আটপৌরে ভালবাসা

দরজার বাইরে থেকেই আসিফ মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে , সে জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগল, কিছুক্ষণ পর রুনু এসে দরজা খুলে দিল । আসিফ জিজ্ঞেস করল, মিষ্টি কাঁদছে কেন রেণু ?

রেনু বলল, কি জানি ঘুমিয়েছিল হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার শুরু করলো। আসিফ ঘরে ঢুকেই মেয়ের মাথার কাছে বসলো, এখন কি সুন্দর হাত পা নেড়ে খেলছে, কিন্তু কিছু সময় আগেই তার কান্নার আওয়াজে সারা বাড়ি ভেঙে পরছিল। এখন কি রকম ভাবলেশহীন ভাবে নিজের মনে খেলছে ।
রেণু গামছা নিয়ে স্বামীর হাতে দিল ,আসিফ গামছা নিয়ে কলপাড়ে চলে গেল। তাদের এই বাড়িটা শহর থেকে একটু দূরে টিনশেডের একতলা বাড়ি । বাড়িওয়ালা শহরে থাকে । দুজন মাত্র ভাড়াটিয়া। উত্তর দিকে থাকে রেনুরা আর ওই দক্ষিণ পাশে রহমান সাহেব ,তার স্ত্রী আর দশ বছর বয়সী দুটো জমজ মেয়ে নিয়ে থাকেন। রহমান সাহেবের স্ত্রী চিররুগ্না। কোন সময়ই তাকে খুব একটা ঘরের বাইরে দেখা যায় না ,তবে তার মেয়ে দুটির হুটোপুটির আওয়াজ সারাদিনই পাওয়া যায়। এখন রাত বলে সব নিশ্চুপ।

আসিফ অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। সেলসম্যানের চাকরি করে সে। দোকান বন্ধ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায় প্রতিদিনই ।

কলপাড়ে গিয়ে শার্টের হাতা গুটাতে লাগল আসিফ। রেনু পিছন পিছন আসলো স্বামীকে কল চেপে দেওয়ার জন্য। রেনু কল চাপছে ,আসিফ চোখে মুখে পানি ছিটালো। চাপ কলের পানি বরফ শীতল হয়ে আছে এই রাতে। হঠাৎ আসিফ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল গোসলই করে ফেলি । রেনু বললো, এখানে করবে ; না কি বাথরুমে যাবে? আসিফ বললো ,এখানেই করে ফেলি , সবাই ঘুমিয়ে গেছে, কেউ দেখবে না। আসিফ শীতল পানি ঢালছে শরীরে, মাথার উপর বড় একটা চাঁদ, বেশ লাগছে তার।
-এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে রেনু?
একদম উঠতে ইচ্ছে করছিল না রেনুর। স্বামীর গোসল দেখতে ইচ্ছে করছিলো। মন ভালো থাকলে আসিফ অনেক কথা বলে এই সময়ে। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে উঠে গেল চা আনতে।

চুলায় চা বসিয়ে রেনু গালে হাত দিয়ে ভাবছে আগামীকাল ঘরের বাজার আর মিষ্টির দুধের কথা আসিফ কে বলতে হবে। কে জানে মানুষটার কাছে টাকা আছে কিনা, মাসের শেষ এখন। তার বিয়ে হয়েছে দুবছর। দুবছর ধরেই সংসারের অবস্থা খুব করুনই দেখে আসছে রেনু। তার উপর এবছর মিষ্টি হবার সময় বেশ ভাল টাকা খরচ হয়েছিল। গ্রামের কিছু ধানী জমি বিক্রি করে টাকার জোগাড় করতে হয়েছিল।

অথচ বিয়ের আগে কলেজে পড়ার সময় সে ভাবত, খুব টাকা ওয়ালা কারো সাথে তার বিয়ে হবে, স্বামীর সাথে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। বাবা মা ছিল না তার, মামার সংসারে মানুষ। মামাই বিয়েটা দিয়ে দেন।

