অভিমান

বড়ো ভাই বাসায় ঢুকল তার পিছনে নতুন শাড়ি পরা একটা পরীর মতো মেয়ে! বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ভাইয়া বলল, “বাবা তোমার বউ।”

আমার মনে হলো পাশেই একটা কঠিন বজ্রপাত হওয়ায় বাবা কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন ভাইয়ার দিকে। ভাই ভাবি কে বলল, “বাবা কে সালাম কোরো।”

হঠাৎ হুঁশ ফিরে পেয়ে বাবা সটকে দাঁড়ালেন। না, না আমাকে সালাম করতে হবে না। তোমরা বিয়ের মতো একটা সিদ্ধান্ত যখন নিজেরা নিতে পেরেছ বাবার দরকার হয়নি! বাকি জীবনটা বাবা ছাড়া থাকতে পারবে।

“বাবা তুমি রিনা কে মেনে নিবে না?”

“আঃ! আমার মানা না মানাতে তো কিছু আসে যায় না, তাই না?”

“বাবা তুমি এত কঠোর ক্যান হচ্ছ! আমি ছাড়া রিনার কেউ নাই বাবা!”

“তা রিনার না হয় তুমি ছাড়া কেউ ছিল না। তোমার তো রিনা ছাড়া অন্যরা ছিল নাকি?”

বাবা ভিতরে চলে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরা চলে গেলে গেটটা লাগিয়ে দিছ।”

ভাইয়া বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে চেয়ে রইল, তারপর বলল, “রিনা চলো।”

আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ভাবির কাছে যাই। কিন্তু ভাবি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বের হয়ে গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির পাশে একটা ছোট করে মাঠ আছে সেখানে বসে বাবাকে কাদঁতে দেখেছি! আমি দূর থেকে দেখছি বাবা অঝোর ধারায় কাঁদছেন! একটা বড়ো মানুষের কাঁদার দৃশ্য বড়ো বিশ্রী লাগে দেখতে!

আমার মা যেদিন মারা যায় সেদিন বাবাকে কাদঁতে দেখিনি! অথচ আজ বাবা কাঁদছেন! ভাইয়া বিয়ে করেছে এত খুশির খবর কিন্তু বাবা কেন কাঁদছেন?

আমার মা যখন মারা যায় আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি আর ভাইয়া কলেজে। বড়ো ফুফু মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে আমাদের বাড়িতে এসে বাবা কে বিয়ে করানোর জন্য নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। আমি পাশের রুম থেকে শুনতাম ফুফু বলতেন, “শোন রেজাউল তোর বয়স খুব বেশি হয়নি, রায়হান ও রাজ্জাক বড়ো হয়ে গেছে। তোর বিয়ে করতে সমস্যা কী?”

বাবা জুতসই জবাব দিতে পারতেন না। শুধু বলতেন,” বড়ো আপা তুমি এ সব কী বলো! আমি বিয়ে করলে ওদের দুই ভাইয়ের কী হবে?”

“আরে গাধা! ওদের কী হবে মানে ওরা কি ছোট যে তুই বিয়ে করলে নষ্ট হয়ে যাবে? সৎ মা এসে ওদের অত্যাচার করবে?”

বাবা কোনো কথা বলতেন না। ফুফু রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন। অনেকবার বলার পরও যখন বাবা ফুফুর কথা শুনলেন না। ফুফু আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেন।

বাবা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বেশ আনন্দে ছিলেন বলা যায়। বাবাকে কখনও দুঃখ করতে দেখিনি। আমাদের জন্য নিজ হাতে রান্না করতেন। অফিসদিনে শর্টকাট রান্না হতো। ছুটির দিনে বেশ আয়েশ করে গরুর মাংস পোলাও রান্না করতেন। ভাইয়া পোলাও মাংস খেতে অনেক পছন্দ করে।

আমাদের দিনগুলো কাটতে লাগল, ভাইয়া পাশ করে সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছে, আমি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। এরইমধ্যে ভাইয়া বিয়ে করে ফেলল।

ভাইয়া এখন আলাদা বাসায় থাকে। আমি আর বাবা একসাথে থাকি। বাবার অবসর ভাতা আর কিছু ইনভেস্ট থেকে পাওয়া টাকায় আমাদের চলে যায় ভালোই।

আমি মাঝে মাঝে ভাইয়ার বাসায় যাই। ভাবিটা খুব ভালো আমাকে খুব আদর করে। বাবার কথা জানতে চায়। বড়ো দুঃখ করে বলে,” বাবার রাগ করাটা ঠিক আছে।” কিন্তু ভাইয়া অভিমান করে বাবার কাছে যায় না। আমার কাছে বাবার কথা জানতে চায়।

বাবা গরুর মাংস রাঁধলে আমি ভাইয়ার জন্য নিয়ে যাই। ভাইয়া খায় আর বাবার কথা বলে মনখারাপ করে। আমাকে বাবা জিজ্ঞেস করে,” তুই কি গাধাটার সাথে যোগাযোগ করিস নাকি?”

