প্রাপকঃ হেঁয়ালি

হেঁয়ালি,

আমি তোমার সহস্র যুগের পুরনো হাঁসি হতে এসেছিলাম। এসেছিলাম রক্তকাব্যের নীল বেদনার ছায়া হতে, কিন্তু সে সুযোগ আর পেলাম কৈ? তুমি ততদিনে চলে গেছ, হয়তো অন্যঘরের ঘরণী হয়ে, নয়তো অন্যের আঁকা কাব্য হয়ে, নাকি অন্যগল্পের নায়িকা হয়ে? আমি আর সে সুযোগ পেলাম কৈ? এই চিঠি যে তোমাকে কখনো লিখব, সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও ভেবে দেখিনি। মাঝে মধ্যে মনে ই করতে পারি না, এই জন্মের কোন ভাগে তোমার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়েছিল! আমি নিতান্তই ক্ষুদ্রতর সামান্য মানুষ, এসব জগতের লীলাখেলা কিছুতেই বুঝতে পারি নে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমা করো আমায়। শুরুতে কি লিখব কি লিখব ভাবতে ভাবতে অনেক সময় পার করে ফেলেছিলাম। আসলে, মনের কথা গুছিয়ে গুছিয়ে সুন্দর সাবলীল ভাষায় কখনো লেখার সৌভাগ্য হয় নি, তাই আমার এগুলো কেবল বিচলিত মনের বেদনার উপাখ্যান মাত্র, আশার করি তুমি সমস্ত চিঠিটাকে তেমন করে দেখবে। হাজার হোক, তুমি তো এ যুগের মেয়ে, সেজন্যেই তো আমার সারল্য চিঠির পঙক্তিমালা বুঝতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও আমি কম মাথা ঘামাই নে। কাজেই তোমাদের অমন আধুনিকতার মাঝে আমার সামান্য জড়ানো কন্ঠে গাওয়া, পুরনো সুরের কবিগানকে যদি অসম্মাননা না করো তবে তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

আচ্ছা তোমার মনে আছে, সেই জোনাক ধরা রাতের গল্পগুলো? কত রকমের জোনাক ই না ধরে এনে ছিলাম কেবল, তোমার হাঁসির উপলক্ষ্য হবো বলে। কিন্তু আমার আর সেই সৌভাগ্য হলো কোথায়! প্রেম নিবেদন করেছিলাম ঠিক ই, তবে এই নব জগতের অদৃশ্য নিয়মাবলী আমার শান্ত-শুভ্র চিত্তের ভালোবাসার বড্ড ঊর্ধ্বে ছিল। কিভাবে জানবো বল যে, তোমার অন্য কারো সাথে ভাব বিনিময় চলছে? কিভাবে জানবো বলো, তোমার মনের অন্তঃস্থলে অন্য কারো সাজানো সংসারের নিত্য নতুন নাটক চলেছে? আমি, সে মান্ধাতা আমলের মানুষ; আধুনিকতার নব-নিত্য রীতিনীতি কিছুতেই বোধগম্য হয় না আমার।

তোমার সাথে আমার এখন পর্যন্ত সেরকম ভাবে দেখা হয়ে উঠে নি। আমি ই ঠিক তেমন ভাবে তোমাকে দেখা করার কথা বলি নি। হ্যাঁ, আমি মেনে নিচ্ছি, এখানে দোষ কেবলি আমার। শুধুই আমার। তোমাকে কেমন করে এ কথা বলি? তোমার সাথে কথা বলতে গেলে ই, লজ্জায় যেন আমার মাথা কাঁটা যায়! কী বলব, না বলব কোনো কিছু ই যেন গুছিয়ে নিতে পারি না, তখন বুকের মাঝে আরো শক্ত করে ধকদকানি অনুভূত হতো! মাঝে মাঝে ভয় হয়ে, যদি তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দাও, তবে আমার কী হবে! বাড়ীর পাশের কাঁঠাল গাছে নির্ঘাত ঝুলে পড়া ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না তখন। যেন এই হারাবার ভয় শেষমেষ সত্যি হয়ে দেখা দিল।

কত স্বপ্ন এঁকেছিলাম জানো? তোমায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ভর দুপুরে মধ্য নদীতে। রোদের সুতীব্র আঁচে যেন আমাদের সর্বাঙ্গে অনল ঝরছে। তবে, সেটা কখনই উপলব্ধি করতে পারছি নে। তোমার বিরক্ত হবার ভানে, যেন ঈশ্বরের হাতে আঁকা ছায়ার কারুকার্য দিব্যমান। ভ্রু দুটি যেই না কুঁচকে তাকিয়েছ আমার দিকে, আমি যেন এই অপার রূপের চিরন্ত একক সাক্ষী হবার ব্যর্থ চেষ্টায় মত্ত। নৌকো ঠিক ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে; সামনে বিস্তীর্ণ লোকালয়, আমরা সে ই লোকচক্ষুর আড়াল হতে যেন এক কালের সুদূরে। হাঁসি পাচ্ছে না? কী করি বলো, স্বপ্নগুলোর এমন ছেলেমানুষি কেন যে হয়?

