“পারমিতার বিয়ে”

আজ সকাল থেকেই এক নাগাড়ে ঝুম বৃষ্টি পড়েই চলেছে। থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর সেই সাথে চলছে বারান্দায় বাবার ক্রমাগত পায়চারি। এই বৃষ্টির মধ্যে অতিথিরা কিভাবে আসবেন, তা নিয়ে বাবার দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। বাবা কিছুক্ষণ পর পর পায়চারি থামিয়ে আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছেন – “কী রে প্রজ্ঞা, বৃষ্টি তো থামছেই না। কী হবে এবার বল তো?”
বাবা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যান রান্নাঘরে মায়ের কাছে। সেখানে মাকে গিয়েও আবার একই প্রশ্ন করে। “যাও তো এখান থেকে। বিরক্ত কোরো না বারবার”- বলে মা এক চোট ঝাড়ি দেওয়ার পর বাবা আবার বারান্দায় এসে তার পায়চারি কার্যক্রম শুরু করেন। এমনটাই চলছে গত দুই ঘণ্টা যাবত। আমি শেষ পর্যন্ত অধৈর্য্য হয়ে পারুদির ঘরের দিকে গেলাম।
পারুদিকে আজ একেবারে ইন্দ্রানীর মতন লাগছে। দিদি আয়নার সামনে বসে কী নিয়ে যেনো ভাবনায় ডুবে আছে। আমার দরজা খোলার শব্দে চমকে তাকালো আমার দিকে।
“মামার পায়চারি থেমেছে প্রজ্ঞা?”
“না রে দিদি।”
“মামী কোথায়?”
“রান্নাঘরে।”
“আচ্ছা প্রজ্ঞা বলতো, আজ সব ভালোয় ভালোয় মিটবে তো?”
“মিটবে রে দিদি। দেখিস, সব কিছু সুন্দর ভাবে হবে।”
পারুদি মনে হয় আমার কথা শুনলো না। আবার কিছু একটা ভেবে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। আমিও আর কোনো কথা বললাম না।
বৃষ্টির জোর এখন অনেক কম। আমি ছাদে চলে এলাম। বৃষ্টিতে ভিজে ছাদ স্যাতস্যাতে হয়ে আছে। হাওয়া ভীষণ ঠান্ডা, বৃষ্টির গন্ধ লেগে আছে। গতকালকের “পারমিতার হলুদ সন্ধ্যা” লেখা কাগজটা বৃষ্টির পানির মধ্যে ডুবে আছে। আজ পারুদির বিয়ে। পারুদি আমার ফুপাতো বোন। দিদির জন্মের পর তার মা, বাবা দুজনেই মারা যান। এরপর বাবা দিদিকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। সেই থেকে দিদি আমাদের সাথেই। পারুদি অসাধারণ একটা মেয়ে, দেখতেও ভীষণ সুন্দর। কিন্তু কোনো এক কারণে দিদির বিয়ে হচ্ছে না। কোনো বিয়ে ঠিক হলে দুদিন পরেই আবার ভেঙে যায়। তবে বাবা বলেছে এবার দিদির বিয়ে হবেই।
আমি ছাদ থেকে নিচে তাকালাম। অতিথিরা সবার আসতে শুরু করেছেন। আমি নিচে চলে এলাম। বাবা হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছেন ঠিকই কিন্তু বাবার চোখে মুখে কিসের যেনো এক আতঙ্ক। মায়ের মুখেও ভয়। দিদি এখনো ঘর থেকে বের হয়নি। বিয়ে বাড়ি হলেও উৎসবের তেমন কোনো আমেজ নেই। শুধু যখন দুপুরবেলা সবাই খেতে বসলো তখনই কিছুটা উৎসব উৎসব মনে হচ্ছিলো। বিকেল থেকে আবার শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সন্ধ্যেবেলা বিরাট বরযাত্রী এলো। বিয়েবাড়ির কোনো আমেজ তবুও এলো না, বেশ সাদামাটা সবকিছু। দিদিও বিষন্নমুখে বসে আছে। তবে এই বিষন্নতা যেনো দিদির বিয়ের সাজটাকে পূর্ন করেছে। কী অপূর্ব লাগছে দিদিকে!
বিয়ে শুরু হওয়ার আগে আগে পুরো বিয়েবাড়ি জুড়ে কিসের যেনো চাপা গুঞ্জন শুরু হলো। দিদিকে নিয়ে সবাই কিসব বলাবলি করছে। সবার মধ্যে একটা অস্থিরতা। দিদির যার সাথে বিয়ে হবার কথা তার বাবা বেশ উচু গলায় বাবাকে কথা শুনাচ্ছে – “আপনারা আমাদের আগে এসব জানাননি কেনো? কী ভেবেছেন? এসব কথা লুকিয়ে নষ্ট মেয়েকে গছিয়ে দেবেন? ভেবেছেন কিছুই জানতে পারবো না? এতো বড় প্রতারণা। আপনাদের তো পুলিশে দেওয়া দরকার। যোচ্চরির একটা সীমা থাকা উচিত। আপনারা সে সীমা পেরিয়ে গেছেন।”
বাবা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছেন। একটা কথাও বলেননি। অতিথিরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। এখন একে একে সবাই চলে গেছে। বরযাত্রীরাও বেরিয়ে গেছে। পুরো বিয়েবাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেলো।
পারুদি মূর্তির মতো এসে বাবার সামনে দাঁড়ালো।
“মামা তুমি ওদের কিছু জানাওনি, তাই না?”
” মা রে তুই আমাকে মাফ করে দে মা।” – বাবা কেঁদেই যাচ্ছেন।
“মামা তুমি কেঁদো না। আমি তো কাদঁছি না দেখো। তুমি যা করেছো, ঠিকই করেছো। কেঁদো না মামা।” – বলেই দিদি বের হয়ে চলে গেলো।
দিদি বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ছাদ থেকে খুব ভারী কিছু নিচে পড়ার প্রচণ্ড শব্দে আমরা চমকে উঠলাম। বুকটা কেঁপে উঠলো। আমরা সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাম দৌঁড়ে। যে দৃশ্যটা দেখলাম সেটা দেখে পারুদির একটা কথা মনে পড়ে গেলো। পারুদি প্রায়ই আমাকে বলতো – “ধর্ষিতাদের এই পৃথিবীতে বাঁচার কোনো অধিকার নেই রে প্রজ্ঞা।”

(তাসফিয়া জামান Tasfia Jaman)

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
4
0
0
0
0
2
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
তাসফিয়া জামান
4 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!