আপাত স্বাভাবিক

“তবে যাই বলিস, ছেলেটা কিন্তু টাকা কামাতে জানে” বলতে বলতে কসমস বিস্কুটের প্যাকেটখানার শেষ বিস্কুটটি তুলে নিল মিনু খালা।

কসমস আমার প্রিয় বিস্কুট। প্রায়ই খেতাম কিন্তু ইদানিং পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় কসমসের কাছাকাছি স্বাদের অন্য কোম্পানীর বিস্কুট কিনে যখন তখন খাই। কিন্তু আজ, একটি শপিংমলের নিচে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে কসমস পেয়েই কিনে এনে খেতে যাবো ঠিক তখনই মিনু খালা এসে “ওমা, কসমস? কোথায় পেলি?” বলে ছোঁ মেরে প্যাকেটটা নিয়ে সাবাড় করে দিল! একটাওও খেতে পারলাম কই আর?

খালা এসেছে বড় মেয়ে নীলা আপার বিয়ের কার্ড দিতে। নীলা আপা এবছর স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করলো। দেখতে শুনতে ভালোই। কিন্তু মন-মানসিকতা প্যাঁচালো ধাঁচের। রাজু ভাইয়ের সাথে এতো বছর প্রেম করে ব্যাকআপ হিসেবে আসলাম ভাইকে রেখে আজ কোন এক বসন্তর সাথে তার বিয়ে হতে চলেছে।
ছেলের নাকি দুধের ব্যবসা। বসন্ত ডেইরি ফার্মের মালিক সে।
“সর্বনাশ! ছেলে তো দুধওয়ালা” বলে উঠল ভাইয়া।

“হারামজাদা! কী বললি রে? ছেলে দুধওয়ালা? তোর সাহস কত? তুই নিজে কী রে, নিজে কী? অনার্স-মাস্টার্স পাস করে কি এমন উল্টেছিস? হ্যাঁ? সেই তো করিস ১৫ হাজার টাকা বেতনের ছোট একটা চাকরি। আমার হবু মেয়ে-জামাই মেট্রিক পাসও করেনি তাও কত কামাচ্ছে জানিস? মাসে প্রায় লাখের উপর।”

ভাইয়ার মুখ কালো হয়ে গেল। এই জীবনে চাকরি আর টাকার খোঁটা কম খায়নি সে। আজকাল ১৫০০০ এর চাকুরেকে কেউ মেয়ে দিতে চায় না। দুইবছর আগে ভাইয়ার প্রেমিকা দিশা আপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অন্য কারো সাথে।কিন্তু বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি আপু। বিষ খেয়ে জীবন-জ্বালা জুড়িয়ে পরপারে চলে গেল
গতবছর মার্চে।
ভাইয়ার জন্য কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় মাঝে মধ্যে।

দৃশ্যপট থেকে ভাইয়া আপাতত সরে পড়লো।

মা বললেন, “ছেলেতো দেখি পড়াশোনা করেনি। এমন ছেলের সাথে অনার্স পাস একটা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিস মানে? ভেবে দিচ্ছিস তো?”

“আরে আপা, ডিগ্রি ধুয়ে পানি খাবো নাকি? মেয়ে থাকবে রাণীর মতো। ব্যস!”

আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এটা বলতে যাচ্ছিলাম যে, বসন্ত ডেইরি ফার্ম দুধে পানি মেশায়। কেমন উৎকট গন্ধ। গতবছর পুলিশ কেস হয়েছিল, পত্রিকায় লেখালিখিও হয়েছে। পরে অবশ্য পুলিশকে টাকা খাইয়ে মামলা খারিজ হয়ে যায়। ছেলে যে পেশাদার বোঝায় যাচ্ছে।

সৎ-সাধুতা আর কাগুজে ডিগ্রি তো স্রেফ ‘আবেগ’ ওসব দিয়ে ব্যবসা মনে হয় আজকাল হয় না,ওসবে ভাত নেই।

পরের দিন অনেক দোনোমোনা করে জানালাম খালাকে, কিন্তু খালার সেই এক কথা “ছেলের অনেক টাকা” এবং ইনিয়ে বিনিয়ে এটাও বলল আমরা নাকি হিংসুক, কারো সুখ দেখতেই পারি না। নীলা আপা দামি শাড়ি পরে ঘুরবে আমার কি আর সহ্য হয়?

