা কমিউনিটির কথা শুনলাম তার কাছে, বাংলাদেশী যুদ্ধশিশুদের, যারা এখন বড় হয়ে গেছে। যারা তার মতোই সফল এবং তার মতোই নীরবে এবং আড়ালে থেকে দেশের উন্নতিতে বিভিন্নভাবে দান করে যাচ্ছেন। অদৃশ্য এক ভালোবাসায় তারা তাড়িত দেশের জন্য। তাদের বিদেশী বাবা-মা’রাও খুবই সহমর্মী এই বিষয়টা নিয়ে। দেশের বাইরে দেশের সন্তানদের এই ভালোবাসার কথা শুনে খুবই ভালো লাগলো।
উনি যাবার আগে আমাদের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তার মাকে খুঁজে বেরতে।
এটা একটা অসম্ভব কাজ ছিলো। কোন তথ্য ছিলো না। তাকে যখন তার বিদেশী পিতামাতার কাছে তুলে দেয়া হয়, কোন তথ্য দেয়া হয় নি তাদের, শুধু তার পরিচয় ছাড়া। ঠিকানাঃ বাংলাদেশ, আর কিছু না।
ঘটনা শেষ হতো এখানেই।
যদি না সেই ভদ্রলোক সেই এন.জি.ও কে পুরানো তথ্য প্রকাশের জন্য চাপাচাপি করা শুরু না করতেন।
তিনি তার বিদেশী বাবা-মা এর কাছ থেকে যতদূর সম্ভব তথ্য নিয়ে সেই এন.জি.ওতে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। তারা তথ্য ছাড়তে প্রস্তুত ছিলো না। এত বছর আগের তথ্য বের করা তাদের জন্যও কঠিন ছিলো। তবে অসম্ভব ছিলো না। তার চাপাচাপিতে তথ্য প্রকাশে বাধ্য হয়।
তিনি আমাদের জানিয়ে দেন, একটি নির্দিষ্ট জেলার একটি থানার কথা। এন.জি.ওর হিসাবটা এমন ছিলো, “এই থানা থেকে এতজন শিশুকে নেয়া হয়।”
কোন গ্রামের নাম আমরা পাইনি। নির্দিষ্ট কারো নাম তো নয়ই।
আমাদেরকে তিনি দায়িত্ব দিলেন তার মা কে খুঁজে বের করার চেষ্টা করার। খুঁজে পেলে তিনি আসবেন দেখা করতে। তার আজীবনের সাধ তার মায়ের সাথে দেখা করা।
কোন এক অদ্ভুত কারণে আমরা জীবন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। রিসার্চ টিমের অজুহাতে আমরা চলে গেলাম সেই জেলার সেই থানায়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়টা নিয়ে আমরা রিসার্চ করছি, এই মর্মে আমরা সাহায্য চেয়েছিলাম স্থানীয় প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত সংস্থাগুলোর কাছে। কেউই আমাদের ফিরিয়ে দেয়নি। সবাই সাধ্যমতো সাহায্য করে। গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়েছিলো আমাদের।
আমরা সেই থানা থেকে টোটাল আট জন বীরংগনার তথ্য সংগ্রহ করি। এদের মধ্যে তিনজন যুদ্ধের পরবর্তী দুবছরের মধ্যে বিদেশী এন.জি.ওর মাধ্যমে দেশ থেকে চলে যান। চারজন চলে যান চিরতরে এলাকা থেকে।
একজন আত্মহত্যা করেন। তার গ্রামে তার কবর এখনও আছে।
যে তিনজন বিদেশে আছেন আমরা তাদের ট্রেস করতে পারিনি। যে চারজন চলে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তিনজনকে আমরা ট্রেস করতে পারিনি। একজনকে আমরা ট্রেস করতে পেরেছিলাম। তিনি ঢাকায় স্থায়ী হয়েছিলেন।
আমরা তাকে খুঁজে খুঁজে ঢাকা আসি। আমরা তার সাথে দেখাও করি। তাকে আমরা পাই স্বামী-সন্তান-নাতি-নাতনী নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনে। তিনি তার অতীত ভুলে গিয়েছিলেন। তার এই নতুন জীবনে কোন হস্তক্ষেপ করার অধিকার এবং সাহস আমাদের ছিলো না।
আমরা তার সাথে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি কথাও বলিনি। রিসার্চের সাবজেক্ট পাল্টে আমরা ঢাকার ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাদের ভালবেসে হাসিমুখে আপ্যায়ন করেন। নাতি নাতনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আমাদের বিদায় দেন। বারবার আমরা পেছন ফিরে দেখছিলাম। তার হাসির সাথে নরওয়ে প্রবাসী সেই ভদ্রলোকের হাসির এক অদ্ভুত মিল ছিলো।
