মানুষ

আমি লাবণ্য। আজ স্থানীয় এক দৈনিক পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়েছে। না, আমি কোনো বিশেষ তারকা নই। সাধারণ বাবা মায়ের খুব সাধারণ মেয়ে আমি। কয়েকবছর আগে সোনাদীঘি গ্রাম থেকে বাধ্য হয়ে আমাদের শহরে আসতে হয়।

সোনাদীঘি গ্রামে ছিল আমাদের বসবাস। গ্রামের একপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। চারদিকে ঘন সবুজে ঘেরা পরিবেশ। গাছগুলি একটার সাথে একটা ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে আছে যেন। গ্রাম থেকে একটু দূরে রয়েছে এক ঝর্ণা। ঝর্ণার পানি পাহাড় বেয়ে ছোট্ট দুরন্ত বালিকার মতো নেচে নেচে নেমে আসে মাটিতে। তার চলার মধ্যে এক অদ্ভুত ছন্দ আছে। শুধু কান পেতে শুনতে হয়। দাদুর সাথে যখন ঝর্ণার ধারে ঘুরতে যেতাম তখন দাদু বলতেন, “গিন্নি, চোখ বন্ধ করে কান পাতো দেখি।” আমিও চোখ বন্ধ করে শুনতাম পানির কলকল শব্দ।

আমার বাবা ছিলেন সোনাদীঘি গ্রামের সোনাদীঘি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বাবা স্কুল থেকে ফিরতে বাজার সদাই করে নিয়ে আসতেন। সাথে নিয়ে আসতেন এক ঠোঙা বাদাম। বাবা বলতেন, “বাদাম খেলে বুদ্ধি হয়, ব্রেইন খোলে।” বুদ্ধি হয় কিনা জানি না, তবে আমরা দুই ভাইবোন মিলে ঠোঙা নিয়ে বসে পড়তাম। গুনে গুনে পাঁচ ভাগ করতাম। দাদু, বাবা, মা, আমার ছোট ভাই পিন্টু আর আমার জন্য। মা বলতেন, “যা খাবে সকলে মিলে ভাগ করে খাবে।” মা যদি বাদাম খেতে না চায়তো বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে শুনিয়ে শুনিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন, “পৃথিবীতে যারা বাদাম খায় না তারা বোকা থেকে যায়।” অমনি মা রেগে বাবাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতেন। মা আর বাবার খুনসুটি চলত। বাদাম খেতে খেতে আমি ভাই আর দাদু মিটিমিটি হাসতাম।

দাদুর সাথেই আমরা ভাইবোন প্রায় বিকেলে ঘুরতে বের হতাম। কখনো ঝর্ণার ধারে বা কখনো নদীর তীরে, আবার কখনো শীতের মেলায়। মেলায় মণ্ডা-মিঠাই খাওয়া হতো। নাগরদোলা চড়তাম। আমার ছোট ভাই পিন্টু খুব ভয় পেত চড়তে। আমি সাহস দিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।

একদিন নদীর তীরে ঘুরতে গিয়ে দাদুর কাছে নৌকায় চড়ার জেদ ধরি। দাদু এক মাঝিভাইকে ডেকে বলেন, “ও মাঝি, এক চক্কর দিবা কত দিতে হবে?” মাঝি বলে, “পঞ্চাশ ট্যাহা দিয়েন চাচা।” দাদু আবার বলেন, “আরে না! কুড়ি টাকায় চল্।” শেষ পর্যন্ত নৌকা ভাড়া ত্রিশ টাকায় এসে ঠেকল। যখন আমরা নৌকায় উঠছিলাম তখন আকাশ বেশ ফর্সা ছিল। নৌকা কিছুদূর যেতেই কোত্থেকে ঘন কালো মেঘ এসে আকাশকে ঢেকে ফেলে। দাদু মাঝিকে তাড়া দেয়, “মাঝি নৌকা জলদি তীরে ফেরাও।” মাঝিভাই তার শক্তি দিয়ে পানিতে ছলাৎছলাৎ শব্দ তুলে বৈঠা চালায়। হঠাৎই যেন তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। যেমন বাতাস তেমন বাজ! বৃষ্টিও থেমে নেই। বৃষ্টি, বাতাস, বাজ এরা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ বলে আমায় দেখ্ ও বলে আমায় দেখ্। পিন্টু আর আমি ভয়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরি।

চোখ খুলে দেখি আমি বিছানায়। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। আমি তখনো ভয়ের মধ্যেই ছিলাম।

