এখনও সন্ধ্যা গড়ায়নি। তবে বিস্তৃত আকাশপটে খণ্ডে খণ্ডে বাসা বেঁধেছে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘরাজ।
চারপাশে ছেয়ে আছে হু হু করা অন্ধকারে। আমাদের ছায়লা দেওয়া রান্নাঘরে পিঁড়িতে বসে মা রান্না করছেন। ফুঁক ফুঁক করে যতই জ্বালানিতে আঁচ দিতে চেষ্টা করছেন তিনি, কিন্তু পূর্ব দিক থেকে তীব্র গতিতে হাওয়া এসে জ্বালানি নিভিয়ে দিচ্ছে বারবার ।
মা কিছুক্ষণ পর পর বলছেন,
আল্লাহ! একটু রহম করো, একটু রহম করো।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে মায়ের এই আকুল আবেদন শুনছি। আমি বললাম, “মা চলে এসো! মনে হয় কাল বৈশাখী ঝড় হবে।”
“না রে খোকা! চলে আসলে তুই আজ কী খাবি!”
মা উত্তর করলেন।
তার একটু পরেই শুরু হলো একটানা বর্ষণ। সাথে জল হাওয়ার একসঙ্গে ধাপাধাপি। বাড়ির পাশে উত্তরের মাঠটায় কোথায় যেন উগ্র আওয়াজে গোলা বর্ষণের মতো বজ্রপাত হলো। আমি ভয়ে বাহিরে এসে দেখি আমাদের রান্নাঘরের চালাটা উঠানের ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে। আর মা শূন্য রান্নাঘরে বসে তার শেষ চেষ্টাটাই করে যাচ্ছেন। কারণ সেদিন আমাদের ঘরে একটুও খাবার নেই। বাবার মৃত্যুর পর আমার মাকেই এখন সংসার গোছাতে হয়। তাই গতকাল চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে কাজ করে যে একপোয়া চাল জুটেছিল, তা আজ সকালেই শেষ। দিন এনে দিন শেষ হওয়ার মতো দুঃখী পরিবার যাকে বলে। যে পরিবারে একজন হতদরিদ্র মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
একটু পর দেখি মা দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। হাতে তার ভাত ঢাকা দেওয়া সামান্য খাবার। পরনে সেলাই করা শাড়িটা লেপ্টে আছে সারা শরীর জুড়ে। বিশীর্ণ মুখে গাঢ় শ্রান্তির ছায়া। স্থির অচঞ্চল দুটি চোখ। মমতায় ডোবানো চোখ দুটি আমার দিকে নির্মমভাবে চেয়ে আছে। আমি মায়ের কপালে একটি ক্ষত-চিহ্ন দেখে বললাম,
“মা! ওখানে তোমার কীভাবে চোট লেগেছে?”
আমার কথায় চমকে তার মুখ কেমন যেন লাল হলো।
কথার পিঠে কথা ঢেকে তিনি বললেন, “বাবা আজকে বেশি রান্না করতে পারিনি। তুই খেয়ে নে! আমার ক্ষিধে নেই।” এই বলে তিনি কাঁপা হাতে অর্ধথালা ভাত আমায় বাড়িয়ে দিলেন। আমি মনে মনে বললাম, মা! তুমি মিথ্যেবাদী। পৃথিবীর সব মায়েরা সত্যবাদী হলেও তুমি মিথ্যেবাদী।
(লেখা: মনিরুল ইসলাম)
Send private message to author






