ঈদ উল ফিতরের আর খুব বেশি দেরী নেই। ভাবলাম আমাদের সময়কার গ্রামের ঈদ নিয়ে না হয় খানিকটা আলোচনা করা যাক এ সুবাদে। ঈদ সব সময়েই আনন্দের ছিল। একালে কিংবা সেকালে। কিন্তু পক্ষপাত নয়। আমার মনে হয় আমাদের ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দটা ছিল এখনকার চাইতে অনেক গুণ বেশি। বর্তমানে ঈদের আনন্দে কেন জানি মনে হয় বাহ্যিক রূপটাই বেশি প্রাধান্য পায়। আর আমাদের ছোটবেলার ঈদের আনন্দটা মূলত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। রোজার আগ থেকেই আমরা দিন গুনতাম কখন রোজা শেষে ঈদের দিনটা আসবে। নানান রকম পরিকল্পনা আর চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে যেত সেই রোজার শুরু থেকেই।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো ছোটকালে আমরা ঈদে এতো জামা-কাপড়, জুতা, সেন্ডেল বা অন্যান্য নতুন সামগ্রী পেতাম না। পরিবারের সবাই এক ঈদে নতুন জামাকাপড় পেতো না। নতুন জামাকাপড় সাধারণত দুই ঈদে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে নিতে হতো। তখনকার সময়ে গ্রামের বয়স্ক মহিলাদের বাজারে গিয়ে ঈদের জন্য কোন কিছু কেনাকাটার প্রচলন ছিল না। তবে মাঝে মাঝে মহিলাদের ব্যবহার্য সামগ্রী নিয়ে ফেরিওয়ালারা আসতো গ্রামে গ্রামে। আর সুরে সুরে লম্বা লম্বা হাঁক দিত “এই লেইস, ফিতা, চুড়ি” বলে। আরো বলতো “লাগবে লেইস, ফিতা, চুড়ি”। তখন বাড়ির মহিলারা ছোট ছোট দল বেঁধে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নেইল পলিশ, আলতা, পাউডার, চুড়ি, ফিতা, কানের দুল জাতীয় সামগ্রী কিনে নিতেন। তখনকার সময়ে কোন বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে মহিলারা চোখে কাজল লাগাতেন। এখনকার মতো আধুনিক কাজল তখন গ্রামে ততটা প্রচলিত ছিল না। তখন গ্রামের মহিলারা স্থানীয় পদ্ধতিতে কাজল তৈরি করতেন। কলা গাছের পাতা চেটে ওখান থেকে এক হাত পরিমাণ একটি কান্ড নিয়ে তার উপর কিছুটা সরিষার তেল লাগাতেন। তারপর তেল মাখানো কান্ডটি একটি কেরোসিনের কুপির কাছে ধরে রাখতেন ২/৩ মিনিট। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের হালকা তাপে কান্ডের গায়ে একটি কালো গাঢ় প্রলেপ পরে যেত। এটাই মহিলারা পরে চোখে ব্যবহার করতেন কাজল হিসেবে। এখনকার মতো তখন ঈদে বোনাসের প্রচলন ছিল না। ঈদের প্রাক্কালে সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীরা মাসিক বেতনের অর্ধেক অগ্রিম হিসেবে পেতেন যা পরে বেতন থেকে পর্যায়ক্রমে কেটে নেয়া হতো। বাস্তব অর্থে ঈদের খরচের তুলনায় এই অর্থ ছিল একেবারেই অপ্রতুল। এ টানা পোড়নের মধ্যে ও সত্যিকার অর্থে অতি অল্পতেই আমরা অনেক বেশি তুষ্ট ছিলাম আর এ অল্প প্রাপ্তিতেই আমাদের আনন্দের কোন সীমা পরিসীমা থাকতো না।
