সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভাধর একজন মানুষ। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রম্যরচয়িতা, ভ্রমণপিপাসু এবং জীবনবোধের নানামুখী অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ তাঁর জীবন। জীবদ্দশায় তিনি দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে ভ্রমণ করেছেন। সেই সাথে অর্জন করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রচনা করেছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম।
তিনি ১৯০৪ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সিলেটের করিমগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ সিকন্দর আলী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে সাব-রেজিস্ট্রার হওয়ার সুবাদে গুণী সাহিত্যিক শৈশবে দেশের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ লাভ করেন। পিতার চাকরিতে বছর বছর বদলি হওয়ার কারণে নতুন এলাকায় স্থানান্তরিত হতে হত। ফলে, তাঁকে পুরাতন স্কুল তথা বন্ধু-বান্ধবদের ছেড়ে এসে ভর্তি হতে হত নতুন এক স্কুলে। এভাবে প্রত্যেক বছর নতুন নতুন স্থান দর্শনের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে তাঁর শৈশবকাল।
শৈশবে তিনি তুখোড় মেধাবী ছাত্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত এসব স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতি তাঁর ভালো লাগেনি। শৈশব-কৈশোর পার হয়ে তিনি যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন তিনি ১৯২১ সালে ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে। এখানে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে শিক্ষা লাভ করে স্বর্গীয় পরিতৃপ্তি লাভ করেন। আশ্চর্য হলেও সত্য, এখানে থেকেই তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ পনেরোটি ভাষাশিক্ষা লাভ করেন।
শৈশবে পড়াশোনার জন্য তিনি নিজের দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করেছিলেন। যৌবনে শান্তিনিকেতন থেকে শিক্ষালাভ করে উচ্চশিক্ষার জন্য শুরু করেন দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো। তিনি বিশ্বভারতী থেকে ১৯২৬ সালে স্নাতক পাস করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান সুদূর ভারতের আলীগড়ে। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টেকেনি। এরপর ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশোনার জন্য তিনি চলে যান আফগানিস্তানের কাবুলে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে শুরু হয় অভ্যুত্থান। কিন্তু তিনি তাঁর পড়াশোনার অপ্রতিরোধ্য গতি থামাননি। তিনি হুম্বোল্ট বৃত্তি নিয়ে চলে যান জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে। তারপর সেখান থেকে মিসরের কায়রোতে আল আজহার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি শিক্ষালাভ করেন।
এখান থেকেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে পরবর্তীকালে কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনেও তিনি এক জায়গায় বেশিদিন থিতু হননি। কর্মের তাগিদে ছুটেছেন দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে, বিভিন্ন সময় বদলেছেন পেশা। দেশভাগের পর বাংলাদেশের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজেও কিছুদিন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ১৯৩৫ সালে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হন। এর মধ্যে তিনি ভারতীয় বেতারমাধ্যম আকাশবাণীতে কাজ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা সহ বিভিন্ন নামকরা পত্রিকায় কলামও লিখেছেন। কলাম লেখার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর আসল নামের পরিবর্তে সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনামে ব্যবহার করতেন। এতবেশি ছদ্মনাম হয়ত আর কোনো সাহিত্যিক ব্যবহার করেননি। সব শেষে তিনি বিশ্বভারতীর ইসলামের ইতিহাস বিভাগে রিডার (১৯৬১) হিসেবে যোগদান করে সেখান থেকেই ১৯৬৫ সালে অবসরগ্রহণ করেন।