আমরা পুরো ঘটনা ফোনে নরওয়ের প্রবাসী ভদ্রলোককে জানাই।
আমরা তাকে বলি, আমাদের খুঁজে পাওয়া আটজনের তথ্যের কথা, ঢাকার ভদ্রমহিলার কথা, হাসির অদ্ভুত সেই মিলের কথা। সাথে এটাও বলি, এই শেষ বয়সে সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করা এই বৃদ্ধার সাজানো জীবন হঠাৎ করে তছনছ করে দেয়ার অধিকার আমাদের নেই। তার মনোজগতে এখন আগের বিষয় টেনে আনা উচিৎ হবে না। এ অধিকার হয়তো তার থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের নেই।
বুঝতে পারছিলাম কথার মাঝে, ফোনের ওপাশে কান্নার শব্দ হচ্ছে। শীঘ্রই বাংলাদেশে আসছেন, বলে ফোন তিনি রেখে দিলেন।
আমরা ভয়ে ছিলাম তিনি বাংলাদেশে এসে কি করেন।
তিনি বাংলাদেশে আসলেন। আমাদের জানালেন না।আমাদের খবর দিলেন দুই দিন পরে। এই দুই দিন তিনি কোথায় ছিলেন বা কি করেছেন, কোন খবর আমরা জানি না। আমরা তার সাথে দেখা করলাম। তাকে ক্লান্ত মনে হলো।
আমার ধারণা ছিলো তিনি সেই ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করেছেন।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।
তিনি সেই ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করেন নি।
তিনিই বললেন আমাদের সবকিছু।
এ দুদিন তিনি নিয়ম করে তার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার হলেও হতে পারে মা কে একনজর দেখার জন্য।
তার দেখা হয়েছে, আড়ালে, লুকিয়ে, দূর থেকে।
সামনে গিয়ে তিনি দাঁড়াননি।
ভদ্রমহিলা তাকে দেখেও না দেখার ভান করেছেন।
তার কাছে তিনি নিতান্তই একজন পথচারী।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক দেশে বেড়ে না উঠেও আমার মতোই বাংলাদেশী, হয়তো বা আমার চেয়েও বেশি।
বাংলাদশীদের মন বোঝা বড় কঠিন। আমরা বড় বেশি ইমোশনাল। দূর থেকে একনজর দেখতে অপেক্ষা করি।
অদ্ভুত এক আবদার করলেন তিনি।
আমাদেরকে বললেন তাকে সেই জেলার সেই থানায় নিয়ে যেতে, যেখান থেকে একদিন তাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিলো। সেই যে একজন বীরংগনা আত্মহত্যা করেছিলেন, তার গ্রামে, তার কবরের কাছে নিয়ে যেতে বললেন তাকে।
বুঝতে পারলাম, অনুভব করলাম,
তিনি জীবিত সেই ভদ্রমহিলাকে নয়,
মৃত নাম না জানা সেই বীরংগনাকেই মনে মনে মা হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
তার কবরের কাছে গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো তার সাথে দেখা করবেন, একই সাথে বিদায় নেবেন।
আমরা তাকে সেখানে নিয়ে গেলাম।
মৃদু বাতাস বইছে।
গ্রামের শান্ত পরিবেশ, পুকরের জলে বাতাসের শব্দ হচ্ছে।
বিকাল বেলা সেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা কবরের পাশে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।
তার মুখ পাথরের মতো শক্ত। তবে দু চোখ অন্য কথা বলছে।
মানুষ সমাপ্তি চায়। যাত্রার সমাপ্তি। খোঁজের সমাপ্তি।
এর জন্য মাঝে মাঝে আমাদের নিজের সত্য নিজেকে খুঁজে নিতে হয়।
নিজের সাথে সমঝোতা করতে হয়।
তবে তাতে কিছুই যায় আসে না।
যতক্ষন আমরা নিজেরা নিজেদের খুঁজে পাই,
ঠিকানায় কোন কিছু যায় আসে না।
(গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। এটি আমার জীবনের কাহিনী নয়। লেখার সুবিধার্থে এভাবে লেখা হয়েছে।)
Piash Mahboob Khan
Send private message to author