বাবা কাঁদেন না, চুপচাপ থাকেন। মা কান্না করে করে নিজের কষ্টটাকে হালকা করতে পারলেও বাবা পারেন না। ইচ্ছে হয় বাবাকে বলি, “বাবা কাঁদো, কাঁদো। কাঁদলে আপনার বুকটা হালকা হবে।”

সেদিনকে দাদু আর পিন্টু নদীর বুকে হারিয়ে গিয়েছিল। পরে দাদুর মৃতদেহ খুঁজে পেলেও পিন্টুকে আর পাওয়া যায়নি। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। আমি যদি নৌকায় চড়ার জেদ না করতাম তাহলে হয়তো আমার দাদু আর পিন্টু আজ আমাদের মাঝেই থাকত।

বাজার থেকে বাবা আর ঠোঙা করে বাদাম নিয়ে আসেন না। পিন্টুর পছন্দের চিংড়িমাছ আর বাড়ির হেঁসেলের উনুনে কখনো রান্না হয়নি। আমিও আর কখনো বাদাম নিয়ে একজোড়া দুইজোড়া করে গুনতে বসিনি।

পাঁচবছর পর আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই। বাবার পুরোনো হাঁপানীর রোগটা খুব বেড়ে যায়। গ্রামের ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়ে দুদিন ভালো থাকেতো আবার শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। ডাক্তারবাবু বাবাকে বলেন শহরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে। বাবার চাকরি করার মতো আর অবস্থা থাকে না। আমাদের পাশের বাড়ির ননাকাকু বাবার বন্ধু মানুষ। তিনি মাকে বলেন, “বৌদি দাদাকে শহরে নিয়ে যান। অবস্থাতো বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না।” এদিকে শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো অত টাকা নেই ঘরে। থাকার মধ্যে আছে শুধু ভিটেখানা। বাবার কষ্টে উপার্জিত অর্থের সঞ্চয় দিয়ে এই ভিটের উপর একতলা পাকাবাড়ি তৈরি করা হয়েছিল।

মায়ের এক বোন থাকেন শহরে। মা শহরের সেই মাসিমণিকে ফোনে সবটা জানান। মাসিমণি মাকে শহরে আসতে বলেন। মাসিমণির পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত স্বচ্ছল ছিল না। মেসোমশাইয়ের ছোট দোকানের আয়ে তাঁদের পরিবার কোনো রকম চলে। মা আর কোনো উপায় না পেয়ে ভিটের কাগজ মর্টগেজ রেখে টাকার ব্যবস্থা করেন। বাবা আর আমাকে সাথে নিয়ে মা শহরে আসেন। বাবার চিকিৎসা চলে লম্বা সময় ধরে। মা ভেবে দেখলেন এবার মাকেই সংসারের হাল ধরতে হবে। মেসোমশাইয়ের সাহায্যে মা গার্মেন্টসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল।। মাস চারেক আমরা মাসিমণির ঘরেই ছিলাম। মাসিমণির দুইমেয়ে একছেলে। তাঁদের ঘরের সদস্য পাঁচজন। তারমধ্যে আমরা এসে জুটেছি তিনজন। ছোট দুইটা শোবার ঘরে সবাই মিলে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে। মাসিমণি আর মেসোমশাই সত্যি খুব ভালো মানুষ। নিজেদের অবস্থা অতটা স্বচ্ছল নয়, তবুও আমাদের জায়গা দিয়েছিলেন। বিপদে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

মাসিমণিদের ঘর ছেড়ে মা কাছাকাছি একটা ঘর ভাড়া নেন। আমি মা আর বাবা নতুন বাসায় উঠি। মা আমাকে সিটি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। মা ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাত আর একটা তরকারি রান্না করে নিত। নিজের জন্য ভাত বাক্সে নিয়ে আমাদের বাবা মেয়ের জন্য রেখে যেত। ফুসফুসের সমস্যায় বাবা কোনো কাজ করতে পারেন না। বাবা ঘরেই থাকেন। আমি বাবাকে চা করে দিয়ে কলেজে যাই। ফিরে এসে ভাত খেয়ে আবার বের হই নিজের কোচিং ক্লাস আর দুটো টিউশনি করতে। ঘরে আসি রাত আটটার পর। এ নিয়ে অবশ্য কিছু প্রতিবেশির চোখে ঘুম চলে যায়। তাদের ভাষ্যমতে কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে রাত আটটা পর্যন্ত বাইরে থাকে না। আমি আর মা এসবে কান দিতাম না। শুধু জানতাম আমাদের থামলে চলবে না। অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। খারাপ লাগত তখনি যখন কথাগুলো কোনো মহিলার মুখ থেকে শুনতাম। ওরা মেয়ের জাত হয়েও কীভাবে মেয়েদের নিয়ে অহেতুক সমালোচনা করতেন!