তার শিক্ষাজীবন ও শিক্ষক জীবন বিচার করলে দেখা যায়, তিনি কখনই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। স্কুল জীবনেই তিনি স্বাধিকার চেতনা থেকে সরকারি স্কুল বর্জন করেছিলেন। বিপদে ফেলেছিলেন তার সরকারি চাকরিজীবী বাবাকে। আর সে কারণের কোথাও থিতু হননি বেশি দিন।
ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে তিনি বিচরণ করেছেন দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে। তবুও তিনি বলতেন, ভ্রমণে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাঁর এ উক্তি ছিল নিতান্তই তাঁর বিনয়। ভ্রমণ বিমুখতার জন্য তিনি তাঁর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিলেও বাস্তবে রবীন্দ্রনাথ এবং শিষ্য মুজতবা আলী – দুজনেই ভ্রমণকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন।
তাঁর লেখক জীবনে এবং রচনাশৈলীতেও পড়েছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ভ্রমণ তাঁর শুধু কায়িক ছিল না, মানস ভ্রমণেও মুজতবার তুলনা ভার। তিনি দেশের কোনো কিছুর বর্ণনা দিতে গেলেই সেখানে অবলীলায় বিদেশী প্রসঙ্গ টেনে আনেন। আবার কায়রোয় বসে তার প্রাণ কাঁদে চারটে আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনা মুগের ডাল, পটোল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য।
মুজতবা আলীর লেখা প্রথম বইটিই ছিল ‘দেশে-বিদেশে’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায়। সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তার সম্পাদকের বৈঠকে গ্রন্থে ‘দেশে-বিদেশে’র বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি একে ভ্রমণকাহিনী বলেই অভিহিত করেছেন।
তিনি ভ্রমণকাহিনী দেশে-বিদেশে ছাড়াও আরও বেশ কিছু বই তাঁর জীবদ্দশায় রচনা করেছেন। এর মধ্যে ভ্রমণকাহিনি : জলে ডাঙায়; উপন্যাস : অবিশ্বাস্য, শবনম, শহরইয়ার; ছোটগল্প : চাচাকাহিনী, টুনি মেম; রম্যরচনা : পঞ্চতন্ত্র, ময়ূরকণ্ঠী, গল্পমালা, রাজা-উজির, ধূপছায়া, বেঁচে থাক সর্দি-কাশি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের জন্য তিনি ১৯৪৯ সালে ‘নরসিংহ দাস পুরস্কার’, ১৯৬১ সালে ‘আনন্দ পুরস্কার’ এবং মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
তবে মুজতবা আলীর সকল সাহিত্যকর্ম, পুরস্কার বা প্রাপ্তির ঊর্ধ্বে সবচেয়ে বড় অবদান বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের দার্শনিক চিন্তা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ মাতৃকার মুক্তির কথা ভেবেছেন বারবার।
তার বিভিন্ন লেখায় এসেছে সে কথা। যেমন, ছোট গল্পে লিখেছেন পণ্ডিত মশাই তার ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন করেছেন। বিলিতি সাহেবের পা অলা কুকুরের পেছনে যে টাকা খরচ হয় প্রতি মাসে, শিক্ষকের বেতন তার তিন ভাগের এক ভাগ। তার মানে দেশী শিক্ষকের পরিবার ওই কুকুরের একটা পায়ের সমান। দেশ ভাগের মাত্র তিন মাসের মাথায় তিনি সিলেটে এসে ঘোষণা করলেন বাংলাকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এ নিয়ে পাকিস্তান আমলে সরকারি দমন-নিপীড়নের শিকার হতে হলো। বাধ্য হয়ে তিনি চলে গেলেন ভারতে। সেখানে তিনি বাঙালির জাতীয়তাবাদ ও মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে লেখালেখি করেন। তিনি একা ছিলেন ভারতে, আর তার পরিবারের সব সদস্য পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য তারই অনুপ্রেরণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী একজন কূটনীতিবিদ হিসেবে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তাঁর ভাগ্নে মাহবুব উর রব সাদী মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার হন এবং বীরত্বের জন্য বীর প্রতীক খেতাব লাভ করেন। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি নির্মাতাদের তিনি একজন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফিরে এসেছিলেন মাতৃভূমিতে। বাংলাদেশের মাটিতেই আজিমপুর গোরস্থানে ভাষা শহীদদের পাশে শেষশয্যা হয়েছে তাঁর।
Written by Shibli Sayeek (শিবলী সাইক)
Send private message to author






