ট্রেনের কামড়ায় সবে ঢুকলাম। সাধারণত আমি একাই এক কামড়া নেই কিন্তু আজ তা আর পাইনি। অগত্যা শেয়ার করেই যেতে হবে আমায়। কামড়ায় ঢুকে নিজের ব্যাগটা রাখলাম। আমার অপর পাশেই এলো চুলে সুন্দর এক যুবতী বসে। ধবধবে সাদা থ্রি-পিচ পরে আছে। প্রচুর শীত পরেছে এই বার। নিজেই গায়ে চাদর জড়িয়ে নিয়েছি তবুও শীত মানছে না। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে আমার শীত যেনো উবে গেলো। শুধু মাত্র একটি জামা পরে কিভাবে আছে। আমি যে তার অপর পাশে বসে আছি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। জানালা দিয়ে এক নজরে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাইরে তেমন কিছু একটা দেখছি না। লোকজন তেমন একটা নেই বললেই চলে। চায়ের দোকানটাও ফাঁকা পরে আছে। কুয়াশার জন্য তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এতো ছোটো একটি স্টেশনে আর কিবা আশা করা যায়। কৌতূহল বসতো মেয়ে টাকে জিজ্ঞেস করে ফেলি,
বাইরে এমন করে কি দেখছো?
মেয়েটা আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চেয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে। আমার সৃজনশীল মন তাকে নিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টায় আছে।
সিগারেটে আগুন ধরাতে ধরাতে বলছি,
আমি রুদ্র। ছোটো খাটো একটি পত্রিকায় লেখা লেখি করি। একটু আক টু নাম ডাকো আছে। তবে বেশিরভাগ লোকেই আমার নামটাই শুধু জানে। খুব কম লোকেই চিনে আমাকে।
মেয়েটা এই বারো শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে।
এতো সহজে হাল ছাড়বার পাত্র আমি না। প্রশ্নের জবাব পাইনি তো কি হয়েছে আবার তার দিকে প্রশ্ন ছুরে মারলাম।
তোমার কি শীত করছে না? একে তো প্রচুর শীত পরেছে এইবার। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। তার ভিতর তুমি একটা জামা পরে আছো কিভাবে বলো-তো?
আমার মুখে তুমি শুনে মেয়েটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি আসলে আপনি-তে অভ্যস্ত নই। তাই তুমি বলে সম্মোধন করলাম। কিছু মনে করোনা।
মেয়েটা আবারো বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেন চলছে, ঠান্ডা আরো জমে উঠেছে। সিগারেট ধরিয়ে ভাবছি মেয়েটাকে নিয়ে। মনে মনে কবিতার লাইন সাজিয়ে নিচ্ছি।
ভাবছি একটু গল্প জমানো যাক। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে বলতে থাকলাম…
শেবার কলকাতা প্রেসে গিয়েছিলাম। আমার একটি বই ছাপানোর ব্যাপার নিয়ে। কলকাতা প্রেসের মালিক আবার আমার ভালো বন্ধু। সেখানে বসে গল্প শুরু করলাম। দুই বন্ধুতে ভালোই জমে ছিলো। তখন একটি মেয়ে এসে হাজির হয়। বলছিলো সে তার নিজের একটি কবিতার বই ছাপাতে চায়। কিন্তু বইটিতে সে তার নাম দিতে চায় না। বইটির নাম হবে ঘোর।
কবিতার বইয়ের নাম ঘোর ব্যাপারটা যেনো কেমন মনে হলো। মেয়েটা বইটি ছাপানোর জন্য যতো টাকা লাগবে দিতে রাজি। তবে সে তার বই গুলোর কোনো মূল্য রাখবে না। যার ভালো লাগবে ফ্রি তেই নিতে পারবে।
মেয়েটার দিকে তাকালাম আমার কথা শুনছে নাকি। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে পরে কি হলো শুনবার জন্য। আমি আবার শুরু করলাম।
এমন প্রস্তাবে সে রাজি হতে চায়নি। আর বইটি না পরে সে ছাপা বেনা ছাফ জানিয়ে দিয়েছে। আগে দেখবে পরে ছাপাবে কিনা জানাবে। মেয়েটি যাবার পর তার কবিতা গুলো আমি ঐদিন শেষ করে বাড়ি ফিরেছিলাম। এতো সুন্দর লেখা যা সত্য কে তুলে ধরেছে। বাংলার অবস্থাকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছে যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তারপর বুঝেছি বইটির নাম কেনো ঘোর দিয়েছিলো মেয়েটি। আমার বন্ধু অবশ্য রাজি হতে চায়নি। এই বই ছাপলে পরে বিরাট সমস্যায় পরে