আজকালকার মত তখন ঈদের চাঁদ দেখার কোনো আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না। আমরা সন্ধ্যার খানিকক্ষণ আগেই দল বেঁধে ঈদের চাঁদ দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ঈদের চাঁদ দেখার মুহূর্তটা ছিল অত্যন্ত আনন্দের। অনেককেই দেখতাম ঈদের চাঁদ দেখে চাঁদকে সালাম করতে। কোথাও কোথাও আবার ঈদের চাঁদ দেখার পর গুলি ফুটিয়ে জানান দেয়া হতো চাঁদ ওঠার আনন্দ সংবাদ। চাঁদ উঠার পর পর বাড়িতে বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে বলে উঠতো “চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে”।
আজকালকার মত তখন ঈদে বাড়িতে বাড়িতে এত রকম বাহারী খাবার দাবার তৈরি হতো না। তবে প্রায় প্রতি বাড়ীতেই সেমাই রান্না হতো। সাথে আরো থাকতো পিঠা পুলি আর চাউলের গুড়ির রুটি। গ্রামের অনেক পরিবারই এ সমস্ত সেমাই স্থানীয় পদ্ধতিতে বাড়িতেই তৈরি করতেন। চাউলের গুড়ি দিয়ে তৈরি হতো সাদা রংয়ের এ সেমাই।
এখনকার মত তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে কাপড় ইস্ত্রি করার পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা ছিল না। গরম কাঠ কয়লা একটি লোহার ত্রিভুজ আকৃতির পাত্রে ঢুকিয়ে তা কাপড়ের উপর ঘষে ঘষে কাপড় ইস্ত্রি করা হতো। ইস্ত্রি কাপড়ের মূল আকর্ষণ ছিল কার কাপড়ের ভাঁজটা কত বেশি তীক্ষ্ণ। ভাঁজের তীক্ষ্ণতা বাড়ানোর জন্য অনেকেই কাপড়ের মধ্যে বেশি করে ভাতের মাড় লাগাতেন। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এ ইস্ত্রি কাপড় পরার সুযোগ পেত না। কিন্তু এ বিষয়ে ওদের ও একটি নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। আমরা তখন কাপড় সুন্দর করে ভাঁজ করে ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই বালিশের নিচে রেখে দিতাম। বালিশের নিচে মাথার চাপ খেয়ে কাপড় গুলো কিছুটা মসৃণ হতো আর কাপড়ের জায়গায় জায়গায় ভাঁজ পড়ে যেতো। এটাই ছিল ঈদের দিনে আমাদের ইস্ত্রি করা কাপড়। কেউ কেউ আবার নতুন কাপড় বা সেন্ডেল গোপন কোন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখতো যাতে করে ঈদের আগ পর্যন্ত কেউ যেন তা দেখতে না পায়। কাউকে কাউকে দেখতাম নতুন সেন্ডেল পরে বিছানার উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তা পরীক্ষা করতে স্যান্ডেলটা কেমন হয়েছে। পুরান হয়ে যাবার ভয়ে ওই স্যান্ডেল দিয়ে ওরা মাটিতে হাঁটতোনা।
সারা রাত আমরা শুধু ঘুমিয়ে এপাশ ওপাশ করতাম। ঘুম আসতো না কিছুতেই। অপেক্ষায় থাকতাম কখন সকাল হবে। খুব ভোরে মোরগের ডাক শুনে আমরা খুব খুশি হতাম। কারন বুঝতাম সকাল হতে আর খুব বেশি বাকী নেই। সকাল হলেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল গোসল করতে যাওয়া। প্রায় সকলেই অন্তত ঈদের দিন গোসলের সময় সুগন্ধি সাবান ব্যবহার করতেন। যতটুকু মনে পরে সে সময় ৪/৫ টি গায়ে মাখা সাবান পাওয়া যেত। মনে পরে লাক্স, তিব্বত, লাইফবয়, পামরোজ আর কসকো সাবানের কথা। বিভিন্ন সাবানের বিভিন্ন রকম ফ্লেভার ছিল। আমরা গোসলের পর একজন আরেকজনের