আমি চুপ থাকি।

“খবরদার ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করবি না।”

আমি অবাক হয়ে দেখি প্রতিবার বাবা মাংস রান্না করার সময় বেশি করে রাঁধেন! আমি যে ভাইয়ার জন্য নিয়ে যাই তিনি বুঝেন কিছু বলেন না। আবার ভাইয়ার সাথে দেখা না করতে বলেন!

ভাইয়ার বাসা থেকে কোনো খাবার আনলে খুব রাগ দেখান। গভীর রাতে ফ্রিজ খুলে আমার অজান্তে তা টেস্ট করেন!

ঈদের সময় বাবা দেখি ভাবির জন্য একটা শাড়ি আনলেন। আমাকে বললেন, শাড়িটা টুপ করে দিয়ে চলে আসবি। মেয়েটার তো দোষ নাই!

ভাইয়া বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে শুনে বাবা প্রচন্ড ক্ষেপলেন আমার ওপর কেন আমি পাঞ্জাবিটা আনলাম। আমি খেয়াল করলাম বাবা কোনো নতুন পাঞ্জাবি কিনলেন না। ঈদের আগেরদিন উপায় না দেখে বাবার পুরনো একটা পাঞ্জাবি ধুয়ে আয়রন করে রেখে দিলাম। ঈদের দিন সকালে বাবা খুব হইচই শুরু করলেন তার একটাও পাঞ্জাবি খুঁজে পাচ্ছেন না! আমি চুপচাপ দেখছিলাম,বাবা জানে ওয়ার ড্রবের প্রথম তাকেই তার পাঞ্জাবি আছে। একটু পরে খুব রাগের ভান করে, ” সবগুলি গাধা! একটা তো গেছে ঘরেরটা হয়েছে বড়ো গাধা! বাবার একটা পাঞ্জাবি ধুয়ে রাখবে তা না!” বলে কিছুই করার নাই বাধ্য হয়ে পরেছে এমন ভাব নিয়ে ভাইয়ার পাঞ্জাবিটা পরে বের হয়ে গেলেন!

দূর থেকে খেয়াল করলাম বাবার বন্ধু কে বলছেন, “কোনো হিসাব নাই বুঝলা, এত টাকা খরচ করে একটা পাঞ্জাবি কিনে কেউ? সব গাধার দল!”

“তুমি যে কি বলো না! বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনবে কম দামে বুঝি?”

ভাইয়ার যেদিন ছেলে হলো। ভাবি কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাবা যাবেন না। অগত্যা আমি চলে গেলাম হাসপাতালে। ভাইয়া আর আমি কথা বলছি দেখি বাবা চারদিকে দেখে হাসপাতালে ঢুকছেন। চুপিচুপি ভাবি আর নাতি কে দেখতে চলে এসেছেন! ভাইয়া দূর থেকে দেখল। সামনে গেল না। বাবা নাতি কে দেখে চলে গেলেন।

প্রায়ই বাবা ভাইয়ার বাসায় যান যখন ভাইয়া বাসায় থাকে না। ভাবি আর নাতির সাথে দেখা করে চলে আসেন। আমাকেও কিছু বলেন না! আমি ভাবির সাথে দেখা করতে গেলে ভাবি সব বলে আর হাসে!

গভীর রাতে হঠাৎ বাবা আমাকে ডেকে বুক চেপে ধরে বললেন, “রায়হান একটা গাড়ি নিয়ে বাপ।”

আমি দ্রুত বের হয়ে গেলাম এত রাতে গাড়ি পাওয়া খুবই কষ্ট। অনেক খুঁজে গাড়ি নিয়ে এলাম। বাবা নিজেই গাড়িতে ওঠলেন। বাবা আমার কুলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। আমি ড্রাইভার কে তাড়া দিচ্ছি। বাবা বললেন, “খবরদার গাধাটা কে খবর দিবি না।”

চিন্তায় আমার ভাইয়ার কথা খেয়াল ছিল না। আমি ভাইয়াকে একটা মেসেজ দিলাম। বাবার সামনে কল দেয়া যাবে না।

হাসপাতালে পৌঁছে বাবাকে দ্রুত আই,সি,ইউ তে নেয়া হয়েছে, আমি ভাইয়াকে কল দিয়ে কোনোমতে বাবার কথা জানিয়েছি।

হন্তদন্ত হয়ে ভাইয়া ছুটে এসেছে, আমার সামনে এসে আমাকে কষে একটা চড় মারলেন। ” গাধা! তোকে কী জন্য পড়াশোনা করানো হচ্ছে! তুই এত পরে আমায় কল দিলি কেন? কেন? সাথে সাথে কেন কল দিলি না?”

এতবছর পর দুইজন সামনা সামনি হয়েছে! আমি সেদিন বাবা কে দূর থেকে কাঁদতে দেখেছিলাম। আজ ভাইকে দেখছি। ভাইয়া লুকিয়ে লুকিয়ে নয় সামনাসামনি কাদঁছে, “বাবা তুমি আমাকে একটা সুযোগ দিলে না!”

গল্প-অভিমান
® নাবিল মাহমুদ

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
1
0
0
1
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Nabil Mahmud
3 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Salma Papia
Member
4 years ago

সুন্দর হয়েছে। পড়ে ভাল লাগল।

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!