কই রেনু হল, আসিফের গলা কানে এসে লাগল। ভাবনায় বাধাঁ পরলো রেনুর।

চা নিয়ে এসে রেনু দেখল আসিফ গুনগুন করে একটা গান গাইছে আর সারা শরীরে সাবানের ফেনায় ভরিয়ে ফেলেছে । আসিফের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল রেনু । ফেনা ভর্তি হাতেই চা নিয়ে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল আসিফ। তারপর ফুর্তির ভঙ্গি করে বললো , এই মুহূর্তে আমার থেকে সুখী মানুষ বাংলাদেশে আর একটিও নেই । অবাক হয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে আছে রেনু। কি বলে লোকটা, তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে আছে, ঘরে বাজার নেই, আর সে বলছে কিনা তার মতো সুখী মানুষ নাকি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আর একটিও নেই । উঠে চলে যাচ্ছিল রেনু

-আরেকোথায় যাচ্ছো?
-রেনু বললো, তোমার জন্য ভাত বাড়তে যাচ্ছি ।
-এত বেশি খিদে লাগে নি , ভাত একটু দেরি করে খেলেও কিছু হবে না। রেনুর শোন,আমাদের দোকানে বিক্রি অনেক ভালো হচ্ছে, মালিক বলেছে সব কর্মচারীদের বেতনের সাথে এবার লাভের একটা অংশ যাবে ।
-রেনু উৎসুক গলায় বললো,কত টাকা পাওয়া যাবে ?
-পাওয়া যাবে বেশ ভালই, আসিফ একটু হেসে জবাব দিল।

হঠাৎ আসিফ পেছনে দড়িতে টানানো খুলে রাখা শার্ট টা দেখিয়ে রেনুকে বললো ,শার্টের পকেটটা দেখতো। শার্টের পকেটে হাত দিয়ে রেনু দুটো ৫০০ টাকার নোট বের করে আনল। অবাক হয়ে বললো, এতো টাকা; আরিফ রহস্যময় ভঙ্গি করে বলল ,আছে একটা ব্যাপার ।
-কোথায় পেলে এত টাকা?

-আরে দু মাস আগে নজরুলকে ধার দিয়েছিলাম, আজ দোকানে এসে ফেরত দিয়ে গেছে।
রেনুর হাতের মুঠোয় নিয়ে টাকাটা দেখছে। ব্যাপারটা খেয়াল করলো আসিফ। কি জানি কি মনে করে হঠাৎ বলে বসলো, রেনু টাকাটা তুমি রেখে দাও।
-রেখে দেব ?
-তোমার কত খরচ থাকে না অনেক সময় , তোমার হাতে তো তেমন কোন টাকা দেওয়া হয় না কখনো, এটা রাখো তুমি।
-কি বলছো তুমি ,তাই বলে এতগুলো টাকা আমি নিয়ে নেবো? কালকের বাজার ,মিষ্টি দুধ অনেক কিছু কিনতে হবে তোমাকে।

আরে সব হয়ে যাবে , হঠাৎ করে খুব চঞ্চল হয়ে গেলো আসিফ।
রেনু মনে মনে ঠিক করে ফেললো, টাকাগুলো দিয়ে কি করবে সে। মিষ্টি কে রহমান সাহেবের বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য রেখে, আগামীকাল সামনের বাড়ির ভাবীর সাথে মার্কেটে গিয়ে আসিফের জন্য দুটো শার্ট কিনবে। প্রতিদিন আসিফ একই শার্ট পরে দোকানে যায় , আর হাতার কাছের ছিদ্র টা খুব কায়দা করে গুটিয়ে লুকিয়ে রাখে। মনে মনে ভাবল আসিফ কাল কাজে যাওয়ার পর পরই সে ভাবির সাথে বের হবে ।

আসিফ গোসল শেষে খেতে বসলো। সে গোগ্রাসে গিলছে। রেনু বললো, ওমা আস্তে খাও। গলায় আটকাবে। আসিফ বললো, এতক্ষণ টের পাইনি, আসলে অনেক খিদে লেগেছে ।