আরেকবার, মনে হলো যেন সত্যি সত্যি বাস্তব দিবাস্বপ্ন দেখে উঠলাম। তুমি আর আমি, কোনো রিসোর্টের করিডোর ধরে হাঁটছি। একজন অন্যজনের থেকে খানিকটা দূরে, কিন্তু মনে হচ্ছে এক জন্মের ফারাক, অন্তরের আকুলতা এক হবার নেশায় মগ্ন হতে ইচ্ছুক। অজ্ঞাত উপায় না পেয়ে, সুইমিং পুলের পাশে সাজানো চেয়ারে গিয়ে বসলাম দুজন। হায়! এখানেও সেই একই বিড়ম্বনা। লোকারণ্যে ভরপুর, জনসমাগম বরাবর নির্দেশ দিচ্ছে যেন, এখান থেকে সরে গিয়ে দূর কোথাও হারিয়ে যেতে। ব্যথিত মনে আমাদের ছোট্ট ঘরে ফিরে এলাম, সাজানো আসবাবপত্র, পরিষ্কার বিছানাপত্র, কিছুক্ষনের ভেতর যে ধ্বংস হতে চলেছে তা কী আর কেউ জানত? তুমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে পড়লে সেখানে, আমি তখন দূর থেকে দাড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখছি। তুমি বললে, “কী দেখ, অমন করে?” আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। পুনরায় তুমি বললে, “এদিকে এসো, বসো এই চেয়ারটায়।” আমি অজ্ঞাত বাধ্যগত ছাত্রের মত মাস্টারনীর কথায় আমল করলাম। তুমি তোমার গলায় জড়ানো ওড়নাটা সরিয়ে নিলে, তা দেখে আমার সমগ্র চিত্তে কালবৈশাখীর বিদ্যুৎ খেলে গেল। মাথা নিচু করে ফেললাম সাথে সাথে, কোনো কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। অবাক নয়নে তুমি তাকিয়ে দেখছ আমার এমন সারল্য কীর্তি। মৃদু হেঁসে আমায় বললে, “ছেলে মানুষ বুঝি এমন লাজুক হয়? আগে তো কখনো দেখি নি” লজ্জায় আমার সমস্ত মুখ যেন লাল লঙ্কা এঁকে ফেলল। তুমি আবার বললে, “অতদুরে গিয়ে বসেছ কেন? কাছে এসো।” আমি এবার আর নড়তে পারলাম না। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আছে। তুমি উঠে এসে, শীতল হাতে আমার উষ্ণ হাত ধরলে; তারপর টেনে নিয়ে এক ঝটকায় বিছানায় বসিয়ে দিলে; তুমি দাড়িয়ে আছ, আমি বসে আছি। হতবিহল দিশেহারা চোখে আমি তোমার মনের অনুভূতি পড়ার চেষ্টা করছি। চুপটি করে বসে পড়লে আমার পাশে, আমার ডান হাত তুলে তোমার বুকের কাছে নিয়ে আলতো করে চুমু খেলে। আমি তখনো মৌন, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি নে। মনে হচ্ছে, মুখ থেকে যদি আগোছালো কিছু বেড়িয়ে পরে তবে বিধাতাও যেন রুষ্ট হবে। তুমি আমাকে বললে, “আমায় ভালোবাসা?” আমার অন্তরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে, যেন বেড়িয়ে এসে বলতে চাচ্ছে, “বড় বেশী ভালোবাসি তোমায়!” অনুভূতিগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, অনুভব করতে পাচ্ছি, কিন্তু অসার হয়ে বসে আছি। কেন কিছু বলতে পারছিলাম না, জানো? ভয় হচ্ছিলো, যেন এই স্বপ্ন ভেঙ্গে না যায়। অনন্তকাল ধরে আমি এই স্বপ্নে বিভোর হতে চেয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমার ভেতরকার পুরুষসত্ত্বা জেগে উঠল, এক উথাল-পাথাল আলেয়া জ্বলে গেল মনের অন্তরালে। সামান্য রিসোর্টের ঘরবন্ধি দুই মানব-মানবী আদিম অবগাহনে নিজেদের ভাসিয়ে নিল। চুমু খেলাম তোমার সর্বাঙ্গে, তুমি চুমু খেলে আমার সমগ্র চিত্তে, নিজেকে উজার করে আমায় কাছে টেনে নিলে। আমি তখন আর মৌনতা ধরে রাখতে পারলাম না, ভেতরের সমস্ত সংশয় সরিয়ে তোমায় বললাম, “তোমাকে বড়ও বেশী ভালোবাসি, হেঁয়ালি”

