বৃদ্ধাশ্রমের সেই আমি

মৃত্যুকে খুব কাছ থেকেই দেখেছি।এইতো গতকালকেই আমেনা বেগম মারা গেলেন।আমেনা বেগম ছিলেন আমাদের বৃদ্ধাশ্রমের সবচেয়ে পরহেযগার মহিলা।কী নিষ্পাপ চেহারা।তার দুই ছেলেমেয়ে,দুইজনই দেশের বাইরে।তাদের খবর দেওয়া হয়েছে।তাদের আসতে অনেক দেরি।তাই জানাযা পড়ে  কবর দেওয়া হয়ে গেছে।পৃথিবীর কারো কিছুই হল না- খালি আমার পরিবারের একজন সদস্য কমে গেল।

আমি, রহিমা খাতুন,বিগত বিশ বছর যাবত এই বৃদ্ধাশ্রমের দেখভাল করি।আমার যে এই কাজটার খুব দরকার ছিল তা নয়,আসলে কাজটাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম।স্বামী মারা গেছে বিয়ের সাত বছরের মাথায়।ছেলেটা পড়ালেখা করে বিদেশে গিয়ে চাকরি করছে।অনেকবার নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু আমি যেতে চাই নাই।আসলে এই পরিবার ছেড়ে কেমনে যাই?খুব বড় না আমার পরিবারটা, সবমিলিয়ে ২০-৩০ জনের একটা পরিবার।

তবে আমার এই পরিবারের মানুষগুলো একেকজন একেক রকম।এই যে ধরুন অমৃতা দেবীর কথা।বয়স আশি ছুই ছুই।রোজ সকালে ছেলের খোঁজ করে।কেউ আসছে কিনা,কোন চিঠি দিয়েছে কিনা।আমার মুখে যখন না শুনে তখন বলে,”কি জানি বাপু….তোমরা আবার লুকায় রাখ নাতো?তোমাদের আবার বিশ্বাস নাই।”তার এই অভিমান মাখা কথা শুনে হেসে দেই।আসলে এই অভিমান মাখা কথার পেছনে যে এক কান্নার গল্প আছে সেটা বলে দিতে হয় না……চোখ দেখলেই বোঝা যায়।

আবার সখিনা বিবির কথায় ধরুন না।সোজা মুখের উপর বলে দিয়েছে,”আমি কোথাও যাচ্ছি না বাপু।বাড়িতে গেলে কত কথা শোনায়, বাবারে বাবা!এখানে ঢের ভাল আছি।খাই দাই,তিলিভিশন দেখি।এখান থেকি যেতে পারব না বাপু।”এসব শুনলে চোখটা আপনা থেকেই জলে ভরে যায়।

দিন যাচ্ছে,সময় গড়াচ্ছে,আমার বয়সটাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে।কয়েকদিন ধরে দেখছি কোমরের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে।একদিন সকালে আর পারলাম না।শুয়েই ছিলাম সকালবেলা।কাউকে কিছু জানাই নি।কিন্তু কি করে যেন সবাই টের পেয়ে গেল।সখিনা বিবি তো বলেই ফেলল,”একটু নিজের দিকেও তো নজর দিতি হয় বাপু।তোমাকে চোখের সামনে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে কি ভালা লাগে কও?”আরেকজন কিছু বলতে পারলেন না।কিন্তু চোখের জলে সব বুঝিয়ে দিলেন।আহা……এত মানুষের ভালবাসা..

ডাক্তার দেখালাম।অবস্থা খুব একটা ভাল না।মেরদন্ডের একটা হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে।ভারী কাজ করা যাবে না।আর বিশ্রামে থাকতে হবে।ছেলেকে আর বললাম না।হয়তো নিয়ে যেতে চাইবে।কিন্তু আমার শেষ ইচ্ছা এখানেই থেকে যাওয়া।মরলে যেন এখানেই মাটি পাই।এত বছরের সংসার….এভাবে তো ছেড়ে যাওয়া যায় না।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে যখন সাতদিনের মাথায় ছেলে দেশে আসল..তখন আর বুঝতে বাকি রইল না।আমার এই সংসার ছেড়ে যাওয়ার সময় এসে গেছে।

আজ আমি আমার দশ বছরের নিজ হাতে গড়া সংসার ফেলে চলে যাচ্ছি।সেই জং ধরা লোহার গেট,সেই ঘর যেখানে দশ বছর ছিলাম,সেই জায়গা যেখানে সকালবিকাল সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসে গল্প করতাম……সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি।মনে হছে বৃদ্ধাশ্রমে যেন কেউ মারা গেছে আর সবাই তার শোক পালন করছে।কিন্তু কোন বাধাই আজক আমাকে আটকাতে পারল না।ছেলের হাত ধরে গাড়িতে উঠে গেলাম।সবাই বিদায় জানিয়ে দিল।গাড়ি চলতে শুরু করল।পেছনে ফিরে তাকালাম যতক্ষণ ওই গেটের ধারের তালগাছটা দেখা যায়।যখন বুঝলাম আর দেখা যাচ্ছে না তখন চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল।মনে হল, চোখ এই বিশ বছরের জীবনে যে সৌন্দর্য দেখেছে তা হয়ত সারাজীবন পুরো পৃথিবী ঘুরলেও পাবে না।তাই থাক, চোখকে একটু বিশ্রাম দেই।

  • (Md.Tasdiqul Haque)
Send private message to author
What’s your Reaction?
6
7
0
0
0
0
1
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!