খাওয়া শেষ করে রেনু যখন রুমে এসে ঢুকলো, তখন নিজের মনেই খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে গেছে মিষ্টি।আসিফ পেছনের বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে ।ক্লান্ত হাতে স্বামীর ঘাড়ে হাত রাখলো রেনু।

  • -শুতে এসো।
    -মিষ্টি ঘুমিয়েছে?
  • -অনেক আগেই।
    তারপর দুজনে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আজ মশারিটা না টানালেও চলবে। মশা নেই। বাইরে থেকে বেশ ভালো ঠান্ডা হাওয়া আসছে। জানালাটা খোলা, ওপাশ থেকে চাঁদের এক টুকরা আলো ঘরে এসে সব আলো করে রেখেছে।

রেনু মিষ্টি আর স্বামীর মাঝে শোয় সব সময়ই। আসিফ একটা হাত রেনুর শরীরে রাখতে রাখতে বললো , টেবিলের উপর প্যাকেট টাতে দুমুঠো কাচের চুড়ি একটা টিপের পাতা আছে তোমার জন্য। আমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার।

  • রেনু অবাক গলায় বললো, তোমার মনে ছিল?
  • বারে কেন মনে থাকবে না আমাদের বিয়ের দিন টা। সকালে তুমিও তো আমার পছন্দের পায়েস রান্না করে দিয়েছিলে,কাজে বের হবার আগে। তখন কিছু বলিনি,ভেবেছিলাম আজ একটু আগে বাড়ি ফিরবো, কিন্তু কাজের চাপে আর পারলাম না।

একটু থেমে আসিফ বললো, আমাদের জীবনটা একটু কষ্ট দিয়ে শুরু হলেও, তুমি দেখো রেনু এই কষ্ট আর থাকবে না। বলতে বলতে আসিফের গলা ধরে এলো।
রেনু কিছু না বলে উঠে বাতি জ্বালালো। তারপর প্যাকেট খুলে চুড়ি আর টিপের পাতা বের করলো।
আসিফ ততক্ষনে উঠে বসেছে। রেনু গাঢ় স্বরে বললো , ভীষণ সুন্দর।

রেনু ট্রাংক খুলে নীল রঙের জরীর পাড়ের শাড়িটা বের করলো। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল, তাও জোছনার আলোয় সব স্পষ্ট। আসিফ তাকিয়ে আছে রেনুর দিকে।

রেনু বললো, এই শাড়ি টা পড়ে আমি এখন সাজবো।
আসিফ বললো , সাজো তুমি ।
-তুমি মুখ ওদিকে ঘোরাও , শাড়ি পাল্টাবো তো;

  • কি হয় দেখলে;
    রেনু অন্য দিকে ফিরে লাজুক গলায় বললো, জানি না কি হয়।
    একটু আগেই আসিফ নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলছিল, আর এখন রেনুরো ঠিক আসিফের মত নিজেকে অসম্ভব সুখী মনে হচ্ছে।

রেনু যখন পুরনো শাড়ি টা খুলে নীল শাড়িটার দিকে হাত বাড়ালো, তখন আসিফ উঠে গিয়ে রেনু কে জড়িয়ে ধরলো। আর ঠিক ঔ মুহূর্তে চাঁদটা মেঘে ঢেকে চারদিক অন্ধকার করে দিল। চাঁদও যেন আসিফ রেনুর অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে।

সঞ্চিতা শারমিন ( Shancheta Sharmeen)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
2
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shibli Sayeek
Member
4 years ago

বিয়ের আগে সব মেয়েরই ইচ্ছে থাকে, অনেক বড়লোক কারো সাথে বিয়ে হবে। কিন্তু, সেই শখ যদি পূরণ না হয়, তাহলে একটু হতাশা তৈরি হয় বৈকি। কিন্তু, এই গল্পের রেনুর মতো মেয়েরাই শুধুমাত্র পারে হতাশাকে ভালোবাসায় পরিণত করতে।

গল্পের ending টা খুব সুন্দর ছিলো।

1

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!