মা প্রাণপণ চেষ্টা করে সংসারের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতেন। খরচ সামলে তেমন বড় কোনো অংকের টাকা জমা হতো না। তবুও মা আশায় বুক বাঁধেন। একদিন ঠিক আমরা আমাদের ভিটেবাড়ির কাগজ ফিরিয়ে নিতে পারব। আবার সেই ঝর্ণার গান শুনতে যাব। দুটো বাড়তি টাকার আশায় মা আমার নাইট ডিউটি করতেন। যেদিন নাইট ডিউটি থাকে সেদিন মায়ের ঘরে ফিরতে রাত দশটা বেজে যেত। বাবার পছন্দ হতো না। কেন মা এত রাতে ঘরে ফেরে! বাবা যে আমার পুরুষ মানুষ। একেতো ঘরবন্দি তার উপর স্ত্রী যদি রাত দশটা পর্যন্ত বাইরে থাকে স্বামী হিসেবে হয়তো সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না। বাবা শিক্ষক মানুষ তাই হয়তো মায়ের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেননি। কিন্তু মা কাজে বেরিয়ে গেলে বাবা আমাকে বলতেন, “তোর মায়ের এতক্ষণ পর্যন্ত কাজ করার কী দরকার! তুই বলতে পারিস না মাকে।” আমি পাশে বসে বাবার হাত ধরে বলতাম, “বাবা, বাড়তি কাজ করতে মায়েরও কষ্ট হয়। ওখানে মাকে বসিয়ে রাখে না। আচ্ছা ধরেন, আমার কোনো বড়ো অসুখ করল আর চিকিৎসা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। তখন কী করবেন? মানুষের কাছে হাত পাতবেন? হাত পাতলে যে টাকা পাবেন তার ভরসা কোথায়! বিপদের দিনে কারো দুয়ারে যাতে যেতে না হয় মা তারই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাছাড়া আমাদের ভিটের কাগজ ফেরত নিতে হবে তো।”
“মারে সব বুঝি। বুঝেও কেন জানি মাঝেমধ্যে অবুঝ হয়ে পড়ি। সারাদিন কোনো কাজ থাকে না বলে হয়তো মাথার মধ্যে উল্টোপাল্টা চিন্তারা এসে ভীড় করে। কথায় বলে না, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” এরপর বাবা মেয়ে হেসে কুটিকুটি হই। হাসতে হাসতেই বাবা বলেন, “চা-পাতি আছে? থাকলে এক কাপ রঙ চা করে দে মা।” বাবাকে হাসতে দেখলে খুব ভালো লাগে। মা-বাবার মুখের হাসি দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। দুকাপ রঙ চা নিয়ে একবাটি মুড়ি সমেত বাবা মেয়েতে বসে রাতের খবর দেখতাম। এক ইদের বোনাস দিয়ে মা ছোট একটা টেলিভিশন কিনেছেন। বাবাকে সঙেগ নিয়ে গিয়ে চৌদ্দো ইঞ্চি সনি রঙিন টিভিটা কেনা হয়েছিল।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ দিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি নিজের ভালোটা বের করে আনার। সফল হয়েছি আমার বাবা আর পরিশ্রমী মায়ের আশির্বাদে।

গতকাল আমার বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। সেজন্য আজ পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়েছে। ছবি দেখে যতটা না খুশি হয়েছি শিরোনাম দেখে অবাক হয়েছি চারগুণ!
‘গার্মেন্টসকর্মীর মেয়ে বিসিএস ক্যাডার’ এই শিরোনাম দেখে অনেকে বাহবা দিলেও আমি মোটেও খুশি হতে পারিনি। শিরোনামে লিখতে পারত অমলেন্দু সেন আর মালবিকা সেনের একমাত্র কন্যা লাবণ্য সেন বিসিএস ক্যাডার। শিক্ষা যে মানুষের মৌলিক অধিকার। আমরা সবাই মানুষ এটাই আমাদের প্রথম পরিচয়।

ছোটগল্প

পপি ধর
২৪.০৬.২০২১

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
2
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!