হাতে নাক দিয়ে শুঁকে দেখতাম কার সাবানের গন্ধটা কত বেশি মিষ্টি। গোসলের পর আমাদের কাজ ছিল বাড়িতে এসে ঈদের জামা কাপড় পরা। সাধারণত মা ও বড় বোনেরা কাপড় পরতে আমাদের সাহায্য করতেন। মাঝে মাঝে এমন হতো যে আনন্দের উত্তেজনায় আমাদের কারো কারো পায়জামার ফিতায় গিট লেগে যেতো। কাপড় পরার পর আমরা প্রায় সময় হাতে আতর লাগাতাম। মুরুব্বিদের অনেককে দেখতাম চোখে সুরমা লাগাতে। জামা কাপড় পড়ার পর আমরা মাথায় টুপি পড়তাম। বড়দের অনেককে দেখতাম ঈদের দিন জিন্নাহ টুপি পড়ে নামাজ পড়তে যেতেন।
এরপর সেমাই বা অন্যান্য খাবার খেয়ে দল বেঁধে আমরা ঈদের নামাজ পড়তে চলে যেতাম। ঈদগা মাঠে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় ছোট ছোট বাচ্চাদের অনেককেই দেখতাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে। কারণ নতুন জুতা বা স্যান্ডেলের ঘর্ষণে পায়ের কোন কোন জায়গায় তাদের ক্ষত হয়ে যেত।
বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ঈদের জামাতে অংশগ্রহণের জন্য চলে যাবার পর বাড়ির মহিলারা বের হতেন গোসল করতে। তখনকার সময় গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ লোকজনই পুকুরে গোসল করতেন। পুকুরের কোনায় কোনায় মহিলাদের গোসল করার জন্য জন্য বাঁশের বেড়া দিয়ে একটি অংশ ঘেড়া দেয়া থাকতো। পুরুষ সদস্যরা নামাজ থেকে ফিরে আসার আগেই বাড়ির মহিলা সদস্যরা গোসল সেরে সাধ্যমত নতুন জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে থাকতেন নামাজ পরে ফেরত আসা সদস্যদের আগমনের অপেক্ষায়।
তখনকার দিনে বেশিরভাগ ঈদের নামাজই হতো খোলা মাঠে । সে এক অনিন্দ্য সুন্দর ছবি। দেখা যেতো নানান ধরনের রং বেরংগের পোশাক পরে ঈদগাহের চারিদিক থেকে জমির আল ধরে ধরে মানুষ ঈদগা মাঠের দিকে ছুটে আসছে। এক আনন্দ মূখর আর উৎসব উৎসব পরিবেশ চারিদিকে। কিছুটা দূর-দূরান্ত থেকে কেউ কেউ আবার দল বেঁধে ঈদগা মাঠে আসতেন। মাঝে মাঝে এ সমস্ত দলের সাথে একটি টিনের চোঙ্গা সদৃশ জিনিস থাকতো। পুরো রাস্তা জুড়ে তারা এই টিনের চোঙ্গা দিয়ে “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিতে দিতে ঈদগাহের দিকে এগিয়ে আসতেন। এ এক অভিনব দৃশ্য। সে দৃশ্য আজো আমাদের স্মৃতিপটে উজ্জ্বল।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয়। বড়দের সাথে বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ও ঈদগা মাঠে যেত। কেউ কেউ আবার বেশ ছোট বাচ্চাদের কোলে করে নিয়ে আসতেন ঈদগাহ মাঠে। সাধারণত এই সমস্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নামাজে অংশগ্রহণ করতো না। তারা ঈদগা মাঠের দেয়াল ঘেঁষে বা মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে দল বেঁধে অপেক্ষা করতো নামাজ শেষ হবার জন্যে। এক্ষেত্রে প্রায় সময় যে জিনিসটি ঘটতো তা হলো নামাজ শুরু হওয়ার পরপরই এ সমস্ত ছোট ছোট বাচ্চারা চিৎকার-চেঁচামেচি আর শোরগোল শুরু করে দিত। মাঝে মাঝে এদের মধ্যে মৃদু তর্কাতর্কি ও হতো এবং সময় সময়ে তা ছোটখাটো ঝগড়া ঝাটিতে ও রুপ নিতো।