যেতে পারে। পরে অবশ্য একটু বেশি লাভের আশায় মেয়েটির প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলো। আমি সেখান থেকে একটি কপি রেখে দিয়েছি আমার লাইব্রেরিতে রাখবো বলে। বইটি নিয়ে পরবর্তিতে অবশ্য একটু আধটু সমস্যায় পরতে হয়েছিলো আমার বন্ধুর। কিন্তু কিছুদিন পরেই সেই মেয়েটি খুন হয়। সেই খুনের এখনো কোনো তদন্ত হয়নি। আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমার কথা শেষ হতেই মেয়েটি আবার বাইরে তাকিয়ে আছে। এমন অদ্ভুত আচরণে বিরক্ত হবো কি আরো মুগ্ধ হচ্ছি।
এবার মানিক বন্ধ্যোপাদ্যায় এর একটি বই নিয়ে বসলাম। পাঁচ কি ছয় ঘন্টার পথ। সাথে বই থাকবেই। বই ছাড়া কথাও গেলে আমার সেই যাত্রা মাটি হয়ে যায়।
দু পাতা পরেই চায়ের নেশা লাগলো। ভাবলাম দু কাপ চায়ের ওর্ডার করি। মেয়েটি খেলে খাবে না হয় আমি খাবো। চায়ের ওর্ডার দিয়ে আবার বইয়ের পাতায় মননিবেশ করলাম। মিনিট পাঁচেক পর চা এলো। এক কাপ আমি নিলাম আরেক কাপ মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিলাম। মেয়েটি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এলো চুল গুলো একটু পর পর ঠিক করছে। আমি কি মনে করে যেনো একটি সুয়েটার তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। মেয়েটি গায়ে জড়িয়ে নিলো। তার দৃষ্টিতে ধন্যবাদ কথাটি বুঝতে পারছি।
তোমার নাম কি?
কোনো উত্তর পেলাম না। আচ্ছা ঠিক আছে তোমার নাম বলতে হবে না। তোমাকে আমি একটা নাম দিচ্ছি। তোমার নাম হবে কদম। কদম আমার খুব পছন্দের ফুল। তাই তোমার নাম দিলাম কদম।
মেয়েটি এবার একটু হাসলো। মৃদু হাসি। এই হাসির মেয়েরা ঠান্ডা স্বভাবের হয়। মেয়েটাকে নিয়ে একটি কবিতাও বানিয়ে ফেলেছি ভাবছি সেটা শেষ সময়ে তাকে শোনাবো। মেয়েটিকে আমার ভালোই লাগছে। এটাকে প্রেমে পড়া বলা যাবে না। শুধু ভালো লেগেছে। এমন একটা মেয়ে পাশে থাকলে অনেক কবিতা গল্প এমন কি উপন্যাস লিখে ফেলা যাবে নিমিষেই।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। সাজগোজের কোনো বালাই নেই। তবুও কতো সুন্দর চাহনি।
সিগারেট ধরিয়ে ভাবছি, কি নিয়ে ভাবা যায়। মেয়েটিকে নিয়ে ভাববো? নাকি তার চুপ থাকা নিয়ে ভাববো? এবার মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। মেয়েটির উপর না কি নিয়ে ভাবা যায় সেটা নিয়ে মেজাজ গরম। মাথা ঠান্ডা করার জন্য মিসির আলি স্যার এর পদ্ধতি ব্যাবহার করে দেখি কাজে লাগে নাকি। সুযোগটা হাত ছাড়া করা যাবে না। পায়ের নো খের দিকে তাকিয়ে বিশ থেকে উলটো গুনা শুরু করলাম। দেখলাম কাজ করছে। মেজাজ টা একটু ঠান্ডা হয়েছে। আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালাম। এখনো বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
সেই কবিতার বইটা কি তুমি নিতে চাও। যেই বইটি লেখার জন্য একজন মেয়ে খুন হয়। সেই বইটা এখন আর পাওয়া যায় না কোথাও। এক বাড়ই ছাপানো হয়েছিলো। যদি নিতে চাও নিতে পারো। মেয়েটি মারা যাবার পর থেকে বইটি আমার সাথেই থাকে।
কেনো যেনো হাত ছাড়া করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আজকে তোমাকে বইটি দিতে ইচ্ছে করছে। কেনো সেইটা আমার জানা নেই।
মেয়েটি আবার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। হাত বাড়িয়ে দিলো বইটি নেয়ার জন্য। ব্যাগ থেকে বইটি বের করে বাড়িয়ে দিলাম।
ট্রেন ধির গতি হয়েছে। স্টেশনে থামতেই মেয়েটি প্রথম বললো আপনার সুয়েটার টা আমি নিতে পাড়ি? আর কদম নামটি আমার পছন্দ হয়েছে। এখন থেকে আমি সবাইকে আমার নাম কদম বলবো।
মৃদু একটি হাসি দিয়ে মেয়েটি নেমে যায়। শেষ কথাটি সে বলে যায় আমাকে। কদম, বইটি লিখেছিলো কদম।
Jonayet Rudra
Send private message to author


