ভারতবর্ষের নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন একজন বাঙালি দার্শনিক এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি ১৭৯২ সালে হুগলির রাধানগর গ্রামে বাবা রামকান্ত রায় এবং মা তারিণী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু পরে ধর্মীয় প্রথা এবং সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার সাধনই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র।

প্রথমে খুব অল্প বয়সে গ্রামের পাঠশালাতে ভর্তির মাধ্যমে রামমোহন রায়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে মাত্র দশ বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য তাঁকে পাঠানো হয় ভারতের পূর্বাঞ্চলের পাটনা শহরে। পাটনা সেসময় ছিলো ভারতে আরবী ও ফারসি ভাষা শিক্ষার পীঠস্থান। এখান থেকে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আরবি-ফারসি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি হিন্দুধর্মের ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভাষা শেখার জন্য গমন করেন বেনারসে। সেখান থেকে তিনি সংস্কৃত ভাষা খুব ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেন। এরপর তিনি মাত্র ২৪ বছর বয়সে ইংরেজি ভাষা শিখতেও শুরু করেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে খুবই সুদক্ষভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে পটু হয়ে ওঠেন।

রাজা রামমোহন রায়ের হিন্দুধর্ম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম প্রভৃতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। এসব ধর্ম সমূহের সত্য অনুধাবন করার জন্য তিনি এরপর এসব ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করা শুরু করেন। এর ফলে, একদিকে যেমন তিনি একেশ্বরবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, অন্যদিকে এটাও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ধর্ম যদি তার নিজস্ব গোঁড়ামিকে বর্জন করতে না পারে এবং কূপমণ্ডুক মানসিকতাকে অতিক্রম করে যদি বিশাল জগতের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নিতে না পারে, তাহলে ধর্ম ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ধর্ম সম্পর্কে তাঁর এ উপলব্ধি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেন। আর বিভিন্ন ভাষা তাঁর নখদর্পণে থাকার কারণে তিনি একাধিক ভাষায় বইগুলো প্রকাশ করেন। ১৮০৪ সালে একেশ্বরবাদ নিয়ে আরবি ও ফারসি ভাষায় রামমোহন রায়ের প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় তুহফাত-উল-মুয়াহহিদিন নামে। ফারসি ভাষায় লেখা এই বইয়ের মুখবন্ধ আরবিতে লেখা ছিলো।

রামমোহন রায় গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। তিনি “ব্রাহ্মনিকাল ম্যাগাজিন” নামে তাঁর প্রথম দ্বিভাষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৮২১ সালে। পত্রিকার বাংলা নাম ছিল “ব্রাহ্মণ সেবধি: ব্রাহ্মণ ও মিশনারি সংবাদ”। দ্বিভাষিক এই পত্রিকার মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ব্রাহ্মনিকাল ম্যাগাজিনে তিনি লিখেছিলেন: ‘বাঙ্গালা দেশে যেখানে ইংরেজের সম্পূর্ণ অধিকার ও ইংরেজের নামে লোকে ভীত হয়, তথায় এরূপ দুর্বল ও দীন ও ভয়ার্ত প্রজার উপর ও তাহাদের ধর্মের উপর দৌরাত্ম্য করাটা, কী ধর্মত, কী লোকত প্রশংসনীয় হয় না।”

এছাড়া রামমোহন রায় “সংবাদ কৌমুদী” নামেও একটি পত্রিকা বের করেন। এটি ছিল বাঙালি সম্পাদিত ও বাঙালি পরিচালিত প্রথম সংবাদপত্র। এর আগে “বেঙ্গল গেজেট” নামে একটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। সংবাদ কৌমুদী প্রকাশিত হয়েছিল দশ বছর। এর এক বছর পর তিনি ফারসি ভাষায়ও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল “মিরাত-উল-আকবর”।

যুক্তিবাদী এই সমাজ সংস্কারক তাঁর প্রকাশিত পত্রিকাগুলিতে অকাট্য যুক্তি দিয়ে তৎকালীন সমাজের নানা কুসংস্কার খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন। তাই বলা বাহুল্য যে, ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য প্রথম যে কণ্ঠস্বর, সেটি ছিল রাজা রামমোহন রায়ের।

এরপর ১৮১৫ সালে রামমোহন রায় কলকাতায় একরকম পাকাপাকিভাবেই চলে আসেন এবং এরপর থেকেই শুরু হয় সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। ধর্মকে সংস্কার করতে তিনি লড়াই করেছেন আজীবন। এক্ষেত্রে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহচর্য লাভ করেন। তাঁর সহযোগিতায় রামমোহন রায় ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসমাজ, যা এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন এবং বাংলার পুনর্জাগরণের পথ-প্রদর্শক হিসাবে কাজ করেছিল।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে বাঙালির জাতীয় জীবনে যে অন্ধকার নেমে এসেছিল, তার ফলে নানাধরনের কুসংস্কার যেমন সতীদাহ, মানত করা সন্তান গঙ্গাসাগরে বিসর্জন দেওয়া, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতির মতো অস্পৃশ্যতা বাঙালির জীবনকে পরতে পরতে আবৃত করে ফেলেছিল। রামমোহন উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর পক্ষে সবগুলো একসঙ্গে পরিবর্তন করা দুঃসাধ্য। তবে তিনি চেষ্টা করেছিলেন একটি একটি করে সবগুলো কুসংস্কার পরিবর্তন করার।

ভারতে সমাজ সংস্কারের জন্য সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে । তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রথা অনুযায়ী হিন্দু বিধবাদের স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মেরে ফেলার বিধান ছিল। এই প্রথা দূর করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন রামমোহন রায়। এটি ছিল তাঁর সবচেয়ে মহত্তম অবদান গুলোর মধ্যে একটি।

‘রাজা’ উপাধি নিয়ে এরপর ১৮৩০ সালে রামমোহন রায় তৎকালীন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের দূত হিসাবে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে সেসময়কার ভারতের সামাজিক উন্নয়নের জন্য তিনি একটি জোরালো বক্তব্য রাখেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে পেশ করা তাঁর বক্তব্যে তিনি এই আবেদনটি করেছিলেন যাতে ভারতে একটা সুশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং যথার্থ শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে হয়। ভারতবর্ষে শিক্ষার্থীরা যাতে বিজ্ঞানের আলো পায়।

উনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন যে মুক্ত চিন্তাচেতনার আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আলোতেই ভারতে নব-জাগরণের পথটি ত্বরান্বিত হয়েছিল।

এর মাত্র ৩ বছর পর অর্থাৎ ১৮৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনের মাটিতেই ব্রিস্টলে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়।

Written by Shibli Sayeek (শিবলী সাইক)

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
1
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!