আরো একটি মজার ঘটনা ও ঘটতো এসময়। নামাজ শুরু হবার পর একাকী বা কারো জিম্মায় থাকা ছোট ছোট বাচ্চারা তখন উচ্চস্বরে কান্না জুড়ে দিত। মনে হতো ছোট বাচ্চারা যেন সারা মাঠ জুড়ে কান্নার এক চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। ছোটদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর শিশুদের কান্নায় বড়দের নামাজের মনোযোগ নষ্ট হলে ও বড়রা এর জন্য বিরক্তি ভাব প্রকাশ করতেন না বা তাঁদের আচরণে কখনো কোনো প্রকার রুঢ়তা দেখা যেত না।
নামাজ শেষে পরস্পর পরস্পরের সাথে কোলাকুলি করে আমরা ঘরে ফিরে আসতাম। ভাগ্য ভালো থাকলে বখশিশ হিসাবে আমরা এক আনা বা দুই আনা পেতাম। আর এ বকশিস দিয়ে আমরা মুলত আইসক্রিম, লাঠি-লজেন্স, বুট, বাদাম, কটকটি, বাঁশি আর বেলুন কিনতাম। বড়দের অনেকেই তখন সরাসরি বাড়িতে না এসে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে চলে যেতেন বয়স্ক মুরুব্বী, অসুস্থ সদস্য বা বাড়িতে অবস্থানরত বয়স্ক মহিলাদের সালাম করতে।
আমরা ফিরে আসতাম বাড়িতে। বাড়িতে এসেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল মুরুব্বী শ্রেণীর প্রত্যেককেই পায়ে ধরে সালাম করা আর দোয়া চাওয়া। এখনকার মতো সালামের বিনিময়ে সেলামি দেয়ার রেওয়াজ তখন গ্রামাঞ্চলে খুব বেশি প্রচলন ছিলনা। তবে মাঝে মাঝে আমরা বয়স্ক মহিলা বিশেষ করে দাদি-নানিদের কাছ থেকে কিছু সেলামী পেতাম। এ সমস্ত বয়স্ক মহিলারা শাড়ির আঁচলের এক কোণে একগোছা চাবি আর আরেক কোনে কিছু খুচরা পয়সা বেঁধে রাখতেন। আমরা সালাম দেয়ার পর তাঁরা আঁচল খুলে ওখান থেকে দুপয়সা বা এক আনা আমাদেরকে দিতেন মাঝে মাঝে। তবে এক্ষেত্রে নানি দাদি দের অতি আদরের নাতিরাই প্রাধান্য পেত বেশি। জানিনা এটাকে আপনার পক্ষপাত বলবেন কিনা? এরপর আমাদের কাজ ছিল দল বেঁধে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ফিরে খাওয়া দাওয়া করা আর সবাইকে সালাম করা। এভাবেই আমাদের সারাটা দিন আনন্দে কেটে যেত। সন্ধ্যা নাগাদ মন খারাপ করে আমরা বাড়িতে ফিরে আসতাম। খুবই কষ্ট লাগতো এই ভেবে যে দিনটা কেমন করে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আবার আমাদের সময় গণনা শুরু হতো আগামী রোজার আর আগামী ঈদের। আবার শুরু হতো আমাদের নতুন প্রতীক্ষার প্রহর।
মোঃ আওরঙ্গজেব চৌধুরী
Md. Aowrangazeb Chowdhury
06 May 2020
Send private message to author




আমাদের সময়কার ঈদ ঈদই ছিলো
ছোটবেলায় ঈদের আনন্দ ছিলো অন্যরকম। সেই আনন্দ এখন আর পাই না। এখন আমার কাছে ঈদের দিনটা অন্য দিনের মতোই মনে হয়।
এই স্মৃতিকথাটির সাথে আমার শৈশবের অধিকাংশটাই মিলে গেলো। তবে, আমি শৈশবে ঈদের অনেক টাকা সালামি পেতাম। মেরেকেটে ১০০ টাকা তো হবেই। শৈশবের সেই ১০০ টাকার আনন্দ, এখন লক্ষ টাকাতেও পাই না।