বিবস্ত্র অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছি আমরা দুজন, লীলাখেলা কেবল শুরু হবে বলে। তোমার অধরের সমস্ত অক্সিজেন আমার চাই, শুষে নিচ্ছি প্রাণ ভরে; যেন ধরিত্রিলোকে এটাই আমার শেষ লগ্ন। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে বিলিয়ে, তুমি মুক্ত বিহঙ্গের মত ভেসে যাচ্ছিলে, একটুকরো শাদা মেঘেরূপে আমার মাঝে। তোমার বাম গালে, বিধাতার আঁকা ছোট্ট তিল নজর কেড়েছিলো খুব করে। ধীরে ধীরে চুমুর প্রদেশের পরিবর্তন ঘটল, তিলের উপরিভাগ হতে শুরু করে গলার নিম্নভাগে চলে গেল আমার ওষ্ঠের সুখ। আমি পাগল প্রায়, এই প্রলয় যেন থামবার নয়। চলছে, ঈশ্বরের লেখা গল্পের সুরে, তোমার সিঁথির সীমান্ত থেকে পায়ের নখাব্রো অবধি; কেবলি ক্ষুদ্র ভক্তের প্রশংসার রূপে, ভালোবাসার গভীর সুতীব্র আস্বাদনে।

কেমন করে জানি আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, দিবাস্বপ্নেও তোমার ধড়ের প্রতিটি ভাঁজ সুস্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। একে কী সত্যি ই ভালোবাসা বলে? নাকি বলে, তোমার প্রতি আমার পার্থিব মনঃকামনা? আমি জানি নে, তবে এইটুকু বলে দিতে পারি, যদি ভালোবাসা ই না থাকত তবে কেন তোমাকে নিয়ে শুধু শুধু হাজারো মিছে দিবাস্বপ্ন গড়তে যাব?

একটিবারের জন্যে দেখা করবে, প্লিজ? কোনো কথা বলব না, আগেও যেমন বলি নি ঠিক তেমন করে, নিশ্চুপে তোমার মুখাবয়ব দেখে যাব। কোনো বায়নাও ধরব না কখনও। আচ্ছা, তুমি কী সত্যি সত্যি অন্যের ঘরণী হয়ে গেছ? নাকি কারো ভাবের-সমাধী? এসকল জবাব দেবার প্রয়োজন নেই, আমি বরং আমার মনের কথাটা এবার বলে ফেলি, ভয় হয় যদি আর কোনোদিন তোমার দেখা না পাই,

“হেঁয়ালি, আমি তোমাকে সত্যি সত্যি বড্ড বেশী ভালোবেসে ফেলেছি,
আমার সমগ্র চিত্তে এখন তোমার রাজত্বের বীণা বাজে,
একটিবারের জন্যে আমার হয়ে দেখবে?
তবে, সেই সুর তোমার মনে গেঁথে আমার মনের রক্তকাব্য থামাবে”

দিবাস্বপ্ন আজকাল অনেক বেশী দেখে ফেলছি, কোনোভাবেই থামাতে পারছি না।  তোমার লিখা ডায়রীটা এখন পর্যন্ত সতের বারের মতন পড়ে শেষ করেছি, শেষ কয়েক পাতা বোধয় একশ বারে বেশী হবে। একটিবারের জন্যে দেখা করো, অমন করে হেঁয়ালি করো না, প্লিজ। আমার ভারী কষ্ট হচ্ছে, রাতে ঘুমুতে পারিছি নে, তোমার জন্যে রাখা একবুক এ নিঠুর ভালোবাসাকে নিয়ে এবার নাহয় আমায় মুক্তি দাও। সেজন্যে শুধু কল্পনার জগৎ হাতড়ে বেড়াচ্ছি। সেখানে নয়, এবার চাই বাস্তবে তোমাকে ছোঁয়ে আমাদের ভালোবাসা যেন পূর্ণতা ফিরে পাক!

ভালোবাসা নাও।

ইতি,
কেবল তোমারই সূচক

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
2
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Foisal Shahriyer
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!