যথারীতি বিয়ে হয়ে গেল।

বেশ ভালো মানুষের মতো কথা-বার্তা বলে নীলা আপার স্বামী । ফেসবুকের ভুলে ভরা পোস্টগুলি দেখে দেখে নেতাজীর উক্তি নেপোলিয়নের ঘাড়ে আবার এদিকে নেপোলিয়নের উক্তি আব্রাহাম লিঙ্কনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিব্যি জ্ঞান দিতে জানেন। সবাই বাহবা দেয়, তালি বাজায় কিন্তু কেউ বাজিয়ে আর দেখেনা।

তারা বাজিয়ে দেখে আমার ১৫০০০ টাকার চাকুরে ভাই আর সামান্য পেনশনভোগী বাবাকে। তারা নেপোলিয়নের কথা নেপোলিয়নের বরাত দিয়ে বললেও নীলা আপার স্বামীই দিন শেষে ঠিক।

এদিকে দুলাভাইয়ের ব্যবসা দিনে দিনে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। তার ফার্মে আগে ২০ টি গরু ছিল এখন আরো ৫ টি যোগ হয়েছে। তবুও ফার্মের দুধ এখনো পাতলা সাথে উৎকট গন্ধ। সাইড ব্যবসাও নাকি শুরু করেছে। কিসের ব্যবসা দুলাভাই বলতে চায়না। জিজ্ঞেস করলে বলে “একটা ব্যবসা শুরু করেছি আরকি, তেমন কিছু না”

প্রায় পাঁচবছর পরের কথা।

আমি এখন বিবাহিত।আমরা দুজনেই স্কুল শিক্ষক। পুরো সপ্তাহ মাস্টারি করে সপ্তাহশেষে দুজন মিলে একটু বেড়াতে বের হই। সিনেমা দেখি, লেকের পারে যাই, বন্ধুদের বাসায় আড্ডা দেই, কফিশপে ঢুঁ মারি কখনো। আবার কোনো কোনো শুক্রবারে, ছোট্ট বারান্দাতে দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গল্প করতে বসে যাই। সুখের আলাপ করা হয় প্রায়ই। কখনো ছোট পর্দার কিংবা বড় পর্দার চরিত্রগুলির ভান করা সুখের গল্প করি।
আবার কখনো একে অপরকে শোনাই, নিজেদের জীবনের সত্য সুখের কথন।

আর চায়ের সাথে পপ বিস্কুট (কসমস বিস্কুট এখন আর পাওয়া যায় না)

নীলা আপা আর বসন্ত দুলাভাই আলাদা থাকেন। নীলা আপার নামে একটা ফ্ল্যাট আছে গুলশানে, আপা সেখানে থাকে এখন। সাথে চার নফর। আপাকে ঘরের প্রায় কোনো কাজই করতে হয়না। শরীরে মেদ জমেছে ঢের। বসে বসে অনলাইন শপ থেকে এটা ওটা কেনে। নিজেও এমন অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছিল কিন্তু একবার নকল প্রসাধনী আসল বলে চালিয়ে দিতে গিয়ে গ্রাহকের কাছে ধরা খেয়ে আর ও পথ মাড়ায়নি। তার একটাই ছেলে, মনির নাম। ভাইয়ার মেয়ে নির্ঝরের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। মনিরকে নিয়েই এখন তার দিন কাটছে।

বসন্ত দুলাভাই প্রচুর বিত্ত সম্পত্তির মালিক এখন। এতো বিষয়-সম্পত্তি দিয়ে কী করবেন ভেবেই পান না। দুবাইয়ের সোনা দিয়ে গড়ানো হার নীলা আপার গলায় পরাতেই পারছেন না, মেদের ঠেলায় গলা গায়েব, হার পরাবেন কোথায়? বেচারা তাই মেদহীন গর্দান আর কচি কোমর দেখে বিয়ে করলেন বার ড্যান্সার শেফালিকে। তার গলায় বেশ মানায় এ হার।

“তবে যাই বলিস, ছেলেটা কিন্তু টাকা কামাতে জানে” বলতে বলতে পপ বিস্কুটের প্যাকেটখানার শেষ বিস্কুটটি তুলে নিল মিনু খালা।

যদিও গলায় তেমন জোর নেই!

-Maliha Tabassum Momo

Send private message to author
What’s your Reaction?
6
5
0
0
0
1
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Maliha Tabassum Momo
2 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!